ফয়েজ আহমদ। বয়স আনুমানিক ২৭। ছাত্র না হলেও ছাত্রলীগ ক্যাডার হিসেবে ঢাকা কলেজের হলে থাকেন তিনি। ছাত্রলীগের বিলুপ্ত হওয়া পল্লব-সুইম কমিটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ফয়েজ।
তিনি কলেজের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্র আসাদুজ্জামান ফারুক হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত দুই নম্বর আসামি। এই ফয়েজ বুধবার বকশিবাজারে পিস্তল হাতে বিএনপির মিছিলে গুলি করেন। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে তার ছবি ছাপা হয়। ছবিতে তাকে হাফহাতা গেঞ্জি ও জিন্সের প্যান্ট পরা দেখা গেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও বুয়েট খেলার মাঠের মধ্যবর্তী রাস্তায় অ্যাকশন ভঙ্গিতে একের পর এক গুলি ছুড়েন ফয়েজ।
তার সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘গুলি বর্ষণকারী যুবককে ছাত্রলীগকর্মী বলে মনে হয় না। তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ ফয়েজ ছাড়াও বুধবার বিএনপিকর্মীদের ওপর হামলা এবং গুলি বর্ষণের সঙ্গে জড়িত আরও বেশ কয়েকজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নির্দেশেই বিভিন্ন শাখার নেতাকর্মীরা এ হামলায় সশস্ত্র অংশ নেয় বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
ফয়েজ সম্পর্কে আরও জানা যায়, তার গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরে। তিনি ২০০১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষে একই কলেজের রসায়ন বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেন। তিনি কলেজের বিলুপ্ত কমিটির (পল্লব-সুইম) সভাপতি ফুয়াদ হাসান পল্লবের ডান হাত। কলেজের দক্ষিণ হলের ১১১ নম্বর কক্ষে পল্লবের সঙ্গেই অবৈধভাবে থাকেন। তার বিরুদ্ধে কলেজের প্রেসিডেন্ট ব্লকের হয়ে মাস্তানি ও চাঁদাবাজির অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ক্যাম্পাস ও নিউমার্কেট এলাকায় ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত এই ফয়েজ।
পাশেই অপর একটি স্থানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আল-নাহিয়ান খান জয়ের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ কর্মীরা ছাত্রদল কর্মীদের ওপর হামলা করে। এ সময় তার পাশেই দেখা গেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে। বকশিবাজার মোড় পেরিয়ে সংঘর্ষ মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। একটি ছবিতে জয়ের সঙ্গে সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোবারক হোসাইনকে বাঁশের খুঁটি হাতে দৌড়ে বিএনপিকর্মীদের পেটাতে দেখা গেছে। বেলা সোয়া ২টায় টিএসসিতে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে উচ্ছ্বাস করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সভাপতি আনিসুর রহমান আনিস।
২০১৩ সালের ৩০ নভেম্বর গভীর রাতে চাঁদাবাজির ঘটনায় কলেজের ছাত্রলীগ সভাপতি পল্লব ও সম্পাদক সাকিব হাসান সুইমের গ্র“পের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ হয়। গুলিতে মারা যান প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ছাত্র আসাদুজ্জামান ফারুক। ওই রাতেও ফয়েজকে অস্ত্র হাতে মুহুর্মুহু গুলি বর্ষণ করতে দেখা যায়। ঘটনার পর কলেজের ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। কিন্তু পল্লব ও ফয়েজ বীরদর্পে কলেজ নিয়ন্ত্রণ করে চলে। ছাত্রলীগের সব মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নেয় তারা। বুধবার বকশিবাজারে সংঘর্ষের আরও বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মীকে সশস্ত্র দেখা গেছে। তাদের মধ্যে একজন মুখে কাপড় বেঁধে পিস্তল হাতে ও আরেকজনের মাথায় হেলমেট ছিল।
গুলি করার সময় ফয়েজের পাশে ছিল (পেছনে নীল গেঞ্জি পরিহিত) শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রিফাত জামান, তার পাশেই লাল শার্ট পরিহিত রিফাতের কর্মী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ইমরান হোসেন রাজু, তার সামনে কালো চশমা পরিহিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মনিরুল ইসলাম, ডান পাশে নীল শার্টের ওপর সোয়েটার পরিহিত এসএম হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান পিকুলসহ কেন্দ্রীয়, বিশ্ববিদ্যালয় এবং হল পর্যায়ের ছাত্রলীগের আরও বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী।
অপর একটি স্থানে ছাত্রদল কর্মীদের উদ্দেশে ইট ছুড়তে দেখা গেছে জসীম উদ্দীন হলের ছাত্র এবং ঢাবি ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক এইচএম আল আমিন আহমেদকে। অপর একটি ছবিতে জহুরুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু হলের ছাত্রলীগ নেতা মেহেদী হাসানসহ বেশ কয়েকজন মিলে ছাত্রদলের কর্মীকে বেধড়ক পেটাতে দেখা গেছে। অপর একটি ছবিতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শিহাবুজ্জামান শিহাবকে হামলা থেকে ফেরানোর চেষ্টা করছেন আর্মড পুলিশ সদস্য।
সংঘর্ষকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি এইচএম বদিউজ্জামানের আশপাশে কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে সহ-সভাপতি জয়দেব নন্দী, এইচএম জিসান মাহমুদ, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক, হাসান তারেক, সমাজসেবা সম্পাদক কাজী এনায়েত, পরিবেশ সম্পাদক সাইফুর রহমান সোহাগ, ক্রীড়া সম্পাদক আবিদ আল হাসান, সহ-সম্পাদক আসাদুজ্জামান নাদিমসহ বেশ কয়েকজনকে দেখা গেছে। একটি ছবিতে ছাত্রদলের কর্মীকে ছাত্রলীগের কর্মী স্যান্ডেল পায়ে মাথায় পা দিয়ে ধরে আছে। ক্যামেরায় তার চেহারা না আসায় ওই কর্মীর নাম জানা যায়নি।
ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান মোল্লা এবং সাধারণ সম্পাদক ওমর শরীফের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন হল শাখার তিন শতাধিক কর্মী সহিংসতায় অংশ নেয়। ছাত্রলীগ নেতারা সশস্ত্রভাবে বিএনপির মিছিলে হামলা করলেও তাদের একজনকেও শাহবাগ কিংবা চকবাজার থানার মামলায় আসামি করা হয়নি।
বৃহস্পতিবার রাতে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ছাত্রলীগের কোনো কর্মী লাঠি নিয়ে বা অস্ত্র নিয়ে হামলায় অংশ নিয়েছে বলে আমার জানা নেই। আমি আপনাদের (সাংবাদিক) কাছ থেকে শুনেছি। হামলায় লাঠি নিয়ে অংশ নেয়া অনেকেই ছাত্রদল ও বিএনপির কর্মী ছিল। যারা সশস্ত্র হামলা করেছে তাদের কেউ ছাত্রলীগ বলে আমার মনে হয় না। এরপরও ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। যদি ছাত্রলীগেরও কারও জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।