শহীদ আলতাফ মাহমুদ ছিলেন একাধারে একজন ভাষাসৈনিক, সুরকার, সাংস্কৃতিক কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধা। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’- বিখ্যাত এ গানটির সুর তারই করা। ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট ঢাকার রাজারবাগের বাসা থেকে তাকে ধরে নিয়ে যায় পাকবাহিনী। সেই যে গেলেন আর ফিরলেন না। পাকবাহিনীর হাতে একই দিন আটক হয়েছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের জ্যেষ্ঠপুত্র মুক্তিযোদ্ধা শফি ইমাম রুমী, শিল্পী আবুল বারক আলভী বদি, জুয়েল, আজাদ, হাফিজ, বকর, চুল্লুও। তাদের অনেকেই আর ফিরতে পারেননি। তারা ছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য। প্রত্যেকে ছিলেন নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিভাবান, দুঃসাহসী, দেশপ্রেমী।
কিন্তু তারা যে ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য পাকবাহিনীর তো তা জানার কথা নয়। কীভাবে জানল? জেনেছে আবদুস সামাদ নামের এক বাঙালির কাছ থেকে। কে এই আবদুস সামাদ? তার দাবি অনুযায়ী এবং তার সহযোদ্ধা অনেকের মতে, তিনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বইপত্র পড়ে এবং একাধিক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, একাত্তরের জুন-জুলাই মাস থেকে ২নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ও ‘কে-ফোর্স’-এর সর্বাধিনায়ক খালেদ মোশাররফের পরিকল্পনায় ঢাকার অভ্যন্তরে গেরিলারা প্রবেশ করে। তারপর সংগঠিত হয় একাধিক সফল গেরিলা অপারেশন। ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলাদের ধারাবাহিক আক্রমণে পাকবাহিনীর আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ে। জানা যায়, ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য রুমী, জুয়েল, বকরদের সহযোদ্ধা ছিলেন এই আবদুস সামাদ।
এই অপারেশনের সত্যতা যাচাই করতে ব্যক্তিগতভাবে আমরা কথা বলি, মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক, অভিনেত্রী শিমুল ইউসুফ, শিল্পী আবুল বারক আলভীসহ বেশ কয়জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২৯ আগস্ট ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল জালাল উদ্দিনের বাসা থেকে আটক হন ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য বদি। জালাল উদ্দিনের ছেলে ফরিদ ছিল বদির বন্ধু। বদির সঙ্গে তাকেও আটক করা হলো। বদির উপর অমানুষিক নির্যাতন চালাল পাকবাহিনী। কিন্তু তিনি তার সহযোদ্ধাদের কারো নাম একবারও উচ্চারণ করেননি। ব্যর্থ হয়ে তারা ফরিদের উপর নির্যাতন শুরু করল। নির্যাতনের মুখে ফরিদ বলে দেন আবদুস সামাদ ও চুল্লুর নাম। সেদিন বিকেলেই ধরা পড়েন সামাদ।
উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ’৭১ সালে রাজধানী ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধারা দুঃসাহসী কয়েকটি অপারেশন করেন। তন্মধ্যে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ও ফার্মগেট অপারেশন অন্যতম। মুক্তিযোদ্ধারা দুবার ইন্টারকন্টিনেন্টালে অপারেশন করেন। প্রথমে জুনে, দ্বিতীয়বার ১১ আগস্ট। উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, দ্বিতীয় অপারেশনের মূল নায়ক ছিলেন আবদুস সামাদ ও আবু বকর। এ অপারেশন করার জন্য তারা সুযোগ খুঁজছিলেন। কিন্তু প্রথম ঘটনার পর থেকে পাক সেনাবাহিনী হোটেলের মূল ফটকসহ চারদিকে কড়া পাহারা বসায়। প্রয়োজনেও সেখানে ঢোকা ছিল কষ্টকর। আবদুস সামাদ সিদ্ধান্ত নিলেন যে-করেই হোক অপারেশন করতে হবে। একটা উপায়ও বের করে নিলেন। থাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের একটি অফিস ছিল হোটেলের শপিং আর্কেডে। আবদুস সামাদ খবর পান, ব্যবসায়িক মন্দার কারণে ওই অফিস হোটেলেরই ছোট এক কক্ষে স্থানান্তর হবে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে তিনি নিয়নসাইন ও সাইনবোর্ড তৈরির ব্যবসা করতেন। শপিং আর্কেডের কয়েকটি দোকানের নিয়নসাইন তারই করা। এ সূত্রে তিনি খবরটা পান। অন্য কেউ যাতে কাজটা না নিতে না পারে সেজন্য তিনি খুব কম দরে কাজটা নেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে হোটেলে কয়েকদিন রেকি করেন। তারপর সিদ্ধান্ত নেন যেদিন কাজ শেষ হবে সেদিন বারের বিপরীত দিকে পুরুষদের প্রসাধনকক্ষের কোণায় দুজন মিলে বিস্ফোরক সামগ্রী রাখবেন। ১১ আগস্ট কাজ শেষ হওয়ার কথা। ওইদিন সকালে তাদের এক সহযোদ্ধা বায়তুল মোকাররম মার্কেট থেকে একটি ব্রিফকেস কিনে আনেন। ওটার ভেতরে তারা সাজিয়ে রাখেন ২৮ পাউন্ড পিকে ও ৫৫ মিনিট মেয়াদি টাইম বোমা। তারপর বিকেলে গাড়িতে চেপে রওনা হন আবদুস সামাদ, আবু বকর, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও গোলাম দস্তগীর।
হোটেলের গাড়ি পার্কিংয়ে পৌঁছে আবদুস সামাদ ও বকর হোটেলের ভেতরে ঢোকেন। বাকি দুজন গাড়িতে স্টেনগান নিয়ে বসে থাকেন। আবদুস সামাদ ও আবু বকর হোটেল লাউঞ্জে মূল দরজা দিয়ে না ঢুকে ‘সুইস এয়ারের’ অফিস কক্ষের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকেন। এ ব্যাপারে সহায়তা করেন ওই অফিসেরই একজন বাঙালি কর্মী। ব্রিফকেসসহ দুজন সরাসরি প্রসাধনকক্ষে যান। আবদুস সামাদ বাইরে থাকেন কাভার হিসেবে এবং বকর একেবারে কোণার কক্ষে ঢুকে দরজা আটকে টাইম বোমা চালু করে ব্রিফকেস রাখেন কমোডের পেছনে। দরজা ছিটকিনি লাগিয়ে রেখেই দেয়াল টপকে বেরিয়ে আসেন। তারপর দুজন সোজা চলে যান অপেক্ষমাণ গাড়ির কাছে। গাড়িতে ওঠামাত্র দ্রুত সেটি বেরিয়ে যায়। ঠিক ৫৫ মিনিট পরই ঘটে প্রচ- বিস্ফোরণ। হোটেলের লাউঞ্জ, শপিং আর্কেড ও আশপাশের কক্ষের কাচ টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ে। ছিটকে যায় দরজা, ভেঙে পড়ে কক্ষের ভেতরের ও লাউঞ্জ-লাগোয়া দেওয়াল। আহত হয় বেশ কয়জন। দুদিন পর বিশ্ব সংবাদপত্রে রোমাঞ্চকর এই অপারেশনের খবর প্রকাশিত হয় বেশ গুরুত্বসহকারে।
জানা যায়, সেদিন টর্চারসেলে শুরু হয় তার উপর নির্যাতন। পাকসেনারা সামাদকে আশ্বস্ত করে, তিনি যদি তার সহযোদ্ধাদের নাম বলে দেন তাহলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। প্রলোভনে পা দিলেন জীবনের ভয়ে ভীত আবদুস সামাদ। সহযোদ্ধাদের নাম-ঠিকানাসহ বিস্তারিত সব পাকসেনাদের বলে দিলেন। সে-রাতেই সামাদকে নিয়ে পাকসেনারা রুমী, আজাদ, বকর, জুয়েল, হাফিজ ও আলতাফ মাহমুদের বাসায় হানা দেয়। সামাদ একে একে সবাইকে চিনিয়ে দেন, অস্ত্র রাখার স্থানগুলো দেখিয়ে দেন।
সার্বিক বিষয়ে আবদুস সামাদের ফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
তথ্যটি স্বীকার করেছেন ২নং সেক্টরের গেরিলা যোদ্ধা হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক। তিনি বলেন, ‘আর্মিদের হাতে ধরা পড়ার পর আবদুস সামাদ খুব নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। তার স্ত্রী ও শিশু সন্তান ছিল। সব কিছু মিলিয়ে আবদুস সামাদ তার সহযোদ্ধাদের নাম- ঠিকানা সব বলে দেন। আলতাফ মাহমুদসহ অনেক গেরিলাকে ধরিয়ে দেন।’
তারপর ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে আবদুস সামাদ মুক্তিযোদ্ধাদের কর্তৃক রাজবন্দি হিসেবে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান এবং পরবর্তীকালে ‘বীরপ্রতীক’ খেতাবে ভূষিত হন।
দুই.
’৭১ সালের ৩০ আগস্টের আগ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে আবদুস সামাদের অবদান নিয়ে প্রশ্ন নেই। বলছি না তার অবদানকে অস্বীকার করার সুযোগ আছে। কিন্তু ৩০ আগস্ট যখন তিনি জীবনের মায়ায়, পাকবাহিনীর প্রলোভনে তার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন, তারপর থেকেই তিনি কিন্তু পরাজিত সৈনিক। লেখা বাহুল্য, বীর কখনো পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে না। শত অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে বীর তার লড়াই চালিয়ে যায়। পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে কত অমানুষিক নির্যাতনই না করেছে, তারা কি মুখ খুলেছিলেন? না। ভেঙেছেন, কিন্তু মচকাননি। কত নির্যাতন চালানো হয়েছে আবুল বারক আলভী, বদি, জুয়েল, আজাদ, হাফিজ, বকর, চুল্লুদের উপর। তাদের কেউ মুখ খোলেননি। জীবনের মায়ায় কিংবা কোনো প্রলোভনে ভোলেননি। বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করলেন আবদুস সামাদ।
বছর তিনেক আগে শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আবুল বারক আলভীর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট আমরা আলতাফ মাহমুদের বাসায় একসঙ্গে ধরা পড়লাম। সঙ্গে আরো ছয়জন ইনোসেন্ট ছেলেকে ধরল। আমাকে ইনোসেন্ট হিসেবেই আটক করল। আমাদেরকে মার্শাল ল কোর্টে নিয়ে যাওয়া হলো। গাড়িতে উঠানোর সময় বন্দুকের বাঁট দিয়ে আঘাত, বুট জুতার লাথি, কিল-ঘুষি ইত্যাদি দিয়েছিল। গাড়ি থেকে নামানোর সময়ও যে-যেভাবে পারল মারধর করল। চোর ধরলে যেমন গণধোলাই চলে ঠিক তেমনি। বিচার শুরু হওয়ার আগেও ব্যাপক মারধর করা হলো। আমি বললাম, আমিই আলভি। তারপর আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো টর্চার সেলে। মোটা বেত দিয়ে এলোপাতাড়ি পেটাল। গায়ের চামড়া ও হাতের আঙুলগুলো ফেটে গেল। আমাকে বারবার মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে নানা কথা জিজ্ঞেস করছে। আমি বারবারই অস্বীকার করে যাচ্ছি। কারণ স্বীকার করলেও তো টর্চার বন্ধ হবে না। সুতরাং টর্চার চলুক, আমি স্বীকার করব না। বললাম, ‘না, আমি কখনোই মুক্তিযুদ্ধে যাইনি।’ বলল, ‘তোমার নাম আলভি তো?’ বললাম, ‘হ্যাঁ, আমিই আলভি।’ বলল, ‘তোমরা এত তারিখে ঢুকেছিলে, তোমাদের সঙ্গে এই এই অস্ত্র ছিল, তোমরা অমুক জায়গায় অস্ত্রগুলো রেখেছিলে।’ আমি বললাম, ‘না, আমি মুক্তিযুদ্ধে কখনোই যাইনি।’ তারপরও প্রশ্ন করছে, ‘তোমার এই এই বন্ধুরা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে।’ বললাম, ‘কারা আমার বন্ধু?’ তখন আমার অনেক বন্ধুর নাম বলল। আমি বললাম, ‘না, এই নামে আমার কোনো বন্ধু নেই।’ বলল, ‘তুমি ভাবছ অস্বীকার করলেই তুমি ছাড়া পেয়ে যাবে?’ আমি কিছু বললাম না। খানিক পর আমার বন্ধু বকরকে নিয়ে এলো। আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো বকরের ব্যাপারে। আমি বললাম, ‘না, আমি বকরকে চিনি না।’ আমাকে অন্যরুমে টর্চার করতে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।
তারপর গভীর রাতে আমাদের রমনা থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। পরদিন সকালে নিয়ে যাওয়া হলো মার্শাল ল কোর্টে। আমাকে লোভ দেখানো হলো যে, তুমি যদি তোমার মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুদের নাম বল তবে ছাড়া পাবে, নয়ত ছাড়া পাবে না। আমি বললাম, ‘আমি সরকারি চাকরি করছি। যারা মুক্তিযুদ্ধে গেছে তারা হয়ত আমার বন্ধু হতে পারে। কিন্তু তারা কি আমাকে বলবে যে, আমি মুক্তিযুদ্ধে গেছি? কারণ সরকারি চাকরিজীবীদের তো তারা দালাল ভাবে।’
আমার সামনে কোরআন শরীফ আনা হলো। আমি মুক্তিযুদ্ধে যাইনি এ কথা কোরআন শপথ করে বলতে বলল। আমি কোরআন শপথ করে বললাম যে, আমি মুক্তিযুদ্ধে যাইনি। তখন মানসিকভাবে খুব দুর্বল মুহূর্ত। মায়ের কথা মনে পড়ছে খুব। তারপর আমাকে ছেড়ে দেওয়া হলো। ইনোসেন্ট যাদের ধরা হয়েছিল তাদেরও ছেড়ে দিল। একজন সিপাহী আমাকে গেট পার করিয়ে দিয়ে এলো। আমি এয়ারপোর্ট রোডে উঠে এলাম এবং ফিরে এলাম আলতাফ মাহমুদের বাড়িতে।’
আবুল বারক আলভীর বক্তব্য অনুযায়ী, শত নির্যাতন শর্তেও তিনি মুখ খোলেননি। অথচ আবদুস সালাম একে একে সব কথা বলে দিলেন, সবাইকে ধরিয়ে দিলেন। হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক যেমন বললেন, ‘সেই সময় যদি আবদুস সামাদের সঙ্গে দেখা হতো, হয়ত তাকে মেরেই ফেলতাম।’ তিনি আরো বলেন, ‘সামাদের মতো চুল্লু ভাইও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। সামাদ ভাই সইতে না পেরে, স্ত্রী-সন্তানের কথা ভেবে, সব স্বীকার করে সবাইকে ধরিয়ে দিয়ে বেঁচে গেছেন। চুল্লু ভাই শত নির্যাতনের পরও সব কিছু অস্বীকার করেছেন। তিনিও বেঁচে গেছেন। চুল্লু ভাই বীরের মতো পেরেছেন, সামাদ ভাই পারেননি। এটা তার ব্যর্থতা। তার এই ব্যর্থতার ক্ষতি অনেক বড়।’
হ্যাঁ, আবদুস সমাদ হয়ত নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে, জীবনের মায়ায়, স্ত্রী-সন্তানের মায়ায়, পাকবাহিনীর প্রলোভনে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। করতেই পারেন। সবার মানসিক শক্তি তো আর এক রকম হয় না। দুর্দমনীয় সাহস হয়ত আবদুস সামাদের ছিল না। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেও তাকে মুক্তিযোদ্ধা বলতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু কী কারণে তাকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করা হলো এটা একটা বড় প্রশ্ন। এত বড় একটা বিশ্বাসঘাতকতার পর তো তাকে এই খেতাবে ভূষিত করা যায় না। আমাদের সাধারণ বিবেক তো তাই বলছে।
এটাও না হয় মেনে নেওয়া যায়। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধারা তার বিশ্বাসঘাতকতার ব্যাপারে না জেনে কিংবা তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েই হয়ত তাকে খেতাবটা দিয়েছে। তারপর তিনি দেশের বাইরে চলে যান। ৪৩ বছর তার আর খোঁজ নেই। এর মধ্যে হয়ত তিনি অনেকবার দেশে এসে থাকবেন। কিন্তু প্রকাশ্যে তাকে সেভাবে কোথাও দেখা যায়নি। দেখা গেল গত ৯ ডিসেম্বর। ৭১ টেলিভিশন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের উপর একটা অনুষ্ঠান প্রচার করছে ধারাবাহিকভাবে। সেদিন ৫টা ৪০ মিনিটে ওই অনুষ্ঠানে আবদুস সামাদ অতিথি হয়ে এলেন। তিনি তার ‘বীরত্বগাঁথা’ প্রচার করলেন স্বগৌরবে। ভালো কথা। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, সেই স্মৃতিচারণ তিনি করতেই পারেন। কিন্তু সেই সঙ্গে তার বিশ্বাসঘাতকতার কথাটাও তো বলা উচিত। যে ক্ষতি তিনি করেছিলেন সেই ক্ষতির দায় তো একটিবার হলেও স্বীকার করা উচিত। জাতির কাছে তার এই বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তো ক্ষমা চাওয়া উচিত। ক্ষমা চাওয়া তো দূরে থাক, তিনি সেই বিশ্বাসঘাতকতার কথা একটিবার উচ্চারণও করলেন না ওই অনুষ্ঠানে।
সেদিন থেকেই তাকে নিয়ে শুরু হলো বিতর্ক। আলতাফ মাহমুদকে পাকবাহিনী যেদিন ধরে নিয়ে গেল সেদিন একই বাসায় ছিলেন অভিনেত্রী শিমুল ইউসুফ। তিনি আলতাফ মাহমুদের শ্যালিকা। তার বয়স তখন ১৪। তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন আবদুস সামাদ কীভাবে আলতাফ মাহমুদকে চিনিয়ে দিচ্ছেন, কীভাবে অস্ত্রভা-ারটি দেখিয়ে দিচ্ছেন পাকবাহিনীকে। সেদিন বাসায় ছিলেন আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন মাহমুদও। তেতাল্লিশ বছর পর বিশ্বাসঘাতক আবদুস সামাদকে ৭১ টেলিভিশনে দেখে তাদের দুঃখভারাক্রান্ত স্মৃতি জেগে ওঠে। তারা মেনে নিতে পারেননি বিষয়টি। তারা ফেসবুকের মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এ বিষয়ে কথা হয় শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন মাহমুদের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘তেতাল্লিশ বছর পর বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে আবদুস সামাদ ও তার স্ত্রীকে দেখলাম ৭১ টেলিভিশনের মাধ্যমে। এই সামাদ একাত্তরের আগস্ট মাসে রুমী, জুয়েল, হাফিজ, আজাদ, বদি, বাকের ও আলতাফ মাহমুদকে ধরিয়ে দিতে পাকবাহিনীকে সাহায্য করেছিলেন এবং তাদের বাড়ি চিনিয়ে দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর আমার মা এই সামাদকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কেন এই কাজটি করেছিলেন আপনি?’ তার উত্তর ছিল, ‘ভাবী আমার তো বউ বাচ্চা আছে, তাই নয়? আর ওদের অত্যাচার সহ্য করতে পারিনি আমি।’ আমার বাবা আলতাফ মাহমুদসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দিয়ে তিনি যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন সেজন্য তো জাতির কাছে তার ক্ষমা চাওয়া উচিত। তা না করে তিনি টেলিভিশনে এসে বীরত্ব প্রচার করছেন, এটা মেনে নেওয়া যায় না। আশা করি তিনি তার বিশ্বাসঘাতকতার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাইবেন।’
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রত্যেক বিবেকবান নাগরিকই তাই মনে করবেন নিশ্চয়ই। এই দায় কিছুতেই এড়াতে পারেন না আবদুস সামাদ। যে ভুল, যে অন্যায়, যে বিশ্বাসঘাতকতা তিনি করেছিলেন, তার জন্য যদি তিনি ক্ষমা চান জাতির কাছে, তাহলে তার সম্মান বাড়বে বই কমবে না।
‘আবদুস সামাদ একজন বিশ্বাসঘাতক’ :শিমুল ইউসুফ, নাট্যাভিনেত্রী
’৭১ সালের ৩০ আগস্ট আপনি কোথায় ছিলেন?
রাজারবাগে আমাদের বাসায়। যৌথ পরিবার ছিল আমাদের। বড় বোন সারাআরাকে বিয়ে করেন আলতাফ মাহমুদ। বিয়ের পর আলতাফ ভাই আমাদের বাসাতেই থাকতেন। তাকে আপন ভাইয়ের চেয়ে বেশি জানতাম। বাউ-ুলে স্বভাবের ছিলেন। আমার মা তাকে মায়ের আদর দিয়ে নিজের কাছে রাখতে চাইতেন। মুক্তিযুদ্ধের গানগুলো রেকর্ডিং করে আলতাফ ভাই খুব গোপনে পাঠাতেন। আমরা কিছুই জানতাম না। ধরা পড়ার একটা ভয় ছিল, তাই গানগুলোতে তার নাম প্রচারিত হতো না। জুন-জুলাই মাস থেকে ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের বাসায় আশ্রয় নিতে শুরু করল। যেহেতু আমাদের বাসাটা রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ঠিক উল্টোদিকে, তাই মুক্তিযোদ্ধারা ভাবল হঠাৎ করে এই বাড়িটা সন্দেহ করবে না পাকবাহিনী। যখনই খিদা লাগত তখনই মুক্তিযোদ্ধারা আসতেন, খেতেন। আমার মা বেশি বেশি করে রান্না করে রাখতেন। আমাদের বাড়িটাকে পরবর্তীকালে বলা হয়েছিল ‘একাত্তরের দুর্গবাড়ি’।
তখন আপনার বয়স কত?
আমার বয়স তখন চৌদ্দ। সব কিছুই বুঝতে শিখেছি।
আবদুস সামাদ কি যুদ্ধের শুরু থেকেই আপনাদের বাসায় আসতেন?
হ্যাঁ আসতেন। শাহাদত চৌধুরীর সঙ্গে অনেকদিন এসেছেন, খেয়েছেন। তার বাসা ছিল মগবাজারের দিকে। তিনি নিয়নসাইনে কাজ করতেন। বাংলা, ইংরেজি, উর্দুসহ চার-পাঁচটা ভাষা জানতেন। পাকিস্তানেও ছিলেন কিছুদিন। মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু এখন, তেতাল্লিশ বছর পর আমার মনে হচ্ছে, এই লোকটি কি তাহলে পাকিস্তানিদের রিক্রুট ছিলেন? এজেন্ট ছিলেন?
তিনি কিন্তু ইন্টারকন্টিনেন্টাল অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন…
এ ব্যাপারেও এখন আমার সন্দেহ হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য কিছু কাজ তো করতে হবে। নইলে তো মুক্তিযোদ্ধাদের বিশ্বাস অর্জন করা যাবে না। সে জন্যই হয়ত সামাদ কিছু কাজ করেছিলেন। আটক হওয়ার পর তিনি পাকসেনাদের কাছে নিজের দোষ স্বীকার করেছেন। পাকবাহিনী তাকে বলেছে, ‘তুমি একজন মুক্তির নাম বলো, তোমাকে বাঁচিয়ে দেব।’ একজন নয়, তিনি সবার নাম বলে দিলেন, তাদের ধরিয়ে দিলেন। তারপর তিনি রাজসাক্ষী হলেন। পাক আর্মিদের ট্রাইব্যুনালে তিনি রাজসাক্ষী হয়েছিলেন, সবার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলেন। তিনি যদি মুক্তিযোদ্ধা হতেন, একসঙ্গে এত বিশ্বাসঘাতকতা করতেন না। তিনি আসলেই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কি না, আমার মনে এখন প্রশ্ন জাগছে।
তিনি পাকবাহিনীর হাতে কখন ধরা পড়েছিলেন?
২৯ আগস্ট সন্ধ্যায়। পরদিন পাকবাহিনী তাকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসে। তিনি আলতাফ ভাইকে চিহ্নিত করেন।
তাকে দেখে তখন আপনার কি মনে হয়েছিল তিনি পাকবাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত?
একটুখানি তাকে মেরেছে, আমার মনে আছে। তার হাতে আমি কালো দাগ দেখেছি। কিন্তু সেই মার তো কোনো মার নয়। যেখানে আজাদের মা আজাদকে বলছেন, ‘বাবা, সহ্য করবি, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের নাম বলিস না।’ যেখানে আলতাফ ভাই আলভীকে বলে দিয়েছেন, ‘তুমি কিন্তু তোমার নাম আলভী বলবে না, আবুল বারক বলবে। তারা আলভী নামে তোমাকে খুঁজছে। আমি তোমাকে চিনি না।’ যেখানে রুমিও বলছেন, ‘আমিও কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে চিনি না।’ সেখানে আবদুস সামাদ সবার নাম পুঙ্খানুপুঙ্খ বলে দিলেন! বিস্ময়কর!
তিনি যে আবদুস সামাদ ছিলেন আপনি কতটা নিশ্চিত?
আমার স্মৃতিশক্তি কি নষ্ট হয়ে গেছে? সেদিনের ঘটনা তো এখনও আমার চোখের সামনে ভাসছে।
আপনি কীভাবে নিশ্চিত হলেন যে, আবদুস সামাদই আলতাফ মাহমুদকে ধরিয়ে দিয়েছেন?
আলতাফ মাহমুদকে যখন ধরতে এলো তখন পাকবাহিনী কী করে জানল এই মানুষটাই যে আলতাফ মাহমুদ? তারা কী করে জানল যে, এখানে অস্ত্র আছে? সামাদ সাক্ষী হিসেবে আমাদের বাসায় এসেছিলেন? তাকে আর্মিরা জিজ্ঞেস করে, ‘এই লোকটি আলতাফ মাহমুদ?’ সামাদ বলেন, ‘হ্যাঁ, এই লোকই।’ সামাদের পরনে তখন একটা খয়েরি রঙের গেবাডিং প্যান্ট ছিল, গায়ে একটা সাদা হাফশার্ট ছিল। আমি জীবনে ভুলব না লোকটাকে।
এমনও তো হতে পারে তিনি অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে সবাইকে ধরিয়ে দিয়েছেন…
মার সহ্য করতে না পারলে তিনি মুক্তিযুদ্ধে গেলেন কেন? আলতাফ মাহমুদরা শহীদ হলেন কেন? মুখ খোলেননি বলেই তো। রুমী, আজাদ, বদি, বকররা শহীদ হলেন কেন? মুখ খোলেননি বলেই তো। তারা তো একটা নামও বলেননি। পাকবাহিনী বারবার তাদের বলেছিল, ‘শুধু একটা মুক্তির নাম বল, তোকে ছেড়ে দেব।’ প্রত্যেকে একই কথা বলেছিল। কেউ একটিবার মুখ খোলেনি। সামাদ একা কেন মুখ খুললেন? তার মানে সামাদ পাকবাহিনীর এজেন্ট ছিলেন? আমার তো সন্দেহ হচ্ছে। এখন আমার মনে হচ্ছে, তাকে কি তবে পাক আর্মিরা পিক করেছিল যে, মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তুমি ঢুকে যাও এবং ওদের কার্যক্রম দেখ এবং আমাদের অবহিত করো।
তিনি কবে মুক্তি পেয়েছিলেন?
১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়। তিনি এতদিন ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন না, জেলখানায় ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে ফুলের মালা দিয়ে জেলখানা থেকে বের করে আনলো।
তিনি তো বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন, ফুলের মালা কেন?
কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের কেউই জানত না তার বিশ্বাসঘাতকতার কথা।
জাহানারা ইমাম তার ‘একাত্তরের দিনগুলো’তে আলতাফ মাহমুদ, রুমীদের আটক হওয়ার পেছনে একজন মুক্তিযোদ্ধার বিশ্বাসঘাতকতার কথা লিখেছেন। কিন্তু নামটি উল্লেখ করেননি। আবদুস সামাদই কি সেই বিশ্বাসঘাতক? জাহানারা ইমাম কি জানতেন তার কথা?
অবশ্যই জানতেন। বুবু নামটা এড়িয়ে গেছেন। নামটা উল্লেখ করলে ভালো হতো।
আবদুস সামাদ যখন বীরপ্রতীক খেতাব পেলেন তখন প্রতিবাদ করলেন না কেন?
দেখুন, মুক্তিযুদ্ধের পর আলতাফ ভাইকে আমরা অনেক খুঁজেছি, এখনও খুঁজছি। যুদ্ধের পর কে বীরপ্রতীক খেতাব পেল, কে পেল না, এত কিছু দেখার মতো, ভাবার মতো সময় বা মানসিকতা আমাদের ছিল না।
৪৩ বছর পর এখন কেন সামাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন? আরো আগে কেন করেননি?
অভিযোগ এখন করছি না, আগেও করেছি। ১৯৯৩ সালে দৈনিক ভোরের কাগজে আমি এ বিষয়ে একটা লেখা লিখেছি। মতিউর রহমানের যে বইটি আছে সেখানেও আমার লেখাটি ছাপা হয়েছে। সামাদকে মুক্তিযোদ্ধাদের কমিউনিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। ক্র্যাক প্লাটুনের সবাই তো বিচ্ছিন্ন ছিল। যুদ্ধের পর সবাই যখন একত্রিত হলো তখন শাহাদত চৌধুরী, হাবিবুল আলম বীরপ্রতীকরা যখন জানতে পারলেন সামাদই মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দিয়েছিলেন, তখন সবাই তাকে বয়কট করা শুরু করলেন। তার সঙ্গে সবাই যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।