DMCA.com Protection Status
title="৭

ছাত্রলীগের অন্তরকলহঃ আরও সাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভয়াবহ সংঘর্ষের আশংকা

99539_1বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও ৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের দু’গ্র“পে সংঘর্ষের আশংকা রয়েছে। এর বাইরে ১১টি জেলা শাখার অবস্থাও ভালো নয়। ছাত্রলীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মূলত আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সম্ভাব্য সংঘর্ষের এ আশংকা করা হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন কমিটিতে পদ লাভের আশা বা বঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভ, অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য ব্যক্তিকে নেতা করা, স্থানীয় রাজনীতির প্রভাব, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতি। এছাড়া নানা ধরনের অপরাধের দায়ে সংগঠন থেকে বহিষ্কৃতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার পরিবর্তে প্রশ্রয়ের ঘটনাও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষকে উস্কে দিচ্ছে।


সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবারের সংঘর্ষের ঘটনাটি মূলত কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়। গত বছরের ৮ মে এই কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু একটি অংশের কমিটি পছন্দ হয়নি। এ কারণে পরদিনই নবগঠিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমরান খানের ওপর হামলা চালায় বঞ্চিত-অসন্তুষ্ট অঞ্জন-উত্তম গ্র“পের কর্মীরা। হামলাকারীরা ইমরানকে এমনভাবে কুপিয়েছে যে, তিনি বর্তমানে পঙ্গু। জীবনে তার আর স্বাভাবিক জীবনে ফেরা অসম্ভব বলে চিকিসৎকরা জানিয়েছেন।

ওই ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে গত জুলাইয়ে উত্তমকে কুপিয়ে পা বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। এরপর উত্তম ক্যাম্পাসছাড়া হন। উত্তমের অনুপস্থিতির সুযোগে নবগঠিত পার্থ-ইমরান কমিটির নেতাকর্মীরা বৃহস্পতিবার ক্যাম্পাসে অবস্থান নেয়ার চেষ্টা চালান। কিন্তু উত্তমের ওপর হামলার পাল্টা প্রতিশোধের আগুনে এদিন জীবন গেল সুমনের।ছাত্রলীগের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অশান্তি সৃষ্টির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. একেএম নূর-উন-নবী বলেন, ‘সমস্যা এড়ানোর মূল উপায় হচ্ছে ছাত্র সংগঠনগুলোকে কাছ থেকে নজরে রাখা। প্রয়োজনে আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু রাজনীতি বন্ধ করা সমাধান নয়। ভেতর থেকেই তাকে কলুষমুক্ত করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘ছাত্র সংগঠনের মূল সমস্যা হল তা বর্তমানে দল-উপদলে ভাগ হয়ে গেছে। এর বাইরে জাতীয় ও স্থানীয় রাজনীতির প্রভাবেও এর আলাদা চরিত্র নষ্ট হয়েছে। এসব সমস্যা দূর করতে হবে।’

ইমরানের ওপর হামলার ঘটনায় উত্তমকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এরপর তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পুলিশ প্রশাসনকেও অনুরোধ করা হয়েছিল বলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগ দাবি করেন। তিনি বলেন, উত্তমকে গ্রেফতার করা হলে হয়তো ব্যতিক্রম ফলাফলও পাওয়া যেত শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি এ সময় বাকৃবি, যশোর, হাজী দানেশ, রংপুর রোকেয়াসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ করে বলেন, ‘এসব প্রতিষ্ঠানেও আমরা সমস্যার আশংকা করছি। তবে যদি কোনো অঘটন ঘটে তবে তা ছাত্রলীগের কারণে নয়, শিক্ষক রাজনীতির কারণে ঘটতে পারে। শিক্ষকরা ছাত্রলীগকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে থাকেন বলে অভিযোগ তার।’

শুধু উত্তম নয়, গত ছয় বছরে ছাত্রলীগ থেকে এ পর্যন্ত মোট ১০৭৪ জন নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এদের মধ্যে ৬৩০ জনই বহিষ্কৃত হন বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির গত প্রায় সাড়ে ৩ বছরের মেয়াদে। বাকিরা ২০০৯ থেকে ২০১১ সালের জুলাইয়ে বর্তমান কমিটি গঠনের আগে পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে সংগঠন থেকে বহিষ্কৃত হন।

এর আগে ২০১২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও জুবায়ের আহমেদ নামে ছাত্রলীগেরই আরেক কর্মী নিজ দলের বহিষ্কৃত নেতাকর্মীদের হাতে খুন হন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বহিষ্কৃতরা যেমন ছাত্রলীগকে এভাবে নানা উপায়ে ডোবাচ্ছে। বিপরীত দিকে, এসব বহিষ্কারের ঘটনার বেশির ভাগই লোক দেখানো। অভিযোগ রয়েছে, অনেক সময়েই কোনো একটা ঘটনার পর ব্যাপক সমালোচনার পর কাউকে বহিষ্কার করা হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেলে এরপর সংশ্লিষ্টরা ফের সংগঠনের মিছিল-সমাবেশসহ কর্মসূচিতে সক্রিয় হন।

২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর ঢাকার পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ দাশকে যারা প্রকাশ্যে খুন করেছেন, তাদের অনেকেই বর্তমানে সাংগঠনিক কাজেও সক্রিয়। ঢাকা কলেজে দু’গ্র“পে বন্দুকযুদ্ধ ও একজন নিহতের ঘটনায় কমিটি স্থগিত করা হয়। কিন্তু ওই কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে নিয়মিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে দেখা যায়। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় সূর্যসেন হলের যে ৫ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে তারাসহ তাদের স্থগিত কমিটির নেতারাও বর্তমানে সংগঠনে সক্রিয়। বৃহম্পতিবার শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনায় শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এ ঘটনার পেছনেও বহিষ্কৃতরা মূল ভূমিকা রাখেন বলে জানা গেছে।

বহিষ্কৃতদের ব্যাপারে ছাত্রলীগ সভাপতি বলেন, ‘যাদের আমরা বহিষ্কার করি, তারা ছাত্রলীগের কেউ নয়। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্যও আমরা পুলিশ প্রশাসনকে বলে থাকি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আমরা সহযোগিতা পাই না। তাই কোথাও যদি ত্যাজ্যপুত্র কোনো অঘটন ঘটায়, তাহলে তার দায় পিতার ওপর বর্তায় না। আমরা তাদের দায়ভার নেব না।’

১৩ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে মতবিনিময় করেন। ওইদিন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি জানান যে, শৃংখলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের কারণে এ পর্যন্ত ৬৩০ জনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। জানা গেছে, এর আগে ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১০ সালের মে মাস পর্যন্ত মোট ২৬৪ জনকে বহিষ্কার করা হয়। বাকি ১৮০ জনকে পরের এক বছরে বহিষ্কার করা হয় সংগঠন থেকে।

এ ব্যাপারে ছাত্রলীগের দফতর সম্পাদক শেখ রাসেল বলেন, সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ড ও নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ পেলে সংগঠন থেকে বহিষ্কারের ঘটনা ঘটে। তাদের হাতে এটাই সর্বোচ্চ শাস্তি। এর বাইরে ফৌজদারি অপরাধে কেউ জড়ালে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পুলিশ প্রশাসনকে অনুরোধ করে থাকেন তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যে সহস্রাধিক নেতাকর্মী বিগত দিনে বহিষ্কৃত হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ, সংগঠনের শৃংখলা ভঙ্গ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ওঠে। তবে এর চেয়ে আরও বেশি নেতিবাচক এবং নিন্দিত কর্মকাণ্ড করেও অনেকে রেহাই পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, সন্ত্রাসী বা আইনশৃংখলা পরিপন্থী ঘটনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হয়েছেন, পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন, এমনকি যে ঘটনার কারণে সংগঠনের ‘সাংগঠনিক নেত্রী’র পদ থেকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করা সত্ত্বেও বহিষ্কার করা হয়নি এমন ঘটনাও রয়েছে। এসব অভিযোগ সংগঠনের সব পর্যায়ের নেতাদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে।

নাম প্রকাশ না করে সংগঠনের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা জানান, নানা অপরাধে জড়ানোর পরও মূলত যারা সংগঠন থেকে বহিষ্কারের ‘লোক দেখানো’ শাস্তিটাও পান না, তারা মূলত বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের লোক হিসেবে পরিচিত। গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এরশাদ চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। কিন্তু তিনি বহিষ্কারের শাস্তি পাননি।

১৪ জেলা শাখায় সংঘর্ষের আশংকা : কমিটি গঠন দ্বন্দ্বকে ঘিরে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের ঘটনাটি ঘটেছিল। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠিত সংঘর্ষের পর ছাত্রলীগের ঝামেলা ও বিরোধপূর্ণ অন্যান্য জেলা শাখা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ মুহূর্তে ১৪টি জেলা শাখা নিয়ে সমস্যা রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল মহানগর, চট্টগ্রাম জেলা দক্ষিণ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ জেলা, ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কিশোরগঞ্জ জেলা, ঠাকুরগাঁও জেলা, রংপুর মহানগর, রাজশাহী জেলা ও পটুয়াখালী জেলা। এগুলোর মধ্যে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর মেডিকেল কলেজ, বরিশাল বিএম কলেজ, রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং বরিশাল মহানগরের পরিস্থিতি বেশি জটিল। কমিটি নিয়ে জটিলতার কারণে গত কয়েক দিনে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রংপুর জেলা কমিটি স্থগিত করতে হয়েছে। কিশোরগঞ্জ কমিটি গঠন নিয়ে খোদ কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কুমিগ্রাম জেলা কমিটি নিয়ে মারামারি হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) এবং ময়মনসিংহ জেলা কমিটি নিয়ে জটিলতার ঢেউ লেগেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটে বাকৃবি বর্তমানে অচল রয়েছে।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!