দেশের অন্যতম দুই খনিজসম্পদ সমৃদ্ধ এলাকায় সামরিক শক্তি বাড়ানোর ওপর অগ্রাধিকার দিয়ে প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়ন করছে সরকার। দক্ষিণাঞ্চলের গ্যাস এবং উত্তরাঞ্চলের কয়লা সম্পদের সুরক্ষার কথা ভেবে এই নীতিমালা করা হচ্ছে।
দেশের অন্যতম দুই খনিজসম্পদ সমৃদ্ধ এলাকায় সামরিক শক্তি বাড়ানোর ওপর অগ্রাধিকার দিয়ে প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়ন করছে সরকার। দক্ষিণাঞ্চলের গ্যাস এবং উত্তরাঞ্চলের কয়লা সম্পদের সুরক্ষার কথা ভেবে এই নীতিমালা করা হচ্ছে।
অন্যতম এ দুই প্রাকৃতিক সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিরক্ষা নীতিতে দেশের এই অঞ্চলের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে সামরিক শক্তি বাড়ানোর বিধানটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইতিমধ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি খসড়া তৈরির কাজ শেষ করেছে। খসড়াটি শিগগিরই অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো হবে। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পরে এ খসড়া মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। খবর বিশ্বস্ত সূত্রের।উত্তর-দক্ষিণে সামরিক শক্তি বাড়ানো হচ্ছে
খসড়া নীতিতে বলা হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সশস্ত্র বাহিনী হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। তবে যে কোনো সংকটময় মুহূর্তে নির্বাচিত সরকারকে দেশ পরিচালনায় সহযোগিতা করবে। যদিও সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, কেউ জোর করে ক্ষমতা গ্রহণ করে সংবিধান স্থগিত করলে পরে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে বিচারকরা যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করতে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে এ নীতি প্রণয়ন করা হচ্ছে। নীতিতে দেশের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত এলাকাও চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা জোরালো করার সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে এ নীতিতে।
জানা গেছে, দেশে এবারই প্রথম প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়ন করা হচ্ছে। গত ১৯৯১ সালে প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় সরকার। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তা আলোর মুখ দেখেনি। প্রায় ২১ বছর ধরে প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তা আর চূড়ান্ত রূপ পায়নি। গত মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আবার প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। নীতির খসড়া তৈরিতে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, অর্থ ও আইন এই চার মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়।
পাশাপাশি মহাজোট সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিও প্রায় দেড় বছর ধরে প্রতিরক্ষা নীতি নিয়ে কয়েকটি বৈঠক করে। তারাও প্রতিরক্ষা নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করতে কয়েকটি সুপারিশ করে। তাদের সুপারিশ ও দেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি নীতির খসড়া তৈরি করেছে। পরে এটি অনুমোদনে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পাঠালে সেটি চুলচেরা বিশ্লেষণের জন্য ফেরত আসে। এর মধ্যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতির পদটি পরিবর্তন হয়।
কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত এমপি সাবেক সেনা কর্মকর্তা সুবিদ আলী ভুঁইয়াকে দশম জাতীয় সংসদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি করা হয়। এ কমিটি প্রতিরক্ষা নীতি নিয়ে কয়েকটি বৈঠক করে। তারা এ বিষয়ে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সুপারিশ নেয়। এর মধ্যে নবম সংসদের বিরোধীদলীয় সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ লিখিতভাবে তাদের সুপারিশ দেন। ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার তার পরামর্শে পেশাদার সৈনিক সমন্বয়ে আধুনিক অস্ত্রসংবলিত শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
এইচএম এরশাদ তার সুপারিশে বলেন, আক্রান্ত হলে যাতে অন্তত ২১ দিন শত্রুর সঙ্গে লড়াই করা সম্ভব হয়, এমন শক্তিসম্পন্ন প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, কেউই স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু নয়। এই ধারণার ভিত্তিতে প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তোলার নীতি প্রণয়ন করা যেতে পারে। কমিটির সাবেক সভাপতি এম ইদ্রিস আলী তার সুপারিশে বলেন, বাংলাদেশে বহিঃশত্রু অপেক্ষা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিষয়ক হুমকিগুলো অধিকতর বাস্তব ও তা মোকাবেলা করা কম জরুরি নয়। প্রতিরক্ষা নীতিতে এ হুমকিগুলো যথাসম্ভব চিহ্নিত করে তা প্রতিহত করার দিকনির্দেশনা থাকতে হবে।
প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা নীতিতে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রোধে সামরিক বাহিনীর জোরালো ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে, প্রতিবেশী দেশসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক না করে নিজেদের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রেখে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বিদেশি প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সহায়তা করতে পারবে সামরিক বাহিনী। পাশাপাশি সরকার চাইলে যে কোনো সময়ে দেশের ভেতরে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে তারা।
এ নীতিতে দেশে আরও ক্যাডেট কলেজ স্থাপন করে সামরিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছে। দেশে কখনও যুদ্ধ বা অন্য কোনো জরুরি প্রয়োজনে এসব ক্যাডেট ও সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়া লোকজনকে কাজে লাগানোর বিধান রাখা হয়েছে। পাশাপাশি সবকিছু যাচাই-বাছাই করে কিছু যুবককে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে, এ নীতিতে সংকটময় মুহূর্তে এ যুবকরা যাতে সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করতে পারে। এ ছাড়া পুলিশ, বিজিবিসহ সরকারি চাকরিক্ষেত্রে ছয় মাসের সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়েছে খসড়া নীতিমালায়।
নীতিতে বিএনসিসিসহ সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাধারণ লোকজনকে সরকারি চাকরিক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়টিও বলা হয়েছে। দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সামরিক বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করার বিধান রাখা হয়েছে নীতিতে। এক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর জন্য আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সমরাস্ত্র আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি সার্বভৌমত্ব রক্ষাসহ দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে সেনাবাহিনীর বিশেষ কমান্ডো ইউনিট আরও বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুবিদ আলী ভুঁইয়া বলেন, তিন বাহিনীর ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা আছে। পাশাপাশি তিন বাহিনীর রয়েছে ফোর্সেস গোল। এ সবকিছু দেখে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সংসদীয় কমিটি সুপারিশ প্রণয়ন করেছে।