সম্প্রতি বাংলাদেশের গর্ব,নোবেল বিজয়ী ড.মো: ইউনূস বিশ্বের প্রধান প্রভাবশালী দশ ব্যাক্তির মধ্যে একজন( তালিকার ৫ নম্বরে)বিবেচিত হওয়ায় আমরা অত্যন্ত গর্বিত।.ড. ইউনূস এবং, গ্রামীণ ব্যাংককের কাজকে আমি ভালো এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। সেটা লিখি। স্বাভাবিকভাবেই সেটা ড. ইউনূসের পক্ষে যায়।
ড. ইউনূসকে পছন্দ করেন না, গ্রামীণ ব্যাংকের কাজকে একেবারে গুরুত্বহীন মনে করেন, দেশের জন্যে ক্ষতিকর মনে করেন- এমন মতামতের মানুষও আছেন। থাকতেই পারেন। তার কাজের সমালোচনাও করা যেতেই পারে এবং সমালোচনা হওয়া উচিতও। যারা ড. ইউনূসকে অপছন্দ করেন, বিষাদ্গার করেন, ঠিক কি কারণে- সেটা জানার, বোঝার চেষ্টা করছি বহুদিন ধরে। তারা যে অভিযোগগুলোর কথা বলেন-
১. ড. ইউনূস জাতীয় বিষয় নিয়ে কথা বলেন না।
২. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে কথা বলেন না।
৩. ড. ইউনূস সাম্রাজ্যবাদের দালাল।
৪. ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর ডিসেম্বর তিনি স্মৃতিসৌধে যান না। ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে যান না।
৫. ড. ইউনূস গরিবের রক্তচোষা। ৩২%-৪৫% সুদে ঋণ দেন। ক্ষুদ্র ঋণে কোনো উপকার হয় না।
৬. গ্রামীণ ব্যাংককে ব্যবহার করে প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন।
৭. তিনি বিদেশে টাকা পাচার করেছেন।
৮. গ্রামীণ টেলিকমের ১০ হাজার কোটি টাকার হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না।
৯. তিনি কর ফাঁকি দিয়েছেন।
এই কথাগুলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বিভিন্ন মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের নেতা ও গ্রামীণ ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান বিভিন্ন সময়ে বলেছেন। তাদের কথারই প্রতিধ্বনি শোনা যায় আওয়ামী ও সরকার সমর্থকদের একটি অংশের মধ্যে। তারা সামান্যতম কোনো যুক্তি দিয়ে বিবেচনা না করে, নেত্রী যেহেতু বিরোধিতা করেছেন, শুধুমাত্র সেই কারণেই এসব কথা বলেন। কেন বলছি এ কথা, তা বোঝানোর চেষ্টা করছি।
ক. যারা সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন, তারা আমাদের বিবদমান জাতীয় বিষয় নিয়ে কথা বললে একদল খুশি হবে, অন্যদল অখুশি হবে। তারা জাতীয় বিষয় নিয়ে কথা বললে তার প্রতিষ্ঠান ঝুঁকির মুখে পড়বে, পড়ে। সচেতনভাবেই তারা এই বিষয়টি এড়িয়ে চলেন। ড. ইউনূস, ফজলে হাসান আবেদ প্রমুখ যার উদাহরণ।
খ. জাতীয় বিষয় নিয়ে কথা বলায় কাজী ফারুকের বিশাল প্রতিষ্ঠান ‘প্রশিকা’ কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে- সেই নজীর তো আমাদের সামনে আছে। কাজী ফারুকের কথা, কাজ আওয়ামী লীগের পক্ষে গেছে। বিএনপি তাকে এবং তার প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের ব্যবস্থা করেছে।
গ. জনগণ ভোট দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে রায় দিয়েছে। সরকার বিচার করবে। মন্ত্রীরা অহেতুক কথা বলে যথেষ্ট বিতর্ক তৈরি করেছেন। ড. ইউনূস বা ফজলে হাসান আবেদ কথা বললে, আরও কিছু বিতর্ক তৈরি হবে। তাতে বিচারের কি উপকার হবে? আর তারা কি কথা বলবেন? সরকার বার বার বলেছে বিচার আমরা করবই, কোনো বিদেশি চাপ নেই। ড. ইউনূস কি কখনও বলেছেন, বিচার দ্রুত কেন করা হচ্ছে না?
তিনি তো বিচারের বিপক্ষে কোনো কাজ বা কথা বলেননি। অহেতুক কেন তাকে কথা বলতে হবে?
ঘ. বিশ্ব জনমত গঠনে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে ড. ইউনূস, ফজলে হাসান আবেদ পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আজ শহীদ মিনার বা স্মৃতিসৌধে না গেলেই তিনি অপরাধী হয়ে গেলেন? না গেলে হৃদয়ে ধারন করা যাবে না মুক্তিযুদ্ধ? বাংলাদেশের, আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, শুভানুধ্যায়ী অনেক মানুষ আছেন যারা শহীদ মিনার বা স্মৃতিসৌধে যান না বা যাওয়া হয়ে ওঠে না। এ দিয়ে কি প্রমাণ হয় তারা বাংলাদেশবিরোধী?
ঙ. এই মুহূর্তে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সুদের হার ১৬%-১৯%। গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার সর্বোচ্চ ২০%। গ্রামীণ ব্যাংক যেখানে ঋণ দেয়, যত অল্প টাকা ঋণ দেয়, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সুদের হার ৫০% হলেও সেটা করতে পারবে না। এটা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও স্বীকার করে। আর সরকারি ব্যাংকগুলো তো প্রায় দেউলিয়া হওয়ার পথে। গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ ফেরতের হার ৯৮% এর উপরে। ঋণ নিলে ঋণ ফেরত দিতে হবে না? রক্তচোষা হয় কি করে?
ক্ষুদ্রঋণে ২% দারিদ্র্য কমেছে, সেটা এখন সরকারি প্রতিষ্ঠানই বলছে।
চ. চাকরির বেতন ও অন্যান্য সুবিধা নেয়া ছাড়া ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক থেকে একটি টাকাও নেননি। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক বা শেয়ার হোল্ডারও নন। তিনি গ্রামীণ ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা নিয়েছেন, এটা ১০০% মিথ্যা প্রচারণা। বিদেশে টাকা পাচার করার যে অভিযোগ মতিয়া চৌধুরী করেছেন, সেটা শুধু মিথ্যাই নয়, মিথ্যার চেয়েও বড় মিথ্যা।
ছ. গ্রামীণ টেলিকমের ১০ হাজার কোটি টাকার অভিযোগের বিষয়টি সরকার বর্তমান চেয়ারম্যানের অনৈতিকতা ও মেরুদণ্ডহীনতার সুযোগ নিয়ে, তাকে দিয়ে জোর করে বলিয়েছে। এর কোনো সত্যতা নেই। সব টাকার হিসাব আছে। গ্রামীণ ব্যাংক কমিশন কোনো দুর্নীতি বা অনিয়মের প্রমাণ পায়নি। কমিশন যে রিপোর্ট দিচ্ছে না, তার কারণও দুর্নীতি না পাওয়া। রিপোর্ট দিলেই তো প্রমাণ হয়ে যাবে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হয়নি।
জ. ড. ইউনূস বিদেশ থেকে অর্থ আয় করেছেন। ব্যাংকিং চ্যানেলে সেই অর্থ দেশে এনেছেন। রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী কর মওকুফ সুবিধা চেয়েছেন। এনবিআর কর সুবিধা দিয়েছে। ‘ড. ইউনূস কর ফাঁকি দিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে’- মন্ত্রিসভায় আলোচনা করে এভাবে প্রচার করা হয়েছে। এনবিআরের যে প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে মন্ত্রিসভা আলোচনা করেছে, সেই প্রতিবেদনে এ বিষয়ক কথা নেই। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাকালে বিভিন্ন দেশ থেকে তার আয় এবং আয়কর অব্যাহতি কতটুকু বিধিসম্মত হয়েছে, তা পরীক্ষা করা দরকার।’
এই এনবিআরই কয়েক মাস আগে বলেছিল, কোনো অনিয়ম হয়নি। এখন বলছে ‘পরীক্ষা’ করা দরকার। সরকারের চাপে বলছে, সেটা পরিষ্কার। এনবিআর পরীক্ষা করবে তাতে আপত্তি থাকার কারণ নেই।
কিন্তু সরকারের আচরণ, মন্ত্রিসভায় আলোচনা, এনবিআরের প্রতিবেদন একরকম, বলা হচ্ছে আরেক রকম- এসব অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। এতে সরকার, শেখ হাসিনার ক্ষতি ছাড়া লাভ হচ্ছে না। ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার থেকে এমন আচরণ, সেটা দিন দিন স্বচ্ছ হয়ে যাচ্ছে।
ঝ. ড. ইউনূস এখন জাতীয় রাজনীতি নিয়ে কথা বলছেন। বিএনপির পক্ষে যাচ্ছে। আওয়ামী সমর্থকরা বলছে, তিনি কেন বিএনপির পক্ষে বলছেন? কথা বললে তো কারও পক্ষে যাবেই। তিনি যা ঠিক মনে করবেন তাই তো বলবেন। আপনি তাকে কথা বলতে বাধ্য করছেন কেন?
ঞ. অর্মত্য সেন জাতীয় বিষয়, মৌলবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেন, ড. ইউনূস কেন বলেন না। অর্মত্য সেন আর ড. ইউনূস এক বিষয় নয়। অর্মত্য সেনের প্রতিষ্ঠান নেই, ড. ইউনূসের প্রতিষ্ঠান আছে। অর্মত্য সেন আর ড. ইউনূসের কাজের ধারা সম্পূর্ণ আলাদা। অর্মত্য সেন যা করবেন, ড. ইউনূসকেও তাই করতে হবে- এটা খুবই অযৌক্তিক কথা। নজরুল কেন রবীন্দ্রনাথের মতো কবিতা লিখলেন না- এ জাতীয় একেবারে অহেতুক, অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা।
ড. ইউনূস মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পক্ষের লোক। হাসিনা-খালেদাসহ কেনা সাম্রাজ্যবাদের পক্ষের লোক? আমেরিকাকে এযাবতকালে যত সুবিধা, সব দিয়েছেন হাসিনা-খালেদা-এরশাদ, ড. ইউনূস নয়। আমেরিকার পক্ষে, এটা বর্তমান পৃথিবীর বাস্তবতা।
‘সুদখোর’? বর্তমান পৃথিবীর প্রায় সব মানুষ ‘সুদখোর’।
বি. দ্র. : যারা কূটিল নেতা-নেত্রীদের প্রতিহিংসাপরায়ণ চোখ দিয়ে ড. ইউনূসকে দেখছেন, তাদের কাছে অনুরোধ নিজের চোখ দিয়ে দেখুন, নিজের কান দিয়ে শুনুন, আর একটু কষ্ট করে ড. ইউনূস, গ্রামীণ ব্যাংক, ক্ষুদ্রঋণ সম্পর্কে জানুন। চোখের সামনে দেখবেন সব কিছু স্বচ্ছ হয়ে গেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীসভার বৈঠকে ডঃ ইউনুসের বিভিন্ন অনিয়ম এবং আয়কর ফাকির নজির সম্বলিত তদন্ত প্রতিবেদন(জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কৃত)পেশ করা হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী এনবিআর এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে অবিলম্বে ডঃ ইউনুসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
এই খবরটি শুনলে মনে হয় যেনো বাংলাদেশে বর্তমানে সবচেয়ে বড় এবং মারাত্বক সমস্যা হচ্ছে ডঃ ইউনুস এবং তার গ্রামীন ব্যাংক।ভাবতে লজ্জা হয় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং তার স্তাবককূল যেভাবে নোবেল জয়ী একমাত্র বাংলাদেশী মানুষটিকে অপমান আর পর্যুদস্ত করে চলেছেন তাতে তাদের সন্মান কমছে বই বাড়ছে না।যে জাতি নিজেদের বিশ্ববরেন্য ব্যক্তিত্বদের মর্যাদা দিতে জানে না বা দেয় না,সে জাতি বিশ্বের দরবারে অসভ্য ও বর্বর হিসাবে পরিচিত হয়।