অত্যাধুনিক কোনো যন্ত্রাংশে নয়, সাধারণ কিছু লোক দেশীয় প্রযুক্তির এক ধরনের লোহার খাঁচার মতো 'ক্যাচার' পাইপে নামিয়ে উদ্ধার করেছে শিশু জিহাদের মরদেহ। রাজধানীর শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির পরিত্যক্ত পানির পাইপ থেকেই শনিবার বিকালে সাড়ে তিন বছর বয়সী জিহাদকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।
টানা ২৩ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস অভিযানটি ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে যখন স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছিল, তার পরপরই স্থানীয় কয়েকজন তরুণ নিজেদের মেধা কাজে লাগিয়ে গভীর পাইপের তলদেশ থেকে তুলে এনেছে জিহাদকে। এদিকে ঘটনা জানাজানির পর থেকেই শ্বাসরুদ্ধকর ছিল প্রতিটি মুহূর্ত। সবার দৃষ্টি গভীর নলকূপের সেই পাইপের দিকে। যেখানে কয়েকশ' ফুট গভীরে পড়েছে সাড়ে তিন বছর বয়সী জিহাদ। কী অবস্থায় আছে? বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে? আদৌ তার অবস্থান শনাক্ত বা উদ্ধার সম্ভব হবে কিনা।
কেবল শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনি নয়, সারা দেশের মানুষই তাকিয়ে ছিল উদ্ধার অভিযানের দিকে। কিন্তু দুপুর সোয়া ২টার দিকে ঘটনাস্থলের পাশেই যখন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে বললেন- 'পাইপটির ভেতরে কোনো শিশু বা প্রাণীর অস্তিত্ব না পাওয়ায় উদ্ধার অভিযান স্থগিত করা হলো।' তাৎক্ষণিক হতাশার সৃষ্টি হয় সবার মাঝে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধার সরঞ্জাম গুছিয়ে নিতে শুরু করেন।
হঠাৎ চারদিকে শোরগোল পড়ে যায়- 'জিহাদকে উদ্ধার করা হয়েছে।' সেই পাইপ থেকেই, যেখানে কোনো শিশু বা প্রাণীর অস্তিত্ব নেই বলে সংবাদ সম্মেলন জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। জিহাদ উদ্ধার হওয়ার পরপরই রেলওয়ে কলোনিসহ সারা দেশেই নেমে আসে শোকের ছায়া। কেবল স্বজন বা প্রতিবেশী নয়, উপস্থিত উৎসুক হাজারো মানুষ সেখানে আবেগে কান্নায় ভেঙে পড়েন। পাশাপাশি উপস্থিত জনতা উদ্ধার অভিযানে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশসহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের অবহেলা বা আন্তরিকতার অভাবের অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ শুরু করেন।
অমানবিকভাবে কূপে পড়া জিহাদের বাবা নাসিরউদ্দিনকে থানায় আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে উত্তেজিত জনতা। কলোনির সুপার মার্কেটের কিছু দোকান ও টিনশেড ঘরে ভাংচুর চালান তারা।
হঠকারী সিদ্ধান্ত ও উদ্ধার তৎপরতায় গাফিলতির অভিযোগ তুলে তারা স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পদত্যাগ দাবি করেন। বিক্ষুব্ধরা সেখানে জুতা-স্যান্ডেল হাতে উঁচিয়ে স্লোগান দিয়ে মিছিল করেন। জিহাদকে উদ্ধারের পর সেই মৃত্যুকূপটিও সিলগালা করে তথা ওপরে লোহার ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
যেভাবে উদ্ধার হলো জিহাদ : ফায়ার সার্ভিসের টানা ২৩ ঘণ্টা ব্যর্থ অভিযারে পর সাধারণ জনগণের সমন্বয়ে গঠিত উদ্ধার দলটি কাজে নামার আধা ঘণ্টার মধ্যেই পেয়ে যায় ফলাফল। এই উদ্ধারকারী দলে ছিলেন ফারুক হোসেন, বশির আহমেদ, সুজন দাস, শাহ মোহাম্মদ আবদুল মুন, আনোয়ারসহ বেশ কয়েকজন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, স্থানীয় ব্যবসায়ী, স্কুল-কলেজের ছাত্র ও মোটর মেকানিকের সহায়তায় তৈরি করা 'ক্যাচার' পাইপের ভিতর নামিয়ে দেয়া হয়। ২৩৪ ফুট নিচে ভারি কোনো বস্তুর সঙ্গে ক্যাচারটি আটকে গেলে স্বেচ্ছাসেবীরা চিৎকার করতে থাকেন। উপরে তুলতে গিয়ে দেখেন যে ক্যাচারের ওজন ১২ কেজি ১৪ কেজি বেড়ে গেছে। ক্যাচারের সঙ্গে বাঁধা রশি ধরে স্বেচ্ছাসেবীরা টানতে থাকেন। এক পর্যায়ে পাইপের মুখের কাছাকাছি আসার পর ক্যাচারের ভেতর জিহাদকে দেখতে পান। তখনই সবাই 'উদ্ধার হইছে' বলে চিৎকার করতে থাকেন।
উদ্ধার প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়া ফারুক হোসেন বলেন, শনিবার সকালে খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নির্মাণাধীন অংশ থেকে তারা রড সংগ্রহ করেন। পরে ফ্লাইওভারে যারা কাজ করছিলেন, ওইসব শ্রমিকের সহযোগিতায় ঢালাই দিয়ে এর মাথায় আংটার মতো অ্যাঙ্গেল জোড়া লাগানো হয়। অপর স্বেচ্ছাসেবী আনোয়ার এর মাথায় ক্যামেরা বসান। পরে দড়ির সঙ্গে বেঁধে তারা যন্ত্রটিকে পাইপের ভেতর নামিয়ে দেন। পাইপের গভীরে ঢোকানোর পর তারা খোঁজ পান শিশু জিহাদের। এরপর রডের মাথায় লাগানো আংটার সাহায্যে শিশুটিকে বের করে নিয়ে আসা হয়। এই উদ্ধার অভিযানে তাদের সঙ্গে আরও ছিলেন বশির নামের একজন। তিনি আগের রাতেই ওই পাইপের ভেতর নামতে চেয়ে আলোচিত হয়েছিলেন। উদ্ধারকারীদের অন্যতম শাহ মোহাম্মদ আবদুল মুন বলেন, তারা শুক্রবার রাত থেকেই সংগঠিত হচ্ছিলেন। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তাড়না থেকেই তারা এ উদ্যোগ নেন।
জিহাদকে মৃত ঘোষণা : জিহাদকে উদ্ধারের পরপরই দ্রুত পুলিশের পিকআপ ভ্যানে করে নেয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। সেখানে বেশকিছু সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক রিয়াজ মোরশেদ বিকাল ৪টার দিকে জিহাদকে মৃত ঘোষণা করেন। ডা. রিয়াজ মোরশেদ বলেন, শিশুটি বেশ কয়েক ঘণ্টা আগেই মারা গেছে।
বাকরুদ্ধ মা-বাবা, শোকের ছায়া : দুই ছেলে জিসান ও জিহাদ, এক মেয়ে স্বর্ণা ও স্ত্রী খাদিজা বেগমকে নিয়ে সুখের সংসার রেলওয়ে কলোনির নৈশ প্রহরী নাসিরউদ্দিনের। ঘটনাস্থলের পাশেই রেলওয়ে কলোনির ৪১ নম্বর বিল্ডিংয়ের দোতলায় তারা সপরিবারে থাকেন। শনিবার সরেজমিন ওই বাসায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে শোকের অন্ধকারের ছায়া। বাসায় কান্নার রোল। আদরের ছোট ছেলে জিহাদকে হারিয়ে শোকে বাকরুদ্ধ মা খাদিজা ও বাবা নাসিরউদ্দিন। ভাই-বোনও আদরের ছোট জিহাদকে হারিয়ে পাগলপ্রায়। জিহাদের বাবা নাসির উদ্দিন অভিযোগ করেন, শুক্রবার রাতে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যের পর উদ্ধার কাজে ভাটা পড়ে। এ কারণেই তার ছেলেকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
ফায়ার সার্ভিসের সংবাদ সম্মেলন : জিহাদকে উদ্ধারের কয়েক মিনিট আগেই শনিবার দুপুর আড়াইটায় ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান ঘটনাস্থলের পাশেই সংবাদ সম্মেলনে উদ্ধার অভিযান স্থগিতের ঘোষণা দেন। এসময় তিনি বলেন, ১৪ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপের ভেতরে ক্যামেরা ঢুকিয়ে যে ছবি তোলা হয়েছে, তাতে কোনো মানবদেহের অস্তিত্ব থাকার প্রমাণ মেলেনি।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও বলেছিলেন পাইপে শিশু নেই : ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে উদ্ধার কাজের তদারকি করা অবস্থায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শনিবার ভোররাতে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, উদ্ধারকর্মী দলের সঙ্গে কথা বলে তার ধারণা হয়েছে যে পাইপের ভেতরে শিশুটি নেই। তবে শনিবার বিকালে আবার একটি অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রাখতে বলেছিলেন তিনি।