প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ধানমণ্ডির রাজনৈতিক কার্যালয় ঘিরে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতার মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। মূলত কার্যালয়টির নিয়ন্ত্রণ নিতে গিয়েই সৃষ্টি হয়েছে এই অবস্থার। দ্ন্দ্ব-সংঘাতে জড়িতরা মনে করেন- যার দখলে বা নিয়ন্ত্রণে থাকবে ধানমণ্ডির কার্যালয়, দল বা সরকারেও তার প্রভাব বজায় থাকবে। আর এটা করতে গিয়ে অবস্থাটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বিরোধে জড়িতদের এক পক্ষ আরেক পক্ষের ছায়া পর্যন্ত মারাতে চান না। তবে এই বিরোধের কথা স্বীকার করতে চান না সংশ্লিষ্টরা।
ধানমণ্ডির কার্যালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে গেলে ছাত্রলীগ ও কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সহ-সম্পাদকদের পদভারে সরগরম হয়ে ওঠে। কিন্তু দলটির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা ওবায়েদুল কাদেরের উপস্থিতির কথা জানলে তারা সেখানে যেতে চান না। দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, বীর বাহাদুর রয়েছেন তাদের মধ্যে।
সেই রকম আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ প্রধানমন্ত্রীর ধানমণ্ডি কার্যালয়ে গেলে দুই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গির কবির নানক ও ডা. দীপু মনি ওই পথ মারাতে চান না।
কার্যালয়টিকে ঘিরে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ ও সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিমের মধ্যেও প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব বিরাজমান। কয়েক মাস আগে এই দুই কেন্দ্রীয় নেতার মধ্যে সিনিয়র নেতাদের সামনেই বাকবিতণ্ডা হয়।
সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে অর্ন্তদ্বন্দ্বের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ। কার্যালয়টিতে তিনি একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন। এ কারণে দলটির সভাপতিমণ্ডলির সদস্য কাজী জাফর উল্ল্যাহ, সতীশ চন্দ্র রায়, সাহারা খাতুন ওই কার্যালয়মুখি হতে চান না।
এমনিতেই দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ ধানমণ্ডির কার্যালয়ে খুব একটা যান না। আবদুস সোবহান গোলাপ কার্যালয়টিকে নিজের করে নেয়ায় এখন সৈয়দ আশরাফ আগে যতটুকু যেতেন এখন ততটুকুও যান না। আব্দুস সোবহান দলের দপ্তরের দায়িত্ব পালন করলেও অন্যদিকে সাবেক মন্ত্রী আব্দুল মান্নান খানকেও এই পদে রাখা হয়েছে। এ নিয়ে প্রায়ই দেখা দেয় বাকবিতণ্ডা।
আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক অ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস ধানণ্ডিতে তেমন একটা আসেন না। সংসদ সদস্যের বাইরে ইদানিং কোনো কাজে থাকে না তার। ড. আবদুস সোবহান গোলাপ থাকলে তিনি এখন আর ধানমণ্ডি কার্যালয়ে ঢোকেন না। এমনও দেখা গেছে, এই রাজনৈতিক কার্যালয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কোনো বৈঠক বা সংবাদ সম্মেলন ডাকা হলে, সেখানে আবদুস সোবহান গোলাপ উপস্থিত থাকলেও তার নাম প্রচার করেন না মৃণাল কান্তি দাস। এ নিয়ে কয়েকবার তর্ক-বিতর্ক করতেও দেখা গেছে তাদের।
সূত্র আরো জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সহ-সম্পাদক পদ দেয়ার দায়িত্ব দেন দলের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য ওবায়দুল কাদের ও ড. আবদুস সোবহান গোলাপকে। প্রথমবার ৬৬ ও দ্বিতীয়বার ৮৮ জনকে নিয়মনীতি মেনে পদ দেয়া হলেও তৃতীয় দফায় ৩১৮ জনকে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই একক সিদ্ধান্তে ২ থেকে ৩ লাখ টাকায় পদ বিক্রির অভিযোগ ওঠে ড. আবদুস সোবহান গোলাপের বিরুদ্ধে। সহ-সম্পাদকদের নিয়ে ড. আবদুস সোবহান গোলাপ একটি ক্যাডার বাহিনী গঠন করেছেন বলেও অভিযোগ করেছেন কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা।
আবদুস সোবহান গোলাপ আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক হওয়ার পর তার সঙ্গে সহকারী হিসেবে দেয়া হয়েছিল কয়েকজন কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সহ-সম্পাদককে। কিন্তু ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তাদের সঙ্গে গোলাপ বিভিন্ন সময় দুর্ব্যবহার করেন। ফলে সহকারীরা এখন আর ধানমণ্ডিতে নিয়মিত আসেন না। উপ-কমিটির সহ-সম্পাদক সিরাজুম মনি টিপু, এমদাদ হাওলাদার, সরদার এম আনোয়ার, সৈয়দা রুবিনা আক্তার মীরা রয়েছেন এই তালিকায়।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয় ধানমণ্ডিতে যা ইচ্ছে তাই হচ্ছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে অর্ন্তদ্বন্দ্ব। তাই এখন আর বেশি যাওয়া হয় না। তারপরেও কোনো বৈঠক থাকলে দলের স্বার্থে যেতে হয়।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ অর্ন্তদ্বন্দ্ব সম্পর্কে অবগত রয়েছেন। কিন্তু তিনি কী আর করতে পারেন। তাদের নিয়েই প্রধানমন্ত্রীকে চলতে হবে।’
গত ৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক কার্যালয়ে এসেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী এ সম্পর্কে সরাসরি কাউকে কিছু না বললেও তিনি ইঙ্গিতে বলেছেন, সবাইকে আরো দায়িত্ববান এবং ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। সংগঠনের শক্তি বাড়াতে হবে। কিন্তু তাতেও নেতারা বুঝতে পারছেন না।
তবে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয় ঘিরে নেতাদের মধ্যে কোনো অর্ন্তদ্বন্দ্ব নেই বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল-আলম হানিফ। তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। আমরা এক সঙ্গে কাউন্সিল করে আসলাম।’
এ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম বলেন, ‘ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নেই। তার কোনো প্রেস কনফারেন্স থাকলে আমি সেখানে উপস্থিত হই।’
এ সম্পর্কে জানতে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদকে কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি একটু ব্যস্ত আছি। পরে কথা বলব।’
যোগাযোগ করা হলে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস বলেন, ‘আসলে যেসব অভিযোগ উঠেছে এটা ঠিক নয়। এক সঙ্গে কাজ করলে ভুলত্রুটি হতেই পারে। আর গোলাপ ভাই যা করছেন তা দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই করছেন।’