ঘটনা-১ : বুধবার রাত সোয়া ১১টা। রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর-সংলগ্ন শাহ্ আলী মার্কেটের সামনে থেকে জাহাঙ্গীর আলম ও তার চাচাতো ভাই বাবুল আহমেদকে আটক করে পুলিশ। তারা সেখানে গাড়ি চুরির প্রস্তুতি নিয়েছিলেন এমন অভিযোগে পুলিশ তাদের আটক করলেও পরে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে তাদের আদালতে পাঠানো হয়। তাদের আইনজীবী শামীম রেজা জানান, ওই যুবকদের বাসা ঘটনাস্থলের পাশেই। তারা রাতে বাসা থেকে বের হয়ে পাশেই একটি মুদিদোকানে যাচ্ছিলেন।
ঘটনা-২ : মঙ্গলবার সন্ধ্যা। রাজধানীর পল্টন থানা এলাকায় একটি আবাসন কোম্পানির কর্মচারী আরিফ আহমেদ (ছদ্মনাম) হেঁটে বাসায় ফিরছিলেন। এ সময় টহল পুলিশ তাকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। ভুক্তভোগীর পরিবার পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি তাদের উপকমিশনারের (ডিসি) সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। সেখানে গেলে ডিসি উল্টো তাদের ওসির সঙ্গে কথা বলতে বলেন। একপর্যায়ে আরিফকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়।
তবে এসব বিষয় অস্বীকার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, 'রাজধানীতে গণগ্রেফতারের বিষয়টি সঠিক নয়। গ্রেফতার একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকলে, নিয়মিত মামলা থাকলে, কিংবা কোনো অপরাধে কেউ জড়িত থাকলে আমরা তাদের গ্রেফতার করি।'এ তো গেল মাত্র দুটি ঘটনা। এ রকম বহু ঘটনা চলছে দেশের প্রায় সব কটি জেলায়।
৫ জানুয়ারি ঘিরে সারা দেশে শুরু হয়েছে পুলিশের গণগ্রেফতার অভিযান। এ অভিযানে আন্দোলনরত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীই নন, সাধারণ মানুষও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ইতিমধ্যে ঢাকার সব প্রবেশমুখে একাধিক চেকপোস্ট ও নিরাপত্তা-চৌকি বসানো হয়েছে। চলছে কড়া তল্লাশি। পুলিশের জেরার মুখে পড়তে হচ্ছে পথচারীদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, পল্টন, মতিঝিল, রমনা, বংশাল, দারুসসালাম, মোহাম্মদপুর ও মিরপুর থানায় গতকাল শতাধিক সন্দেহভাজনকে আটক করা হয়। এদের সবাইকে ডিএমপি অধ্যাদেশ ও ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
গণগ্রেফতারের এ সুযোগে পুলিশের বিরুদ্ধে গ্রেফতার বাণিজ্যের অভিযোগও পাওয়া গেছে। এ ছাড়া জেলাগুলোতেও পুলিশ ব্যাপক তৎপর। অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক অভিযান চলছে। বস্তি, আবাসিক এলাকা, বিভিন্ন মেস, আবাসিক হোটেল ও বিভিন্ন টার্মিনালে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে। পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, নাশকতা রোধে তারা এ অভিযান চালাচ্ছেন। পুলিশের ভয়ে বিরোধী দলের অনেক নেতা-কর্মী আবারও ঘরছাড়া হয়েছেন।
সূত্র জানায়, জামায়াতের হরতাল ও ৫ জানুয়ারি বিএনপির কর্মসূচি সামনে রেখে দুই দিন ধরেই চলছে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশি অভিযান। গ্রেফতারও হচ্ছেন অনেকে। পুলিশ সূত্র জানায়, জোরালো অভিযান চলছে রাজধানী ঢাকা, সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা, বগুড়া, চট্টগ্রাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নওগাঁ, মুন্সীগঞ্জ, পাবনা, যশোর, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা, লক্ষ্মীপুর, নীলফামারী, নেত্রকোনা, রংপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুর, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, চুয়াডাঙ্গা ও নোয়াখালীতে। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, নাশকতা প্রতিরোধে রাজধানীসহ সারা দেশে পুলিশের অভিযান চলছে।
এ ছাড়া গ্রেফতারি পরোয়ানাসহ বিভিন্ন মামলায় অভিযান অব্যাহত রয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন থানায় গতকাল গ্রেফতার করা হয়েছে ৮০ জনকে। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, সরকারের বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে ৫ জানুয়ারি সামনে রেখে সরকারবিরোধী জোট রাজনৈতিক ময়দান উত্তপ্ত করার পাঁয়তারা করছে। এমনকি তারা বড় ধরনের নাশকতা সৃষ্টি করতে পারে।
সরকারকে ঘায়েল করতে রাজনৈতিক দলগুলো জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদেরও ব্যবহার করবে। যে কোনো আশঙ্কা উড়িয়ে না দিয়ে প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে বলেছে সরকারের শীর্ষ মহল। ঢাকাসহ সারা দেশে তালিকার নাম ধরে ধরে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। তালিকায় প্রায় ২ হাজার ৫০০ জনের নাম রয়েছে বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এ তালিকায় বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের পাশাপাশি জেলা, থানা, উপজেলা ও ওয়ার্ড বা মহল্লার নেতা-কর্মীদের নাম আছে। পাশাপাশি দুর্ধর্ষ অপরাধী ও জঙ্গিদের নাম রয়েছে। ইতিমধ্যে তালিকা নিয়ে ৬৪ জেলায় চলছে পুলিশের অভিযান।
তালিকাভুক্ত দুর্বৃত্তদের পারিবারিক পরিচয়, শিক্ষাগত যোগ্যতা, মামলার সংখ্যা ও কোন কোন কাজে তারা পারদর্শী এবং কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত বা আগে কোন দল করেছে বিবরণ রয়েছে তালিকায়।র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহ্মুদ খান জানান,র্যাব কখনো গণগ্রেফতার করে না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও প্রমাণ থাকলেই তখন আটক করে থানায় হস্তান্তর করা হয়।