চট্টগ্রামে স্বর্ণের দোকানে ডাকাতির ঘটনায় জড়িতদের অনেকের ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকায় বাড়ি রয়েছে। কেবল তাই নয়, দামি গাড়ি ছাড়াও এদের বেশির ভাগেরই ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থের পরিমাণ কোটি টাকার বেশি। ডাকাতি করেই তারা গত ১০ বছরে বিপুল পরিমাণ এসব অর্থের মালিক হয়েছে বলে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে।
এ ঘটনায় গতকাল বন্দুকযুদ্ধে দুই ডাকাত সরদার গুলিবিদ্ধ হয়েছে। পরে তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী আরও ৫ জনকে ধরা হয়। এরপর তারা সবাই ডাকাতির নানা অজানা তথ্য তুলে ধরে। নগর পুলিশ দাবি করেছে, বুধবার ভোরে ডাকাত সরদার হাসান ও মানিককে নিয়ে শহরের ফিরিঙ্গিবাজার ব্রিজঘাট এলাকায় অস্ত্র উদ্ধারে যান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এরপর তার সহযোগীরা উপস্থিতি টের পেয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে।
তারাও পাল্টা গুলি ছুড়লে হাসান ও মানিক গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়। এর আগে জিজ্ঞাসাবাদে ওই দু’জন জানায়, তাদের পরিবারের সদস্যরা ডাকাতি ছাড়াও বোমা তৈরির কাজে বেশ পারদর্শী। ডাকাত হাসান ঢাকা শহরে ৩টি বাড়ি করেছে। আর মানিকের রয়েছে দু’টি। কিছুদিন আগে আসামিরা জেলহাজত থেকে বের হয়। এরপর টাকার প্রয়োজনে ডাকাতি করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।
গত ১৫ দিন আগে তারা ডাকাতি করার জন্য চট্টগ্রাম শহরে চলে আসে। শহরের আখতারুজ্জামান সেন্টার, মিমি সুপার মার্কেট, বহর্দ্দার হাট, নিউ মার্কেট, ভিআইপি টাওয়ার এলাকার স্বর্ণের দোকানগুলোতে ডাকাতির উদ্দেশ্যে ঘুরে বেড়ায় সবাই। ফন্দি আঁটে। পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে। প্রতিটি মার্কেটে সিসি ক্যামেরা থাকায় এবং ডাকাতি করে পালানোর পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় ডাকাতির পরিকল্পনা বাতিল করে দেয়। পরে তারা নোয়াখালী জেলার মাইজদী ও কুমিল্লা জেলার স্বর্ণের দোকানকে টার্গেট করে। ওই সময় রাস্তায় ব্যাটারি চালিত টমটম অধিক থাকায় ডাকাতি করার পর মাইক্রোবাসযোগে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করা যাবে না বিধায় সেখানেও পরিকল্পনা বাতিল করে। সর্বশেষ গত শনিবার রাতে নগরীর আলকরণের প্রবেশমুখে হাজী দানু মিয়া সওদাগরের মালিকানাধীন অপরূপা জুয়েলার্স ও জুয়েলারি সমিতির সহসভাপতি রতন ধরের মালিকানাধীন গিনি গোল্ড নামের দোকানে ডাকাতি করে। যাওয়ার আগে তারা প্রচুর পরিমাণে বোমা ফাটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। ওই সব দোকানে ডাকাতি করার কারণ হিসেবে জানায়, সেখানের দোকানে সিসি টিভি ক্যামেরা না থাকায়, ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকায় ও প্রদর্শনীতে অধিক পরিমাণে গিনি স্বর্ণ থাকায় ওই স্থানে ডাকাতি করার সিদ্ধান্ত হয়। এ ঘটনায় ধরা পড়া আসামিদের মধ্যে মনির ককটেল সরবরাহকারী। অন্যদিকে হাসান, মানিক ওরফে কানা অস্ত্র সরবরাহ করে। আর ইমতিয়াজ উদ্দিন বাবুল মূল ঘটনার পরিকল্পনা করে।
ঘটনার পরপরই ডাকাত দলের সক্রিয় সদস্য অবৈধ অস্ত্রধারী ডাকাত ইমতিয়াজ হোসেন বাবুলের দেয়া তথ্য মতে, পুলিশ গত ১৫ই ডিসেম্বর রাতে ঢাকার খিলগাঁও থানা এলাকায় যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করে। সেখান থেকে ধরা পড়ে ডাকাত দলের পরিকল্পনাকারী ও অস্ত্রের জোগানদাতা হাসান জমাদার ও মানিক। এরপর তাদের স্বীকারোক্তি মতে, চট্টগ্রামের ইপিজেড থানার বন্দরটিলাস্থ সচিমালুম গলির নোমানের কলোনিতে অভিযান চালিয়ে সশস্ত্র ডাকাতদের আশ্রয়দাতা ও অস্ত্র হেফাজতকারী মো. ফয়সাল হোসেন, সাগর, হালিশহর থানাধীন মুইন্যাপাড়া এলাকা থেকে হালিম হাওলাদার, নয়ন, বন্দর থানাধীন ২নং মাইলের মাথাস্থ আজম বিল্ডিং-এ অভিযান চালিয়ে রুমা বেগম, রিয়াজকে ধরা হয়। তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায় ২টি বিদেশী পিস্তল, ১০ রাউন্ড পিস্তলের গুলি।
গতকাল ভোরে ফিরিঙ্গীবাজার ব্রিজঘাটস্থ কর্ণফুলী নদীর পাড় এলাকায় অভিযান চালায় পুলিশ। এতে তাদের সহযোগীদের সঙ্গে সশস্ত্র ও গুলিবিনিময় হয়। ঘটনাস্থলে পুলিশ টিমের একজন এসআই ও দু’জন কনস্টেবল গুরুতর আহত হন। পাওয়া যায় পলাতক আসামিদের ফেলে যাওয়া ১টি রিভলবার, ১টি বন্দুক, ৩ রাউন্ড পিস্তলের গুলি ও ৫ রাউন্ড কার্তুজ। ডাকাতির ঘটনায় ধরা পড়ে আরও ৩ নারী। তাদের নাম- রুমা বেগম, হাসিনা বেগম ও খোরশেদা আক্তার।
পুলিশ জানায়, ডাকাত মনিরের দুই স্ত্রী। এরা হলো জুলেখা বেগম ও খোরশেদা আক্তার। আর ডাকাত কালামের স্ত্রী হাসিনা বেগম (৩৪)। এরা সবাই বোমা বানানোর কারিগর। ঢাকার বিভিন্ন অভিজাত এলাকার বাসাবাড়ি ভাড়া নিয়ে তারা বোমা তৈরি করে। এসব বোমা সাপ্লাইয়ের কাজ থেকে এক-একজনের মাসিক আয় এক লাখ টাকার বেশি। নগর পুলিশের কোতোয়ালি জোনের সহকারী কমিশনার শাহ মো. আবদুর রউফ মানবজমিনকে বলেন, খুবই দুর্ধর্ষ ডাকাত সদস্যরা। ঢাকায় তাদের বাড়ি রয়েছে। অনেকের গাড়ি রয়েছে। মূলত এরা সবাই সারা দেশে চষে বেড়িয়ে ডাকাতি করে। স্বামীদের ডাকাতি করতে উৎসাহ যোগায়।