আগামী আন্দোলন এবং সফলতা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। এজন্য দলের হাইকমান্ড থেকে শুরু করে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঝে আগামী আন্দোলনকে সামনে রেখে এখনই চলছে প্রাক প্রস্তুতি। শুধু নেতাদের নির্দেশনার ওপর নির্ভর না করে নিজেদেরকে গুছিয়ে নিচ্ছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা। এজন্য তারা দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার যে কোনো দিকনির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছেন বলে জানা গেছে।
আগামী আন্দোলনের জন্য মুখিয়ে থাকা নেতাকর্মীদের সঙ্গে লন্ডনে চিকিৎসাধীন দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিভিন্ন উপায়ে যোগাযোগ হচ্ছে বলে দলীয় সূত্র জানায়। তিনি দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের যে কোনো কর্মসূচির জন্য প্রস্তুত রাখতে কাজ করছেন বলে সূত্র নিশ্চিত করে।
জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যেও একধরনের প্রশস্তি বিরাজ করছে। তারাও মনে করছে, আগামী আন্দোলনে তাদের শতভাগ সফলতা নিশ্চিত। এ জন্য তারাও নিজ নিজ দলের ব্যানারে আন্দোলনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীসহ অনেক অঞ্চলভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সর্বাত্মক শক্তি ও সামর্থ্য নিয়ে কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য অপেক্ষা করছে।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দলকে সংগঠিত করতে এবং আগামী আন্দোলনকে চূড়ান্তরূপ দিতে বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক এবং দেশব্যাপী গণসংযোগের অংশ হিসেবে ধারাবাহিক জনসভাকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা। এছাড়া বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ডকেও তারা দলের জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, সরকারের জনপ্রিয়তা এখন শূন্যের কোঠায়। জনগণ এখন এই সরকারের ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আগামী আন্দোলনের ডাক দেয়া হলে শুধু দলের নেতাকর্মী নয়, সাধারণ জনগণও ওই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হবে।
এসব বিষয়ে এক নেতা বলেন, মানুষের মৌলিক অধিকারের চেয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে গণতন্ত্রের প্রয়োজন তার জন্য আন্দোলন করছে বিএনপি। তাও সেটা চার দেয়ালের ভেতরে। এমন পরিস্থিতি সামনে রেখে দলীয় চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন।
বিভাগীয় পর্যায়ের নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধি, দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম, জোট এবং সর্বশেষ দেশের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। পাশাপাশি তিনি দেশব্যাপী গণসংযোগ কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন, যা নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে এক ধরনের টনিক হিসেবে কাজ করেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, দলের হাইকমান্ড বিগত সময়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক বিচক্ষণতা দেখাতে সক্ষম না হলেও সম্প্রতি প্রত্যেকটি কর্মকাণ্ডে ইতিবাচক এবং সফলভাবে সক্ষম হচ্ছে। যার কারণে সরকারের ফাঁদে পা না ফেলে একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পেরেছে, যা দল ও গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক।
তবে ভিন্ন মত প্রকাশ করে বিএনপির এক নেতা জানান, তৃণমূলে বিএনপির নেতাকর্মীরা ব্যবসা-বাণিজ্য, ঘরবাড়ি, চাকরিসহ জীবন পর্যন্ত দিয়েছে; কিন্তু আপনার দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের গায়ে কোনো আঁচড়ও লাগেনি। যদিও মামলার জালে জড়ানো হয়েছে। কর্মসূচি দেয়া হলে আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকায় তার বাস্তবায়ন গত ৬ বছরে ছিল না, এখনো নেই। বক্তৃতা, বিবৃতিনির্ভর হয়ে পড়েছে সংগঠন।
এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। যারা ত্যাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ তাদের মূল্যায়ন করতে হবে। আর যারা শূন্য থেকে কোটি কোটি টাকা ব্যাংকে, শত শত ফ্ল্যাটের মালিক বনে গেছেন তাদের দিয়ে সেই নব্বইয়ের মতো ত্যাগ পাবেন এটা আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না। তাই আগামীতে যোগ্য ও দক্ষ নেতাদের হাতে সংগঠনের দায়িত্বভার তুলে দেয়ার মনোভাব তৈরি করার পক্ষেও তিনি মত প্রকাশ করেন।
বিএনপি দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া সরকার পতন আন্দোলনে এবার কঠোর ভূমিকা পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সে মতে, দলীয় নেতাকর্মীদেরও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। বিগত আন্দোলনে বিএনপির যেসব নেতা হাত-পা গুটিয়ে ঘরের কোণে বসে ছিলেন কিংবা আন্দোলনের ডাক দিয়ে রাজপথ থেকে গা-ঢাকা দিয়েছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে এবার কঠোর হচ্ছেন তিনি। এছাড়া যারা সরকারের সঙ্গে গোপন আঁতাত করে মুখে আন্দোলন আর ভেতরে ভেতরে ম্যানেজ হয়ে চলেছেন, তাদের ব্যাপারেও নিয়েছেন সতর্ক অবস্থান। ফলে এবার আর কাউকে কোনো অজুহাতে ছাড় দিতে রাজি নন বিএনপি প্রধান।
অপরদিকে এবার তিনি নিজেই রাজপথে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। সম্প্রতি বিভিন্ন জনসভায় তিনি উল্লেখ করেছেন, আগামী আন্দোলনে তিনি সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দেবেন। তার এই ঘোষণার পর দলের হাইকমান্ড থেকে শুরু করে তৃণমূল নেতাকর্মীরা আরো বেশি উজ্জীবিত হয়েছেন বলে দলীয় সূত্র জানায়।
বেগম খালেদা জিয়া গত শনিবার কুমিল্লা জেলার জনসভায় সরকার পতন আন্দোলনের সামনে কাতারে থাকার ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, আসুন এককাতারে আন্দোলন করি। আমি সামনে কাতারে থাকব। দেখি পুলিশ কিভাবে গুলি করে। খুব শিগগিরই সরকারে পতন হবে ইন্শাল্লাহ। আওয়ামী লীগকে বর্জন করুন। দেশে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। আমরাই দেশে পরিবর্তন আনব। দলের চেয়ারপার্সনের এমন বক্তব্যের পর নেতাকর্মীদের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন নেতাকর্মীরা। তার এই যুগোপযোগী বক্তব্যকে সাধারণ জনগণও ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছেন বলে তারা জানান।
এদিকে আন্দোলনকে একটি সফল রূপ দেয়ার জন্য দলটির দায়িত্বশীল বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকে নিয়ে একাধিক বৈঠকও করেছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। গত ১০, ১১ ও ১৩ নভেম্বর উপদেষ্টা, ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিব এবং স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। তার আগামী পরিকল্পনার বিষয়গুলো নিয়ে ওইসব বৈঠকে আলোচনাও হয়েছে। বৈঠক করেছেন ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গেও। এ বৈঠকে জাতীয় কোনো ইস্যুকে টার্গেট করে পরবর্তী ইস্যু তৈরি করে সরকার পতনের সর্বাত্মক আন্দোলনের পরিকল্পনা করেছে ২০ দলীয় জোট। আর এই আন্দোলনকে একটি শর্ট টাইম ফ্রেমে করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে।
এ লক্ষ্যে ১৬ ডিসেম্বরের পর সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু এবং জানুয়ারির মধ্যে আওয়ামী লীগকে দাবি মেনে নিতে বাধ্য করিয়ে নির্বাচন আদায় করতে চায় ২০ দলীয় জোট। এ বৈঠকে ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশব্যাপী আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়নি বলে অভিমত প্রকাশ করেন খালেদা জিয়া। এ সময়ে অন্য দলের নেতারাও সহমত প্রকাশ করেন।
খালেদা জিয়া বলেন, ওই আন্দোলনকে কন্টিনিউ করার জন্য আমার দলের নেতারা যেমন আমাকে পরামর্শ দেননি, তেমনি জোটের শীর্ষ নেতারাও পরামর্শ দেননি। এবার আমি নিজে আন্দোলনে মাঠে নামব। আর আপনারা সবাই আমার সঙ্গে থাকবেন। এ সময় সবাই তার পাশে থাকার ব্যাপারে সাড়া দেন। এছাড়া বৈঠকে সরকারবিরোধী আন্দোলনকে চূড়ান্তরূপ দেয়ার জন্য ২০ দলীয় জোটের বাইরে অবস্থানকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত করারও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এ জন্য যার যার অবস্থান থেকে ওইসব দলের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্যও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের আগে রাজধানী ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোতে যথাসম্ভব জনসভা, জনসংযোগের প্রচেষ্টা করা হবে বলেও বৈঠকে আলোচনা করা হয়েছে। তেল-গ্যাস ও বিদ্যুতের মতো জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি সরকারের সিদ্ধান্তের বিপরীতে দেশব্যাপী জনমত সৃষ্টি এবং মূল্য বৃদ্ধি কার্যকর করা হলে হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে বলেও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তেল-গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির মতো জাতীয় ইস্যুতে কঠোর কর্মসূচি দিয়ে এর ধারাবাহিকতায় আন্দোলনকে চূড়ান্তরূপ দেয়ার আলোচনাও হয় এ বৈঠকে।
নিজ দল এবং জোটের রাজনৈতিক নেতারা ছাড়াও আগামী আন্দোলনের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন দেশের বোদ্ধামহল ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা। গত ২৫ নভেম্বর রাতে বিএনপি চেয়ারপার্সনের সঙ্গে এক বৈঠকে মানুষ ও বাস্তবতার নিরিখে আন্দোলনে নামার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এ সময় দেশপ্রেমিক সব শক্তির সমন্বয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তারা। খালেদা জিয়ার নিজ কার্যালয়ে রুদ্ধদ্বার মতবিনিময়কালে যেমন মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন তেমনি নির্দ্বিধায় বলেছেন উপস্থিত ব্যক্তিরা।
বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নেতৃত্ব দেয়া, ভূমিকা রাখা এবং খ্যাতিমান ৪১ ব্যক্তি দীর্ঘ সময়ের এ সভায় অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে ডজন ব্যক্তির বক্তব্যে উঠে আসে বিএনপির অতীতের রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত, দলীয় দর্শন ও আদর্শের অবক্ষয়, সাংগঠনিক দুর্বলতাসহ ভবিষ্যতে করণীয় বেশ কিছু বিষয়। পেশাজীবীদের একজন বলেন, দিনে দিনে মানুষ বিএনপির ওপর হতাশ হচ্ছে।
বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ জিজ্ঞাসা করে আন্দোলন আর কতদূর? আর কী বা কোন ইস্যু নাকের ডগায় এলে দুর্বার আন্দোলনে নামবে বিএনপি? অবশ্যই আন্দোলনের কর্মকৌশল নির্ধারণ করে ধাপে ধাপে তার বাস্তবায়ন করতে হবে বলে পরামর্শ দেন তিনি।
এসব বিষয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, সরকার চোরাবালির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পায়ের তলায় মাটি নেই। আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।