ঢাকা ও কাশিমপুরে ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি কয়েদি ও হাজতি থাকলেও দেশের বাকি কারাগারগুলোয় এখন প্রায় ২০ হাজার বন্দির জায়গা ফাঁকা রয়েছে। সম্প্রতি দায়িত্বশীল একটি গোয়েন্দা সংস্থা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিষয়টি সরকারকে অবহিত করেছে। একই সঙ্গে যেসব কারাগারে বন্দির অতিরিক্ত চাপ রয়েছে সেখান থেকে দীর্ঘমেয়াদি সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিকে দেশের ফাঁকা কারাগারগুলোয় স্থানান্তর করা যায় কিনা তা বিবেচনার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।
কারা অধিদপ্তরের দাবি, গত কয়েক মাস ধরে ছোটখাটো মামলা নিষ্পত্তিতে গতি বৃদ্ধির পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক নেতাকর্মী জামিনে মুক্তি পাওয়ায় এ শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি আরো উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, সরকারের বিশেষ নির্দেশনায় ছোটখাটো মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি এবং লঘুঅপরাধে দীর্ঘদিন ধরে কারাবন্দি আসামিদের জামিনে মুক্তি দেয়া হয়েছে। তবে এ শূন্যতা খুব বেশি স্থায়ী হবে না। কেননা সহসাই সারাদেশে ধরপাকড় অভিযান শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে। আর এ উদ্দেশ্যেই কারাগার কিছুটা ফাঁকা করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তারা জানতে পেরেছেন_ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত এবং নানা ইস্যুতে দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে একটি চক্র গোপন তৎপরতা চালাচ্ছে। জামায়াত-শিবিরের পাশাপাশি সরকারবিরোধী একাধিক রাজনৈতিক দল এদের মদদ দিচ্ছে। মৌলবাদী জঙ্গি সংগঠনগুলোও ঝোপ বুঝে কোপ দিতে চাচ্ছে। উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে এ ষড়যন্ত্রের মূল হোতাদের পাশাপাশি মাঠপর্যায়ের সদস্যদের ধরতে সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট যাতে সরকার পতন আন্দোলন বেগবান করতে না পারে এজন্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধরপাকড় অভিযানে নামানো হচ্ছে। বিগত সময়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলায় নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হবে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন।
তাদের এ আশঙ্কা যে অমূলক নয়, মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে তা নিশ্চিত হওয়া গেছে। রাজধানীর একাধিক থানার ওসি জানান, এরই মধ্যে তাদের কাছে বিএনপি-জামায়াতের থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের সশস্ত্র নেতাদের তালিকা পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচিতে বোমাবাজি, ভাংচুর ও অগি্নসংযোগসহ নানা ধরনের নাশকতায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করার নির্দেশ রয়েছে।
এছাড়া আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ সংগঠনের যেসব নেতাকর্মী চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও দখলবাজির পাল্লায় নেমে দলীয় অভ্যন্তরে নানা ধরনের কোন্দল সৃষ্টি করছে তাদের বিরুদ্ধেও সুনির্দিষ্ট মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করতে বলা হয়েছে। বিশেষ করে যেসব নেতাকর্মীর কারণে সরকারের ইমেজ মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে তাদের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
এদিকে সরকারের এ পরিকল্পনাকে 'অগণতান্ত্রিক জঘন্য ষড়যন্ত্র' বলে বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ নেতারা মন্তব্য করেছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হামলা যত দিন যাচ্ছে ততই বেড়ে চলেছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন মামলা হচ্ছে। নেতাকর্মীদের কারাগারে নেয়া হচ্ছে। সাংগঠনিক কাজে সময় দেয়ার চেয়ে আদালত চত্বরেই নেতাকর্মীদের বেশি সময় দিতে হচ্ছে।
বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের বন্দি করতেই কি সারাদেশের কারগারগুলোতে প্রায় ২০ হাজার বন্দির জায়গা ফাঁকা করা হয়েছে_ এ প্রশ্নের জবাবে মাহবুবুর রহমান বলেন, এমন তথ্য তার কাছে নেই। যদি এমন হয়ে থাকে তাহলে বলব, সরকার সঠিক পথে হাঁটছে না। সরকারের উচিত হবে বিরোধী জোটের সঙ্গে আলোচনা করে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করা। কারগার ফাঁকা করে নেতাকর্মীদের জেলে ঢুকিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না।
বিএনপির প্রথম সারির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলেও একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের ভাষ্য, সরকার ভয় ও অজানা আতঙ্ক থেকেই গণহারে বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করতে ছক কষেছে। ওই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালসহ অন্তত ৮০ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে এতেও সরকারবিরোধী আন্দোলনে ভাটা না পড়ায় সরকার এখন নানা ফন্দি আটছে। প্রতিদিনই বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তাই আতঙ্কিত অনেকেই দলের সাধারণ কর্মসূচিতে যোগ দিতেও ভয় পাচ্ছে।
এদিকে কারা অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দেশের বেশকিছু কারাগারে বন্দি স্বল্পতা থাকার কথা স্বীকার করলেও এর সংখ্যা সঠিক ২০ হাজার কিনা তা নিশ্চিত করতে পারেননি। তাদের ভাষ্য, রাজধানী ঢাকা দেশের সবচেয়ে বেশি ঘণবসতিপূর্ণ এলাকা হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে এখানে বেশি অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে। আর এ কারণেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দির সংখ্যা বেশি। তবে কাশিমপুর কারাগারে বেশকিছু বন্দি স্থানান্তর করায় মাত্রাতিরিক্ত চাপ কিছুটা কমানো সম্ভব হয়েছে। কিন্তু তাতেও জেল কোড অনুযায়ী বন্দিদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা দেয়া যাচ্ছে না বলে ওই কারা কর্মকর্তা স্বীকার করেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে ছোট-বড় কারাগার রয়েছে ৬৮টি। এর মধ্যে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার। দুটি হাই সিকিউরিটি এবং ৫৫টি ছোট-মাঝারি জেলা কারাগার। এসব কারাগারের বন্দি ধারণক্ষমতা ৩৩ হাজার ৮২৪ জন। গত চলতি বছরের ৫ জানুয়ারির আগে উত্তপ্ত আন্দোলন পরিস্থিতিতে ধরপাকড় আর যৌথবাহিনীর বিশেষ অভিযানে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩০ হাজারে। তবে মার্চের শুরুতেই এ সংখ্যা কমতে শুরু করে এবং অক্টোবরের শেষনাগাদ তা এসে দাঁড়ায় ৬১ হাজারে। যা ধারণক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ। তবে নভেম্বরে আকস্মিকভাবে বন্দির সংখ্যা আরো একদফা হ্রাস পায়।
যদিও দেশের ৬৮টি কারাগারের মধ্যে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত কারাবন্দিদের অনুমোদিত ধারণক্ষমতা ৮৩ জনের হলেও সেখানে রয়েছে ১ হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ, একুশে আগস্ট, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, কিবরিয়া হত্যা, বিডিআর বিদ্রোহ ও যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির দ-াদেশপ্রাপ্ত আসামিরাও রয়েছেন।
কারা প্রশাসন শাখা সূত্রে জানা যায়, ঢাকা বিভাগে কারাগার রয়েছে ২১টি। তার মধ্যে ৬টি কেন্দ্রীয় কারাগার। এগুলোর মধ্যে ঢাকায় একটি, গাজীপুরের কাশিমপুরে চারটি ও ময়মনসিংহে রয়েছে একটি। ২১টি ছোট-বড় কারাগারের ধারণক্ষমতা ১০ হাজার ৭৬৮।
ওই ২১টি কারাগারে বন্দির সংখ্যা মধ্য নভেম্বরে ছিল ২০ হাজারের কিছু বেশি। অতিরিক্ত বন্দির সিংহভাগই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ও কাশিমপুরে।
রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে কারাগার রয়েছে ১৬টি। তার মধ্যে কেন্দ্রীয় কারাগার ২টি। এগুলো রাজশাহী ও রংপুর সদরে। ১৬টি ছোট-বড় কারাগারের ধারণক্ষমতা ৮ হাজার ৬১১।
চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে কারাগার রয়েছে ১৫টি। তার মধ্যে কেন্দ্রীয় কারাগার ৩টি। এগুলো চট্টগ্রাম, সিলেট ও কুমিল্লায়। ১৫টি ছোট-বড় কারাগারের ধারণক্ষমতা ৭ হাজার ৫৯৫।
খুলনা ও বরিশাল বিভাগে কারাগার রয়েছে ১৬টি। তার মধ্যে কেন্দ্রীয় কারাগার ২টি। এগুলো খুলনা ও বরিশাল সদরে। ১৬টি ছোট-বড় কারাগারের ধারণক্ষমতা ৬ হাজার ৪৬২।
কারা অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে
বলেন, কারাগারের ধারণক্ষমতা অনুযায়ী ২০ হাজার বন্দির জায়গা ফাঁকা নেই। তবে দীর্ঘদিন স্বাভাবিক সময়ে দেশের কারাগারগুলোতে যে সংখ্যক বন্দি থাকে তার চেয়ে বর্তমানে বেশকিছু বন্দি কম রয়েছে। যদিও এর প্রকৃত সংখ্যা ওই কর্মকর্তা জানাতে চাননি। তবে জেলা শহরের অধিকাংশ কারাগারেই ৫০ থেকে ১০০ জন বন্দি কম রয়েছে বলে ওই কর্মকর্তা স্বীকার করেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের যেসব কারাগারে বন্দি সংখ্যা কম, সেখানে বন্দি স্থানান্তরের মাধ্যমে অতিরিক্ত বন্দি থাকা কারাগারগুলোর চাপ কমিয়ে আনার চিন্তা-ভাবনা চলছে। তবে চলমান মামলার আসামিদের আদালতে আনা-নেয়ার জন্য যথেষ্ট পরিবহন না থাকায় তা দ্রুত কার্যকর করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া দুর্ধর্ষ আসামিদের আনা-নেয়ায় নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে।