দুর্নীতির সেই বরপুত্ররা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। মহাজোট সরকারের সময় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং এর সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর শীর্ষ তিন পদে থেকে নজিরবিহীন দুর্নীতি করেছেন সাবেক পূর্ত প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান, সচিব ড. খোন্দকার শওকত হোসেন এবং রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নূরুল হুদা। অবৈধ উপায়ে তাদের পাহাড়সম সম্পদের মালিক বনে যাওয়ার তথ্য মিললেও এখনো রয়েছেন তারা বহালতবিয়তে।
উপরন্তু এই তিনজনই নিজেদের রক্ষায় এখন রয়েছেন মহাব্যস্ত। অভিযোগ রয়েছে, এই দুর্নীতিবাজরা নিজেদের নামে-বেনামে, এমনকি পরিবার-পরিজন, আত্দীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের নামেও বরাদ্দ নিয়েছেন অসংখ্য সরকারি প্লট। এ ছাড়া ঘুষ গ্রহণ, আবাসিক ভবনকে বাণিজ্যিক আর বাণিজ্যিক ভবনকে আবাসিক ভবন হিসেবে নকশা অনুমোদন, ছোট প্লট বড় করা, বড় প্লট ছোট করা, নিজস্ব ঠিকাদার নিয়োগ, ক্ষমতার অপব্যবহার, ফাইল গায়েবসহ নানা অপকর্মে জড়িয়েছিলেন একসঙ্গে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপকর্মের তিন শিরোমণি নানা উপায়ে নানা কৌশলে তদবির করছেন। প্রভাবশালীদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। অবিরাম প্রভাব খাটানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। তৎকালীন পূর্তসচিব বর্তমানে প্রবাসীকল্যাণ সচিব ড. শওকতের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তিনটি মামলা হলেও সেসব থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়টিও গোপনে প্রায় চূড়ান্ত হয়েছিল। বিষয়টি ফাঁস হয়ে যাওয়ায় সেই তিনটি মামলায় পুনঃতদন্ত হচ্ছে। তদবির আর প্রভাব খাটিয়ে এরা অপরাধের দায় থেকে এভাবেই নিজেদের রক্ষার চেষ্টা করছেন বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার মূল এই তিন হোতা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় দুর্নীতিবাজরা উৎসাহ পাচ্ছেন। অবিলম্বে এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, ড. শওকতের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেলেও রহস্যজনক কারণে মামলা থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করে তদন্ত প্রতিবেদন কমিশনে জমা দিয়েছিলেন তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা। বিষয়টি কমিশনের কাছে সন্দেহজনক হওয়ায় পুনরায় ড. শওকতের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এবার একজন অভিজ্ঞ কর্মকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এই তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্তে নজিরবিহীন দুর্নীতির তথ্য পেয়ে দুদক কর্মকর্তারাও হতবাক। সাবেক প্রতিমন্ত্রী মান্নান খান, সচিব ড. শওকত এবং রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নূরুল হুদা দুর্নীতি, অনিয়ম আর লুটপাটের এমন কোনো শাখা নেই যে তাদের অবাধ বিচরণ ছিল না। সিন্ডিকেট তৈরি করে প্লট বরাদ্দে অনিয়ম, ঘুষ গ্রহণ, আবাসিক ভবনকে বাণিজ্যিক আর বাণিজ্যিক ভবনকে আবাসিক ভবন হিসেবে নকশা অনুমোদন, ছোট প্লট বড় করা, বড় প্লট ছোট করা, ঠিকাদার নিয়োগে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, নকশা জালিয়াতি, ফাইল গায়েবসহ নানা অপকর্মে সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে তথ্য মিলেছে। দুর্নীতির প্রমাণ মেলায় সাবেক প্রতিমন্ত্রী মান্নান খান ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ১টি করে এবং শওকতের বিরুদ্ধে ৩টি মামলা করেছে দুদক। প্রকৌশলী নূরুল হুদার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে। তার বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে দুদক জানায়।
পূর্ত প্রতিমন্ত্রী মান্নান খানের বিরুদ্ধে ব্যপক দুর্নীতির তথ্য প্রমাণ পেয়েছে দুদক। বেনামে বহু প্লটের মালিক হয়েছেন তিনি। দুদক সূত্র জানায়, পূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালে মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে মান্নান খানের সম্পদ ১০৭ গুণ বেড়েছে। তবে তার গোপন সম্পদের পরিমাণ আরও বেশি বলে দুদকের তদন্তে বেরিয়ে আসে। নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের হিসাবে দেখা যায়, ২০০৮ সালে তার মোট অর্থ-সম্পদ ছিল ১০ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। আর এখন সম্পদের পরিমাণ তার ১১ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি আবাসন কোম্পানি, সরকারি প্লট ও ফ্ল্যাট এবং পরিত্যক্ত জমি দখলের মাধ্যমে বিশাল সম্পদের মালিক হন তিনি। দোহারে তার গ্রামে প্রায় তিন কোটি টাকা খরচ করে আলিশান বাড়ি নির্মাণ করেছেন। এ ছাড়া রাজধানীর ধানমণ্ডি, গুলশান ও মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় সরকারের পরিত্যক্ত সম্পত্তি বিভিন্নভাবে হস্তান্তর করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। সূত্র জানায়, মান্নান খান প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন প্রথম দফায় দোহার-নবাবগঞ্জের প্লটপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ ঢাকা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মরিয়ম মুস্তফা শিমুল পূর্বাচলে তিন কাঠা; দোহারের মো. রাজীব শরীফ, মিজান শরীফ, মাহমুদুর রহমান, শামসুল হক, নজরুল ইসলাম, ফারুক হোসেন চৌধুরী ও পারভেজ পূর্বাচলে যৌথভাবে সাড়ে সাত কাঠার প্লট পেয়েছেন। নবাবগঞ্জ উপজেলার নন্দলাল সিং, পলাশ চৌধুরী, সুবেদুজ্জামান সুবেদ, আলীমোর রহমান খান, মোতাহার হোসেন ও ফজলুল হক যৌথভাবে তিন কাঠার প্লট পান। আবার তার ঘনিষ্ঠ লোক হিসেবে পরিচিত খাদেম আলীকে পূর্বাচল প্রকল্পের ৯ নম্বর সেক্টরের ১০৩ নম্বর রোডের ১০ কাঠা আয়তনের ১৩ নম্বর প্লটটি দেওয়া হয়। জীবিত ব্যক্তিকে মৃত দেখিয়ে প্লট দখল : সূত্রমতে, সচিব শওকত হোসেনের ভয়াবহ জালিয়াতির ভয়ঙ্কর তথ্য বেরিয়ে এসেছে দুদকের তদন্তে। জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে আইনুল হক নামের এক জীবিত ব্যবসায়ীকে মৃত দেখিয়ে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের একটি প্লট দখলে নেন শওকত হোসেন। রাজধানীর উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ৮৬ নম্বরের পাঁচ কাঠার প্লটটিও হাতিয়ে নেন শওকত। নিজের নামে বরাদ্দ পাওয়া তিন কাঠার প্লটের পরিবর্তে তিনি আইনুল হকের পাঁচ কাঠার প্লটটি দখলে নেন। শওকতের নির্দেশেই আইনুলের প্লটটি দখলের জন্য জীবিত আইনুলকে মৃত দেখিয়ে তার ভুয়া ওয়ারিশদের দিয়ে প্লটের মালিকানা দাবি করা এবং আইনুলের প্লটটিকে মাদকসেবীদের আখড়া হিসেবে দেখানো হয়। আবার আইনুলকে সাত দিনের মধ্যে রাজউকে হাজির হওয়ার জন্য তার গ্রামের বাড়ির ঠিকানায় কাগজে-কলমে নোটিসও পাঠানো হয়। কিন্তু সেই চিঠি তার গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়নি। দুদক সূত্রে আরও জানা গেছে, রাজধানীর উত্তরায় শওকত হোসেনের মা জাকিয়া আমজাদের নামে বরাদ্দ নেওয়া তিন কাঠার প্লট ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে পাঁচ কাঠার প্লটে উন্নীত করা হয়েছে। উত্তরা আবাসিক প্রকল্পের ১৪ নম্বর সেক্টরে প্রথমে এক ব্যক্তির লিজপ্রাপ্ত তিন কাঠার প্লট কেনেন শওকত হোসেনের মা। সেটি বিমান উড্ডয়ন জোনের অন্তর্ভুক্ত উল্লেখ করে অন্যত্র পাঁচ কাঠার প্লট বরাদ্দ দিতে জাকিয়া আমজাদ রাজউকে আবেদন করেন। পরে তাকে ১৩ নম্বর সেক্টরে পাঁচ কাঠার একটি প্লট বুঝিয়ে দেওয়া হয়। যদিও রাজউকের বিধি অনুযায়ী, প্লট পরিবর্তন করে উপরের স্তরে বরাদ্দ করার এবং প্লটের আয়তন বাড়ানোর কোনো নিয়ম নেই। এ ছাড়া রাজউক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শওকত হোসেনের স্ত্রী ও ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ আয়েশা খানমের নামে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প এলাকায় বরাদ্দ পাওয়া ৭.৫ কাঠার প্লটের পরিবর্তে ১২ কাঠা ৮ ছটাক আয়তনের প্লট নেওয়ারও তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে দুদক।
নূরুল হুদার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ : দুদক তদন্তে নূরুল হুদার বিরুদ্ধে বেরিয়ে এসেছে নজিরবিহীন সব দুর্নীতির তথ্য। সূত্র জানায়, পূর্বাচল ৯ নম্বর সেক্টরের ১০৩ নম্বর রোডে ১০ কাঠা আয়তনের ১৯ নম্বর প্লটটি নেওয়ার পর তার স্ত্রীর নামেও আরেকটি প্লট নিয়েছেন। প্লট কোড নম্বর (৫৪২১৬)। নিয়ম অনুযায়ী স্বামীর নামে সরকারি প্লট থাকার পর আবার স্ত্রীর নামে প্লট নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নূরুল হুদা সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে প্রভাব বিস্তার করে এ কাজটি করেছেন। গুলশান ৯৩ নম্বর রোডের সিইএন (এ) ১৫/বি প্লটটি রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান নূরুল হুদা নিয়মনীতি না মেনে নিজের একক ক্ষমতা খাটিয়ে আবাসিক থেকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের অনুমতি দেন। নিজেকে সরকারের প্রভাবশালীদের আস্থাভাজন ব্যক্তি উল্লেখ করে নূরুল হুদা রাজউকে অনেকটা একক প্রভাব খাটিয়ে বড় বড় প্রকল্প পছন্দের ব্যবসায়ীদের ভাগ করে দিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০১৪ সালের ৩১ মার্চ ৩ নম্বর বোর্ডসভাটি ছিল নূরুল হুদার দায়িত্বের সর্বশেষ বোর্ডসভা। সে সভার সভাপতি হিসেবে তিনি গুলশান ও পূর্বাচল প্রকল্পে একাধিক প্লট বরাদ্দ দিয়েছেন। বোর্ডসভায় বেশ কয়েকটি প্লট ও খণ্ড জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গুলশান আবাসিক এলাকার ৭১ নম্বর রাস্তা ও ১৫ নম্বর প্লটটির পূর্বপাশে ওয়াকওয়ে সংলগ্ন ১ বিঘা ৩ কাঠা ৩ ছটাক পতিত জমি কন্টিনেন্টাল হাসপাতাল লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেন তিনি। উত্তরা আবাসিক এলাকার ১১ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর রোডের ৫ কাঠা আয়তনের ১৮ নম্বর প্লটের অতিরিক্ত আরও ২ কাঠা ৬ ছটাক খণ্ড জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ফেরদৌস আরা নামের এক নারীর অনুকূলে উত্তরা তৃতীয় প্রকল্প আবাসিক এলাকার ১৬/এইচ নম্বর সেক্টর ১/বি ৩ কাঠার পরিবর্তে ৫ কাঠা বরাদ্দ দেওয়া হয়। জানা যায়, মিসেস রেহেনা নামের একজনের উত্তরা তৃতীয় প্রকল্পের ১৭/এফ সেক্টর ৪/এ তিন কাঠার পরিবর্তে বসবাসযোগ্য উত্তরা ১ম/২য় নিকুঞ্জ (দক্ষিণ) বিকল্প বরাদ্দ দেওয়া হয়। উত্তরা আবাসিক এলাকার ৯ নম্বর সেক্টরে ৫ ও ৬ নম্বর রাস্তাসংলগ্ন খালি জায়গায় ৪ কাঠার প্লট সৃজন করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গুলশান আবাসিক এলাকার গুলশান অ্যাভিনিউ সি ডবি্লউ এস (এ) ১০ এর ২৪ নম্বর রাস্তা সংলগ্ন সি ডবি্লউ এস (এ) ২০ নম্বর প্লটটি একত্রীকরণ করা হয়েছে। শুধু একটি বোর্ডসভায় এসব প্লট ও খণ্ড জমি বরাদ্দ দিয়ে নূরুল হুদা কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।