কিছু কিছু ঘটনায় মাস, বছর পার হয়ে তদন্ত প্রক্রিয়া গড়িয়েছে অর্ধযুগ পর্যন্ত,তার পরও কোন কূলকিনারা হয়নি আজ পর্যন্ত।অথচ বিরোধী দল দমনে পুলিশের আন্তরিকতার কোন অভাব কখনও লক্ষ্য করা যায় না।
দেশব্যাপী আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর বেশ কিছু মামলার তদন্ত থমকে আছে। সুনির্দিষ্ট ক্লু না পাওয়ায় সন্দেহের মধ্যে কার্যত বন্দি এসব মামলার পুলিশি কার্যক্রম। কিছু ঘটনায় মাস, বছর পার হয়ে তদন্ত প্রক্রিয়া গড়িয়েছে অর্ধযুগ পর্যন্ত। একাধিক দফায় পাল্টায় তদন্ত কর্মকর্তা, পরিবর্তন হয় তদন্ত সংস্থাও; তবু মামলার তদন্ত আলোর মুখ দেখে না। অনেক মামলায় আদালতের নির্দেশে তদন্ত সংস্থা পরিবর্তন করেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। কিছু ক্ষেত্রে তদন্তের 'সাফল্য' বলতে সন্দেহভাজন হিসেবে 'আসামি' গ্রেফতার। 'সন্দেহে' ঘুরপাক তদন্ত
তদন্ত ঝিমিয়ে পড়া চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য গণতন্ত্রী পার্টির সাবেক সভাপতি নুরুল ইসলাম, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি, সঙ্গীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ছোট ভাই আহমেদ মিরাজ, গোপীবাগে সিক্স মার্ডার, মাওলানা ফারুকী এবং এমপি হোস্টেলে তরুণী খুন। এমন বাস্তবতায় কোনো মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যেমন হতাশ, তার চেয়েও বেশি হতাশ ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা। জীবদ্দশায় জড়িতদের সাজা দেখে যেতে পারবেন কি-না এমন আশঙ্কাও অনেকের স্বজনের মধ্যে।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চাঞ্চল্যকর মামলার ক্লু উদ্ধারে সাধ্যমতো চেষ্টা করে থাকে। এ ক্ষেত্রে তাদের গাফিলতি নেই। তবে ক্লুলেস অনেক ঘটনায় তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন হতে কিছু বাড়তি সময় প্রয়োজন। মালয়েশিয়ার বিমান নিখোঁজের মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনারও স্পষ্ট ক্লু এখনও পাওয়া যায়নি। তেমনি আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকার পরও অনেক মামলার রহস্যভেদ করা সম্ভব হয়নি। তবে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, যে কোনো ঘটনার পর প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা উচিত। কোনো ঘটনায় নিরপরাধ কেউ ফেঁসে গেলে পরে মূল অপরাধীরা উৎসাহিত হবে। কোনো কোনো হত্যাকাণ্ডের পর র্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে। প্রাথমিক ক্লু ও অন্যান্য তথ্য পাওয়ার পর আসামি গ্রেফতার করা হয়।
ডিবির ডিসি (দক্ষিণ) কৃষ্ণপদ রায় বলেন, অনেক সময় শুরুতে কিছু মামলার সূত্র থাকে না। তাই সংগত কারণেই ওই মামলার তদন্ত শেষ হতে কিছুটা সময় লাগে। তবে এটাও ঠিক, খুব অল্প সময়ে অনেক চাঞ্চল্যকর মামলার রহস্য উদ্ঘাটন করা হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে- ২০১৩ সালে সারাদেশে হত্যা মামলা হয়েছে চার হাজার ৩৯৩টি। ২০১২ সালে হত্যা মামলা হয় চার হাজার ১১৪টি। চলতি বছরের ৩০ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে হত্যা মামলা হয়েছে ২ হাজার ৬৫৫টি। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, জানুয়ারিতে ৪০৩টি, ফেব্রুয়ারিতে ৩২৮টি, মার্চে ৩৬৯টি, এপ্রিলে ৪০১টি ও আগস্টে ৩৯২টি হত্যা মামলা হয়েছে।
নুরুল ইসলামের মৃত্যুরহস্যের জট খোলেনি ছয় বছরেও :গণতন্ত্রী পার্টির সাবেক সভাপতি নুরুল ইসলাম ও তার ছেলে ইসলাম তমোহরের মৃত্যুরহস্য দীর্ঘ ছয় বছরেও উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে মামলা থানা পুলিশ থেকে সিআইডিতে, পরে সেখান থেকে র্যাবে স্থানান্তর করা হয়। র্যাব থেকে ঘুরে এখন মামলার তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
রাজধানীর লালমাটিয়ার বাসায় ২০০৮ সালের ৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে রহস্যজনক আগুনে পুড়ে মারা যান ইসলাম তমোহর। গুরুতর দগ্ধ নুরুল ইসলাম চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরদিন বিকেলে মৃত্যুবরণ করেন। এ সময় নুরুল ইসলামের স্ত্রী রুবী রহমান ও তার মেয়ে মৌটুসী ইসলাম সেখানে ছিলেন না। ৬ ডিসেম্বর এ ব্যাপারে মোহাম্মদপুর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়।
মিরাজ হত্যাকাণ্ড: ২০১৩ সালের ৯ মার্চ রাতে রাজধানীর খিলক্ষেত থানার অদূরে রেললাইনের পাশ থেকে আহমেদ মিরাজের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তিনি সুরকার ও গীতিকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ছোট ভাই। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে তার দুই ঠোঁটের ভেতরে, মাথার পেছনে এবং বুকের ভেতরে রক্ত জমাট বাঁধার আলামত পাওয়া যায়। তার নাকও ছিল ভাঙা। মিরাজকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল যুদ্ধাপরাধ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের একজন সাক্ষী। ছোট ভাইয়ের এমন মৃত্যুর পর চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। তবে ঘটনার পৌনে দুই বছরেও সেই হত্যারহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের মামলাটি খিলক্ষেত থানা ও ডিবি পুলিশের হাত ঘুরে এখন তদন্ত করছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির ইন্সপেক্টর রেজাউল করিম সমকালকে বলেন, গুরুত্ব দিয়ে মামলাটি তদন্ত চলছে। তবে এখনও উল্লেখ করার মতো ক্লু পাওয়া যায়নি।
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড: ২০১২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় নির্মমভাবে খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং তার স্ত্রী এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি। চাঞ্চল্যকর সেই খুনের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা দেন- ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের গ্রেফতার করা হবে। প্রায় পৌনে তিন বছর পেরিয়ে গেলেও খুনি কারা, কেন খুন- এ ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।
সাগর-রুনি হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার হওয়া আটজন বর্তমানে কারাবন্দি। তারা হলেন- রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মো. সাঈদ, মিন্টু, কামরুল হাসান ওরফে অরুণ, সাগর-রুনির ভাড়া বাসার নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পাল এবং সাংবাদিক দম্পতির বন্ধু তানভীর রহমান ও নিরাপত্তা কর্মী এনামুল।
গোপীবাগে ছয় খুন: ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর গোপীবাগের ৬৪/৬ নম্বর বাড়ির দোতলায় খুন হন কথিত পীর লুৎফর রহমান ফারুক, তার বড় ছেলে সারোয়ার ইসলাম ফারুক ওরফে মনি, লুৎফরের অনুসারী মঞ্জুরুল আলম, মো. রাসেল, মো. শাহিন এবং মজিবুর সরকার। এ ঘটনায় লুৎফর রহমানের বেঁচে থাকা ছোট ছেলে আবদুল্লাহ আল ফারুক অজ্ঞাতপরিচয় ১০-১২ জনকে আসামি করে ওয়ারী থানায় একটি মামলা করেন। আসামিরা অনুসারী বেশে বাসায় ঢুকে পরিকল্পিতভাবে ছয়জনকে খুন করে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়। খোদ রাজধানীতে বাসায় ঢুকে ছয়জনকে হত্যাকাণ্ডের এমন চাঞ্চল্যকর ঘটনার এক বছর পার হতে চলল। তবে খুনি কারা, কেন খুন তা স্পষ্ট হয়নি এখনও। প্রথম থেকে জঙ্গিদের দিকে সন্দেহের তীর থাকলেও মূল আসামিরা এখনও গ্রেফতার হয়নি।
ছয় খুনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবুল খায়ের মাতুব্বর বলেন, এখন পর্যন্ত হত্যায় জড়িত সন্দেহে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির পাঁচ জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। সে অনুযায়ী তদন্ত চলছে।
এমপি হোস্টেলে তরুণীর লাশ, খুনিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে: ২০১২ সালের ২২ এপ্রিল রাতে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় এমপি হোস্টেল থেকে উদ্ধার করা হয় অজ্ঞাতপরিচয় এক তরুণীর মরদেহ। মরদেহটি এমপি হোস্টেলের ৭ নম্বর গেটের ৬ নম্বর ব্লকের একটি ভবনের তিনতলার সিঁড়ির পাশে পড়ে ছিল। লাশের গায়ে কালো-নীল-লাল রঙের জামা ও হলুদ রঙের পায়জামা ছিল। তবে আড়াই বছরেও পুলিশ সেই তরুণীর পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি। কঠোর নিরাপত্তায় ঘেরা এমপি হোস্টেলে অজ্ঞাতপরিচয় ওই তরুণী কীভাবে গেল, তাকে কারা খুন করল সে রহস্য উদ্ঘাটন হয়নি আজও। সর্বশেষ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, থানা পুলিশ হয়ে ডিবি তদন্ত করে এই মামলা। রহস্য উদ্ঘাটন না করে আদালতে দেওয়া হয় ফাইনাল রিপোর্ট।
মাওলানা ফারুকী হত্যা: চলতি বছরের ২৭ আগস্ট রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের বাসায় গলা কেটে হত্যা করা হয় বেসরকারি টিভি চ্যানেলের ইসলামী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে। তিনি ইসলামী ফ্রন্টের সভাপতিম লীর সদস্য ছাড়াও আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। তবে তিন মাসেও স্পষ্ট হয়নি ফারুকীকে কেন খুন করা হয়েছে, কারা খুন করেছে? অবশ্য ডিবি পুলিশ ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে দু'জনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়। এরপর গত ৮ নভেম্বর ওই মামলায় 'নির্দেশদাতা' আসামি হিসেবে গ্রেফতার করা হয় উগ্র সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের আধ্যাত্মিক নেতা মোজাফফর বিন মহসীনকে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও হত্যাকারী কারা তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। একই মাসে রাজধানীর রামপুরায় পুলিশের হ্যান্ডকাফ পরা এক গাড়িচালকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। তবে ওই হত্যার ক্লু বের হয়নি।
স্বজনের বক্তব্য: মেহেরুন রুনির মেজভাই নওশেদ আলম বলেন, খুনিরা শনাক্ত না হওয়ায় পরিবারের সবাই হতাশ। সিক্স মার্ডারের ঘটনায় কথিত পীরের ছেলে আবদুল্লাহ আল ফারুক সমকালকে বলেন, তারা এখন অজানা ভয়ে আত্মগোপনে আছেন। আসামিরা গ্রেফতার না হওয়ায় তাদের আতঙ্ক বাড়ছে। নুরুল ইসলামের মেয়ে মৌটুসী ইসলাম বলেন, একটির পর একটি সংস্থা তদন্ত করছে। কিন্তু প্রকৃত সত্য উঠে আসছে না।
সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, হত্যাকাণ্ড ঘটেছে; কিন্তু দোষীদের শনাক্ত করা যায়নি। অথচ ডিবি শুরু থেকে অন্যরা 'দুর্ঘটনা' ধরে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল বলেন,'বিশ্বাস ছিল আমার কর্মকাণ্ডে শ্রদ্ধা দেখিয়ে মামলাটির তদন্তে পুলিশ আরও দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসবে। যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে আমি নিজে উপস্থিত থেকে সাক্ষী দিয়েছি। অথচ সরকার আমার ভাইয়ের খুনিদের শনাক্ত করতে পারেনি। আমার বুকে কষ্ট লুকিয়ে আছে। ফারুকীর ছেলে ফয়সাল ফারুকী বলেন, তদন্তের ধীরগতিতে হতাশ। তবে উগ্রপন্থিরা এই হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারে বলে মনে হচ্ছে।