র্যাব বন্ধের দাবী, পঞ্চদশ সংশোধনীর তীব্র সমালোচনা- অবাধ নিরপেক্ষ নতুন নির্বাচন,রাজনৈতিক সংস্কারের আহবান,
*বাংলাদেশে যা চলছে তার নাম গণতন্ত্র নয়- সায়মন ডানসাক এমপি।
*র্যাব এক ডেড স্কোয়াডের নাম- ফরহাদ মাযহার। *হেফাজতের প্রতি আমাদের সহানুভূতি রয়েছে- লর্ড নাজির আহমেদ।
*সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের কারণ- ডঃ তুহিন মালিক
*অবৈধ নির্বাচন বাতিল করে নতুন নির্বাচন দিতে হবে- এম এ মালিক।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের পর্ট কলিস হাউসে আজ মঙ্গলবার ২৫ নভেম্বর বাংলাদেশে হিউম্যান রাইটস এন্ড ডেমোক্রেসি-পারস্পেক্টিভ বাংলাদেশ শীর্ষক এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সিটিজেন মুভমেন্ট ওয়ার্ল্ড এর আয়োজনে এই সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন লর্ড নাজির আহমেদ। এতে বক্তব্য রাখেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের লেবার দলীয় সদস্য সায়মন ডানসাক এমপি, ডেভিট ওয়ার্ড এমপি, জিম পেট্রিক এমপি, লর্ড কোরবান হোসেন, লর্ড নাজির আহমেদ, লর্ড ব্যারোনেস পলা মঞ্জিলা উদ্দিন, বাংলাদেশ থেকে আগত বিশিষ্ট লেখক, গবেষক ফরহাদ মাযহার, টেলিভিশন টক শোর জনপ্রিয় আলোচক ডঃ তুহিন মালিক সিটিজেন মুভম্যান্টের আহ্বায়ক এম এ মালিক সহ আরো অনেকেই।
সেমিনারে লর্ড নাজির বলেন, বাংলাদেশ তার ৪০ বছর আগের ঘটনা নিয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে। ফাইন- আমরাও সেটা চাই। কিন্তু বাংলাদেশে যা হচ্ছে সেটা যুদ্ধাপরাধের বিচার নয়, বিচারের নামে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য, রাজনৈতিকভাবে মোটিভেটেড হয়ে অ-স্বচ্ছভাবে আন্তর্জাতিক নিয়ম লঙ্ঘন করে বিচারের নামে প্রহসন করা হচ্ছে। বিগত ১/১১ সময়ে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লন্ডনের হিথরো এয়ারপোর্ট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রার সময়ে তার সহযোগিতার স্মৃতিচারণ করে বলেন, সেদিনের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সৈনিক ও আওয়ামীলীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান অগণতান্ত্রিক ও একতরফা কার্যকলাপে স্তম্ভিত এবং হতবাক। শেখ হাসিনার কাছ থেকে তিনি এরকম এক নায়ক সুলভ আচরণ আশা করেননি বলে জানান।
এ সময় তিনি চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলনে দমন-পীড়নে সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করে হেফাজতে ইসলামের প্রতি সহানুভূতির(সিমপ্যাথি) কথা উল্লেখ করেন।
সেমিনারে লর্ড কোরবান হোসেন বলেন, বাংলাদেশে মানবাধিকারের লঙ্ঘন আর রাজনৈতিক সন্তোষ, হত্যায় উদ্বেগ প্রকাশ করে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের উন্নয়নের তাগিদ দেন। একই সাথে লর্ড কোরবান হোসেন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সকলের অংশ গ্রহণের মাধ্যমে দ্রুত নতুন নির্বাচনের উপর জোর দেন।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের লেবার দলের এমপি সায়মন ডানসাক বলেন, বাংলাদেশে বিগত ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে, সেখানে ৫% পার্সেন্ট ভোটারের কোন উপস্থিতি ছিলোনা- পৃথিবীর সকল গণমাধ্যম এবং বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ সেই দাবীই করছেন। ১৫৩ জনের মতো সাংসদ বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। বাকী আসনগুলোর নির্বাচনেও ভোটারের কোন উপস্থিতি ছিলোনা। এই ভোটের মাধ্যমে সরকারের কোন ক্রেডিবিলিটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আছে বলে তিনি মনে করেননা। সায়মন ডানসাক এমপি বলেন, বাংলাদেশের সংকট নিরসনে অবিলম্বে সংলাপের মাধ্যমে সকল দলের অংশ গ্রহণে অবাধ নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থাই এর সমাধান বলে তিনি মনে করেন।
একই সাথে সায়মন বলেন, যেভাবে বর্তমান সরকার গুম, খুন, হত্যা, বিরোধী রাজনৈতিক দল মতের দমন পীড়ন ও মানবাধিকারের যেভাবে লঙ্ঘন করছে, বিনা বিচারে হত্যা, দুর্নীতির উৎসব যেভাবে চলছে, এর প্রেক্ষিতে আমি এখানে ব্রিটিশ বাংলাদেশীদের আহ্বান জানাই আসুন আমরা সকলে মিলে আগামী ৫ জানুয়ারি ভোটার বিহিন এই সরকারের বার্ষিকী পালনের মাধ্যমে প্রতীকী প্রতিবাদ করে ব্রিটিশ সরকারকে এই ম্যাসেজ পৌছে দেই, বাংলাদেশের সরকার ভোটারবিহিন সরকার। এর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের সম্মুখীন।
সেমিনারের বাংলাদেশের বিশিষ্ঠ লেখক, গবেষক, বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মযহার লিখিত তথ্য উপাত্ত ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত উল্লেখ করে বলেন, বিএনপির আমলে গঠিত র্যাব বর্তমানে এক ডেড স্কোয়াডের নাম।বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ এখন র্যাব নামক এই বিশেষ এলিট ফোর্সের নাম শুনলে আঁতকে উঠেন।এই বাহিনীর দ্বারা ২৭জন নাগরিক হত্যার উল্লেখ করে বলেন এই কিলিং বাহিনী নারায়ণ গঞ্জের সাত খুনের সাতেও জড়িয়ে পড়েছে- যা মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচিত হয়েছে।
ফরহাদ মযহার বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির সময়ে অর্থাৎ মহান মুক্তিযুদ্ধে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র আর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নিয়ে যে ঐক্য গড়ে উঠেছিলো আওয়ামীলীগ সরকার স্বাধীনতার অব্যাহতি পর পরই সেই গড়ে উঠা ঐক্য বিনষ্ট করে দলীয় ভিত্তিতে সরকার পরিচালনা করে, যা এখনো অব্যাহত আছে। জাতীয় ঐক্যের বিপরীতে দলীয় চিন্তা চেতনা রাষ্ট্রের সর্বাঙ্গে এমনভাবে আঁকড়ে ধরেছে যেখান থেকে এখন শুধু পচনই নয়, দুর্গন্ধ বের হচ্ছে।
ফরহাদ মযহার সেমিনারে অধিকার কর্তৃক তথ্য উপস্থাপন করে বলেন, ২০০৯ সালে যেখানে মানুষ গুম হওয়ার সংখ্যা ছিলো ৯, সেখানে ২০১৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত দেখা গেছে গুম হওয়ার সংখ্যা ৩১ এ দাঁড়িয়েছে। ২০১৩ সালয়ে এই গুম হওয়ার সংখ্যা ছিলো ৪৩। এর বাইরেও আরো অনেক গুমের তথ্য রয়ে গেছে, যা রেজিস্টার্ড নয়।
তিনিও সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর আর্টিক্যাল ১৪২ এর ১,২.৩ এবং ১৫০ এর ১১ উপ-ধারার উল্লেখ করে সমালোচনা করে বলেন, আওয়ামীলীগ আমাদের সংবিধানের মৌলিক রাষ্ট্রীয় স্ট্যাটাসের পরিবর্তন করে একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে দিয়েছে, যা মৌলিক গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন।
সেমিনারে ডঃ তুহিন মালিক বলেন, তত্বাবধায়ক সরকারের পটভূমিকা এবং এর মাধ্যমে বিগত সময়ের নির্বাচন কালীন পরিস্থিতি ও সরকার গঠনের লিখিত ধারাবাহিক ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে বলেন, ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত কেয়ার টেকার গর্ভমেন্ট বা তত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশে মোটামুটি ফ্রি, ফেয়ার, ক্রেডিবল ইলেকশনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধীরে ধীরে উন্নতি সাধিত হচ্ছিলো।তিনি বলেন, বিগত ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতিতে অবাধ নিরপেক্ষভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও সরকার গঠিত হয়েছে।
ডঃ তুহিন মালিক তার লিখিত নিবন্ধে সেমিনারে বিগত সময়ের ২০০৭ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে ১১ জানুয়ারির সময়কালীন রাজনৈতিক আন্দোলন, ঘেরাও, হরতাল, বিশৃঙ্খলা, লঘি বৈঠা আর রাজপথ দখল ইত্যাদির উল্লেখ করে তখনকার সময়ে সেনা সমর্থিত দুই বছরের সরকারের বিভিন্ন কার্যকলাপের বিবরণ দিয়ে বলেন, এই সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকার আওয়ামীলীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলো। কেননা দুই বছরের এই অসাংবিধানিক সরকারের সকল কর্মকাণ্ড দেশে বিদেশে সকল পার্টনার, ষ্টেক হোল্ডার, ডেভেলপম্যান্ট পার্টনার, সংস্থার কাছে ফোকাস হয়েছিলো বাংলাদেশে একটি অবাধ স্বচ্ছ ও সকল দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থাই কেবল রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলা করতে পারে।কেননা এর মাধ্যমে দেশ কেবল মানবাধিকারের লঙ্ঘন আর রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা সম্ভব বলে সকল মহলেই প্রতিভাত হয়েছিলো।
ডঃ তুহিন মালিক বলেন, ২০১১ সালে ৩০ জুন আওয়ামীলীগ সরকার সংবিধানের এই তত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে সংবিধানের সংশোধন করে বসে। তার মতে এই সংবিধান সংশোধনই মূলত বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের মূল কারণ।
তিনি আরো বলেন, ২০১১ সালের ১০ মে সুপ্রিম কোর্টের আপিলেট ডিভিশন তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অসাংবিধানিক ব্যবস্থা বলে যে ডাইরেকশন দিয়েছিলো- আওয়ামীলীগ সরকার এপিলেট ডিভিশনের দেয়া সেই ডাইরেকশন না মেনেই তড়িঘড়ি করে তত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছিলো। ডঃ তুহিন মালিক আরো বলেন, এই সংশোধিত সংবিধানের সন্দেহমূলক ৭বি এবং ১৫২ অনুচ্ছেদের ৫২টি অনুচ্ছেদ যা কখনো সংশোধন করা যাবেনা বলে বিধান রাখা হয়েছে, যা পৃথিবীর কোন পার্লামেন্টেই এমন সাংবিধানিক বিধান নেই যা পরিবর্তন করা যাবেনা- এই এমন চিরস্থায়ী ব্যবস্থাই পঞ্চদশ সংশোধনীর সবচাইতে বড় সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। আর এই সংশোধনীগুলো সহ সংবিধানের ৫৭(৩) অনুচ্ছেদ প্রধানমন্ত্রীকে একচ্ছত্র ক্ষমতার মালিক করে দিয়েছে- যার ফলে সংকট আরো ঘনীভূত হয়েছে। কারণ এই ৫৭(৩) অনুচ্ছেদ প্রধানমন্ত্রীকে এতো ক্ষমতা দিয়েছে যে তার সময়কালীন সময়ে তার পরবর্তী সাকসেসর তার অফিসে প্রবেশ না করা পর্যন্ত- এমন ক্ষমতা মূলত শেখ হাসিনাকে পৃথিবীর সবচাইতে ক্ষমতাশালী এক শাসকে পরিণত করেছে।
তিনি সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করে বলেন প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় থাকলে, পার্লামেন্ট যদি সেই সময় নাও থাকে, তারপরেও প্রধানমন্ত্রী ১০-১৫জন অসাংবিধানিক ও অনির্বাচিত উপদেষ্টা নিয়োগের মাধ্যমে দেশে তার শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে পারবেন। আর এভাবেই প্রধানমন্ত্রী আগামী ২০৪১ সাল পর্যন্ত দেশে তার একচ্ছত্র ক্ষমতা ধরে রাখতে বা ক্ষমতায় থাকতে চান।
ডঃ তুহিন মালিক বর্তমান সংসদে লেজিটিমেইট বিরোধীদলের অনুপস্থিতি উল্লেখ করে সর্বশেষ বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, রাজনৈতিক সংকট এখন আন্তর্জাতিক এক ইস্যু হিসেবে পরিগণিত। ডেভেলপম্যান্ট পার্টনার্স, আন্তর্জাতিক এজেন্সি সমূহ এখন বাংলাদেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে বেশী কনসার্ণ এবং তিনি আহ্বান জানান, আমাদের উন্নয়ন সহযোগী, আন্তর্জাতিক সকল সংস্থা সমূহকে বাংলাদেশে প্রকৃত গণতন্ত্র এবং গুড-গভর্ণন্যান্সের লক্ষে রাজনৈতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের জন্য এগিয়ে আসবেন, সহযোগিতা করার আহবান জানান।
সেমিনারে ব্যারোনেস পলা মঞ্জিলা উদ্দিনও গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সরকার অব্যাহত, মানবাধিকারের উন্নতি ও জবাবদিহিমূলক সরকারের জোর দাবী এবং সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের তাগিদ দেন।
এই সেমিনারে আর ও উপস্থিত ছিলেন, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, শমসের মবিন চৌধুরী, মাহিদুর রহমান, মুফতি সদর উদ্দিন, প্রফেসর সালেহ আহমেদ, প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন, ব্যারিস্টার এম এ সালাম, ব্যারিস্টার নজরুল ইসলাম, মাওলানা শুয়েব, ডক্টর মাহদী আমিন, শাহ আক্তার হোসেন টুটুল, আক্তার হোসেন, কবির আহমেদ আয়ারল্যান্ড, জাহিদ মমিন চৌধুরী আয়ারল্যান্ড, এম এ জলিল খান স্পেন, মাসুদ আহসান স্পেন, লকিত উল্লাহ ইতালি, আবুল হোসেন ইতালি, জাহাংগীর আলম ইতালি, শরিফ উদ্দিন হল্যান্ড, আশিকুর রহমান, শরিফুজ্জামান তপন, নাসিম আহমেদ চৌধুরী, ডক্টর মুজিব, গোলাম জাকারিয়া, আবেদ রাজা,কামাল উদ্দিন, শামসুর রহমান মাহতাব, রহিম উদ্দিন, শফিকুল ইসলাম রিবলু, জুল আফরোজ মজুমদার, মনির আহমেদ, শহীদুল ইসলাম মিরাজ, ইমতিয়াজ এনাম তানিম, ফাহমিদা মজিদ ওষা প্রমুখ।