যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানানোয় খালেদা জিয়াকে ‘সব থেকে বড় দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে বিএনপি ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে না আসায় ‘ইতিবাচক’ হিসেবে দেখছেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘বিএনপি সংসদে না থাকায় এক অর্থে ভালোই হয়েছে। পার্লামেন্টে এখন খিস্তি-খেউড় শোনা যায় না। সংসদ ভদ্রভাবে চলছে, ভালোভাবে চলছে। সংসদের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে এসেছে।
শনিবার হবিগঞ্জের নিউফিল্ডে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কথা বলেন। জনসভাস্থলে পৌঁছে প্রধানমন্ত্রী হবিগঞ্জ আধুনিক স্টেডিয়াম, ডায়বেটিস হাসপাতাল, নার্সিং ইনস্টিটিউট, জেলা পরিষদ অডিটরিয়াম, শিল্পকলা একাডেমি ভবন, হবিগঞ্জ সার্ভার স্টেশন, আলেয়া জাহির কলেজ, আনসার ও ভিডিপির জেলা কমানডেন্টের অফিস ভবনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এর আগে তিনি সকালে নবীগঞ্জ উপজেলার বিবিয়ানা গ্যাস সম্প্রসারণ প্রকল্প, বিবিয়ানা-ধনুয়া ৩৬ ইঞ্চি বিশিষ্ট উচ্চ চাপ গ্যাস পাইপ সঞ্চালন লাইন, ৩৪১ মেগাওয়াট বিবিয়ানা গ্যাস বিদ্যুত্ প্লান্ট, ঢাকা সিলেট মহাসড়ক হতে বিবিয়ানা পাওয়ার প্ল্যান্ট সংযোগ সড়ক, বানিয়াচঙ্গ ও নবীগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের উদ্বোধন করেন। এছাড়া তিনি শাহজীবাজার ৩৬০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল প্ল্যান্ট, বিবিয়ানা-১ ও বিবিয়ানা-২ নামে যথাক্রমে ৩৮৩ ও ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ প্লান্ট, বিজনা ব্রিজ, রসুলগঞ্জ-রইছগঞ্জ-পানিউমদা রাস্তায় একটি ব্রিজের ও আজমিরিগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
জনসভায় শেখ হাসিনা অভিযোগ করেন, ‘জামায়াত আর বিএনপি নির্বাচন বন্ধ করতে এক হয়ে ধর্মের নামে মসজিদে আগুন দেয়। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের কোরআন শরিফের দোকানে আগুন দেয়। বাস, রেলে আগুন দিয়েছে। প্রাইভেট কার থেকে মানুষ নামিয়ে তার গায়ে আগুন দিয়েছে। নির্বাচন বন্ধ করতে সহিংস অবস্থা সৃষ্টি করেছিল।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন বন্ধ করলে কী হতো। ওই থাইল্যান্ডের দিকে তাকান। বিরোধী দল আন্দোলন করে সরকার হটানোয় এখন সেখানে মার্শাল ল জারি হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, বাস্তবায়িত হচ্ছে রায়। সেই সব যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে পতাকা তুলে দিয়েছিলেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। বেইমানি করেছিলেন লাখো শহীদের সঙ্গে। এ অপরাধে একদিন জনতার আদালতে খালেদা জিয়ারও বিচার হবে।’
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যের শুরুতেই হবিগঞ্জে গ্রেনেড হামলায় নিহত সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে স্মরণ করে বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ করে দোষীদের শাস্তি দেয়া হবে।
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দেশে শান্তি থাকে, মানুষও শান্তিতে থাকে। আর বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে দেশের জন্য কিছু না করে সন্ত্রাস, দুর্নীতি করে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে মানুষ বলত বিএনপির দুই গুণ— সন্ত্রাস আর মানুষ খুন। আর আওয়ামী লীগ মানে উন্নয়ন।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের তথাকথিত ‘‘উন্নয়নের জোয়ারে” সারাদেশে বিদ্যুত্-গ্যাসের উত্পাদন কমে গিয়েছিল। দেশব্যাপী একযোগে বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছিল। এই সিলেট অঞ্চলেও বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপরেও বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে।’
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, ‘বিএনপির সময় গ্রেনেড-বোমা হামলা, দুর্নীতি, মানি লন্ডারিং, সন্ত্রাসের উন্নয়ন হয়েছে। খালেদা জিয়া ও বিএনপি নেতারা নিজেদের উন্নয়ন নিয়ে ব্যস্ত ছিল, ফলে তাদের নিজেদের উন্নয়ন হয়েছে।’ তিনি এ সময় উপস্থিত জনগণকে প্রশ্ন করেন- ‘যারা এতিমদের টাকা মেরে খায়, তারা কীভাবে দেশের উন্নয়ন করবে?।’
দেশের অর্থনীতির পরিবর্তনের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপির সময় দিনমজুররা তাদের দৈনিক উপার্জন দিয়ে একবেলার খাবার কিনতে পারত না। আল্লাহর রহমতে আজকে একজন দিনমজুর বা রিকশাওয়ালা দিনশেষে যে টাকা জমা করে, তা দিয়ে খাবার কিনেও অনেক টাকা হাতে থাকে।’
প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার গড়ে তোলা এবং এর মাধ্যমে দেশ ও বিদেশ থেকে অর্থ উপার্জনের চিত্রও তুলে ধরেন তিনি। আওয়ামী লীগ আমলে হবিগঞ্জের বিভিন্ন উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘হবিগঞ্জে ব্যাপক উন্নয়নের কাজ আমরা করে দিয়েছি। আরও উন্নয়নের কাজ আমরা করে দেব। আগামীতে হবিগঞ্জে মেডিকেল কলেজ করে দেয়া হবে। শায়েস্তাগঞ্জকে আমরা উপজেলায় উন্নীত করে দেব।’ এখানে স্থানীয় যে গ্যাস ও বিদ্যুত্ উত্পাদন হচ্ছে, তা থেকে এলাকাবাসীদের দেয়ার জন্য ইতিমধ্যেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
জনসভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও হবিগঞ্জ-৩ (হবিগঞ্জ সদর-লাখাই) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আবু জাহির। সভা পরিচালনা করেন জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, হবিগঞ্জ-২ (বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আব্দুল মজিদ খান ও যুগ্ম সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবুল ফজল।
সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন জেলা আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক সম্পাদক জাকির হোসেন চৌধুরী অসীম, যুগ্ম সম্পাদক মর্তুজা হাসান, মর্তুজ আলী, সাংগঠনিক সম্পাদক মশিউর রহমান শামীম, হবিগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোটে নিলাদ্রী শেখর পুর কায়স্থ টিটো, জেলা শ্রমিক লীগ সাধারণ সম্পাদক ফরিদ আহমেদ রাজু, জেলা কৃষক লীগ সভাপতি হুমায়ূন কবির রেজা, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি কামরুল হাসান, জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি ডা. ইসতিয়াজ রাজ চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান।
মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ, হবিগঞ্জ-৪ (মাধবপুর-চুনারুঘাট) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী, কেন্দ্রীয় যুবলীগ সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ প্রমুখ।
বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র সম্প্রসারণ প্রকল্প উদ্বোধন : এর আগে শনিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুটি প্রকল্পের উদ্বোধনসহ বেশকিছু প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রকল্পগুলো উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘এসব প্রকল্প গ্যাসের দেশীয় চাহিদা ও সরবরাহের ব্যবধান কমাবে। বিদ্যুত্ ও গ্যাস উত্পাদন ব্যয়সাপেক্ষ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী ভবিষ্যতের জ্বালানি নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় জাতীয় এসব সম্পদের পরিমিত ব্যবহার করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।
এসব প্রকল্প দ্রুত ও যথাযথভাবে বাস্তবায়নে পেট্রোবাংলা, জিটিসিএল ও শ্যাভরনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী আশা করেন, ভবিষ্যতে শ্যাভরনসহ অন্য আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলো বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশের সুযোগ গ্রহণে এগিয়ে আসবে।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী, জ্বালানি, বিদ্যুত্ ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, জ্বালানি, বিদ্যুত্ ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান এম তাজুল ইসলাম, স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুল মুনিম চৌধুরী, জ্বালানি সচিব আবু বকর সিদ্দিক, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ইশতিয়াক আহমেদ, শ্যাভরনের এশিয়ার প্যাসিফিকের প্রেসিডেন্ট মেলোদি মেয়ের এবং শ্যাভরন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জিয়ফ স্ট্রং বক্তৃতা দেন।
এছাড়া অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী এ কে এম মোজাম্মেল হক, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন সিকদার ও প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব একেএম শামীম চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।