DMCA.com Protection Status
title="শোকাহত

বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমছে তো কমছেই, শুধু কমছে না বাংলাদেশে!

 

102915_1আন্তর্জাতিক বাজারে এখন জ্বালানি তেলের দাম গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে গত ছয় মাসেই কমেছে ৪৬ শতাংশ। আর ২০১৫ সালে ব্যারেলপ্রতি দাম ৫০ ডলারের নিচে নামার আশঙ্কা রয়েছে।

তবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার সুফল দেশের মানুষ পায়নি, দেশের বাজারে দাম কমেনি। খুব শিগগির দাম কমানোর কোনো পরিকল্পনাও সরকারের নেই।বরং প্রাকৃতিক গ্যাস এবং বিদু্যতের দাম বাড়ানো হচ্ছে অচিরেই।


সরকারের পক্ষ থেকে তখন প্রতিটি পেট্রল পাম্পে একটি তালিকা ঝুলিয়ে রাখা হতো। সরকার কোন কোন জ্বালানি তেলে লিটারপ্রতি কত টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে তার উল্লেখ ছিল তাতে।২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার চার দফায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারের যুক্তি ছিল- আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় তেল আমদানিকারক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) লোকসান বাড়ছে।

তবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ধারা বন্ধ হয়েছে বেশ আগেই। কেবল গত এক বছরেই জ্বালানি তেলের দাম কমেছে ৪০ শতাংশ। শেষবার যখন দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল তার সঙ্গে তুলনা করলে দাম কমার এ হার ৪৫ শতাংশেরও বেশি।

২০১৩ সালের জানুয়ারিতে দেশের বাজারে যখন দাম বাড়ানো হয় তখন আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ১২২ ডলার। ওই বছরের ৩ জানুয়ারি মধ্যরাতে সরকার নির্বাহী আদেশ জারি করে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়।

পেট্রল ও অকটেনে লিটারপ্রতি দাম বাড়ে পাঁচ টাকা করে, ডিজেল ও কেরোসিনে লিটারে বাড়ে সাত টাকা করে। বাড়তি মূল্য যোগ হয়ে লিটারপ্রতি ডিজেল ও কেরোসিনের দাম দাঁড়ায় ৬৮ টাকায়। আর পেট্রলের দাম হয় ৯৬ টাকা আর অকটেনের হয় ৯৯ টাকা।

আর গতকাল শনিবার আন্তর্জাতিক বাজারে এক ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ছিল ৫৭ দশমিক ৮১ ডলার। কিন্তু দেশের বাজারে লিটারপ্রতি পেট্রল, অকটেন, ডিজেল, কেরোসিনসহ সব জ্বালানি তেল বিক্রি হচ্ছে সেই আগের দামেই।

এ বিষয়ে বিপিসির চেয়ারম্যান ইউনুসুর রহমান বলেন, ‘জ্বালানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই সরকার। আমার জানা মতে, জ্বালানি তেলের দাম কমানোর কোনো পরিকল্পনা এ মুহূর্তে সরকারের নেই।’

বিশ্ববাজারে দাম কমা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দেড় মাসে আগেও আমরা কেরোসিন ও ডিজেলে লোকসান করেছি। এখন লাভ করছি। তবে জ্বালানি তেলের দাম যদি এভাবে আরো কমে যায় বা এ অবস্থায় থাকে তাহলে দাম কমানোর ব্যাপারে একটা চিন্তা-ভাবনা করা যেতে পারে।’

জ্বালানি তেলের বাড়তি মূল্য দেখিয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোরও তোড়জোড় চলছে। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ বেড়ে যাচ্ছে- এমন অজুহাতে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব জমা পড়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে।

জানুয়ারি নাগাদ গ্রাহক পর্যায়ে খুচরা বিদ্যুতের দাম বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু কম দামে আমদানি করা জ্বালানি তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর যৌক্তিতা নেই বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ‘এখন কম দামে জ্বালানি তেল কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে সরকার। এ কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো কারণ নেই।’

দেশের বাজারে সর্বশেষ চার ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল ২০১১ সালের ২৯ ডিসেম্বর। সেই সময় লিটারপ্রতি পাঁচ টাকা করে দাম বাড়ানো হয়েছিল। তারও আগে দাম বাড়ানো হয় দুই দফায়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের চাপেই তেলের দাম বাড়ায় সরকার।

বাংলাদেশের জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে সব সময় ভারতের জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে তুলনা করা হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, ভারতে যদি জ্বালানি তেলের দাম বেশি থাকে আর বাংলাদেশে যদি কম থাকে, তাহলে তেল অবৈধ পথে ভারতে পাচার হয়ে যেতে পারে।

অথচ ভারত সরকার বরাবর আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তেলের দাম নির্ধারণ করে। বিশ্ববাজারে দাম কমায় ভারতে গত আগস্ট থেকে সাত দফায় পেট্রল এবং তিন দফায় ডিজেলের দাম কমানো হয়েছে। গত নভেম্বরের শুরুতে পেট্রলের দাম কমেছে ২.৪১ রুপি, ডিজেলের দাম কমেছে ২.২৩ রুপি। আগস্ট থেকে হিসাব করলে ভারতের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে গড়ে ৯.৩৬ রুপি।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘এর আগে সরকার যতবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে ততবারই বলেছে যে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে দেশের বাজারে দাম বাড়াতে হচ্ছে। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম প্রায় অর্ধেক কমে গেছে, কিন্তু দেশের বাজারে জ্বালানি তেল বিক্রি হচ্ছে আগের দামেই। সরকারের উচিত জনগণ ও অর্থনীতির কথা বিবেচনা করে জ্বালানি তেলের দাম কমানো।’

জানা গেছে, বিপিসি পুরনো লোকসান পুষিয়ে নিতে বেশি দামে বিক্রি করছে জ্বালানি তেল। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত অর্থবছরে বিপিসির ঘাটতি ছিল ২,৪৭৮ কোটি টাকা। অথচ ওই বছরে বিপিসি সরকারকে ৪,৫২৫ কোটি টাকা রাজস্ব দিয়েছে। অর্থাৎ সরকারকে রাজস্ব দেওয়ার পর বিপিসি প্রকৃতপক্ষে ২,০৪৭ কোটি টাকা মুনাফা করেছে।

আর বেসরকারিভাবে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের সরকার তেল আমদানির অনুমতি দিয়েছে তাদের কাছ থেকে কোনো রাজস্ব নেওয় হয় না, উল্টো তেল আমদানির কারণে ওই সব কম্পানি প্রতি লিটারে ১০ শতাংশ সার্ভিস চার্জ পায়।

জ্বালানি তেলের দাম বিশ্লেষণ করে থাকে ব্লুমবার্গসহ এ রকম বেশ কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট ঘেঁটে জানা গেছে, ২০০৯ সালে বিশ্ববাজারে ব্যারেলপ্রতি অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ৬০ থেকে ৬৫ ডলারের ভেতর। এরপর ক্রমান্বয়ে তা বাড়তে থাকে। ২০১৩ সালের শুরুতে দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১২২ ডলারে।

তবে এরপর থেকে দরপতন শুরু হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে ব্যারেলপ্রতি অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ১১১ ডলার। দরপতনের সেই ধারা এখনো আছে। সর্বশেষ গতকাল শনিবার ব্যারেলপ্রতি অপরিশোধিত তেল বিক্রি হয়েছে ৫৭.৮১ ডলারে।

বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, বছরে দেশে আমদানি করা ৫৭ লাখ টন জ্বালানি তেলের মধ্যে ৩৩ লাখ টনই ডিজেল, যা মোট আমদানির ৬৫ শতাংশ। ডিজেলের পর বেশি আমদানি হয় ফার্নেস অয়েল, ১০ থেকে ১২ লাখ টন।

ফেব্রুয়ারিতে প্রতি লিটার ফার্নেস অয়েল কিনতে বিপিসির ব্যয় হয়েছে ৫০ টাকা করে। খোলা বাজারে তা বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকা করে। শুল্ক দেওয়ার পর প্রতি লিটার ফার্নেস অয়েলে বিপিসির লাভ থাকত দুই টাকা করে। তবে এখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমায় এ খাতেও বিপিসির বড় অঙ্কের লাভ থাকার কথা। আর পেট্রল, অকটেন ও জেট ফুয়েল বিক্রি করে অনেক আগে থেকেই মুনাফা করছে বিপিসি।

সিটি ব্যাংক, ব্লুমবার্গসহ প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, আগামী বছরজুড়েই জ্বালানি তেলের দাম নিম্নমুখী থাকবে। তাদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ব্যারেলপ্রতি অপরিশোধিত তেলের দাম গড়ে ৫০ থেকে ৬০ ডলারের ভেতরই থাকতে পারে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে দাম ৫০ ডলারের নিচে নামারও সম্ভাবনা রয়েছে।

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!