উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, গণতন্ত্রের মানসপুত্র, আওয়ামী লীগের প্রতিস্ঠাতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ৫১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ । তিনি ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর লেবাননের বৈরুতে একটি হোটেল কক্ষে মারা যান। ঢাকার হাইকোর্টের পাশে তিন নেতার মাজারে তার সমাধি।বাঙ্গালী না হয়েও বাংলা ভাষা ও বাংলাভাষী মানুষের জন্য আজীবন নিরলস ভাবে কাজ করে গেছেন তিনি।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন একাধারে প্রতিভাবান রাজনৈতিক সংগঠক, আইনজ্ঞ, বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভা ও গণপরিষদের সদস্য, অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রীসহ তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর বাঙালির মধ্যে যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল, তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ফল ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে অবিস্মরণীয় বিজয়। গণতান্ত্রিক রীতি ও জনমতের প্রতি সর্বদা শ্রদ্ধাশীল থাকায় সুধী সমাজের কাছে তিনি ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ হিসাবে আখ্যায়িত হন।
তিনি ছিলেন বিচারপতি স্যার জাহিদ সোহরাওয়ার্দীর কনিষ্ঠ সন্তান। তার পিতা জাহিদ সোহরাওয়ার্দী কলকাতা হাইকোর্টের একজন খ্যাতনামা বিচারক ছিলেন। তার পরিবারের সদস্যরা তৎকালীন ভারতবর্ষের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের প্রথা অনুসারে উর্দু ভাষা ব্যবহার করতেন। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী নিজ উদ্যোগে বাংলা ভাষা শিখেন এবং বাংলার চর্চা করেন।
কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষাজীবন শুরু করার পর তিনি ভর্তি হন সেইন্ট জ্যাভিয়ার্স কলেজে। সেখান থেকে বিজ্ঞান বিষয়ে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি ভাষা এবং সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯১৩ সালে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বিজ্ঞান বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। সেখানে তিনি আইন বিষয়েও পড়াশোনা করেন এবং বিসিএল ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯১৮ সালে গ্রেস’ইনহতে বার এট ল ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯১২ সালে কলকাতায় ফিরে এসে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। ১৯২০ সালে তিনি বেগম নেয়াজ ফাতেমাকে বিয়ে করেন। নেয়াজ ফাতেমা ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আবদুর রহিমের কন্যা।
রাজনৈতিক জীবনে প্রথম তিনি যোগদেন চিত্তরঞ্জন দাসের স্বরাজপার্টিতে। এটি ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলের অভ্যন্তরে একটি গ্রুপ। ১৯৪৩ সালে শ্যামা হক মন্ত্রিসভার পদত্যাগের পরে গঠিত খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রীসভায় তিনি শ্রমমন্ত্রী, পৌর সরবরাহ মন্ত্রী ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি সমর্থন এবং সহযোগিতা প্রদান করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যান।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনটির নাম রাখা হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। এর সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
১৯৫৩ সালে তিনি একে ফজলুল হক এবং মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে একত্রে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টির সঙ্গে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। ১৯৫৪ সালের মার্চের আট থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন পায়। এরমধ্যে ১৪৩টি পেয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এদেশের শান্তিপ্রিয় গণতন্ত্রকামী মানুষের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি মুসলিম লীগ সরকারের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেন। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের গণবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তিনি এদেশের জনগণকে সোচ্চার ও সংগঠিত করেছিলেন। ১৯৫৮ সালে ইস্কান্দার মীর্জা পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন। পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে রাষ্ট্রবিরোধী কাজের অপরাধ দেখিয়ে ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি তাকে গ্রেপ্তার করে করাচি সেন্টাল জেলে অন্তরীণ করা হয়। একই বছরের ১৯ আগস্ট তিনি মুক্তি পান। ১৯৬২ সালে তিনি আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনের উদ্দেশ্যে ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) গঠন করেন। তার প্রচেষ্টার ফল হিসাবেই ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হয়।
এছাড়া তিনি ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ থেকে ১১ অক্টোবর ১৯৫৭ পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫৬ সালে চৌধুরী মোহাম্মদ আলির পদত্যাগের পর তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।
১৮৯২ সালে বর্তমান ভারতের মেদিনীপুরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এ মহান নেতা।