(সঙ্গত কারনে লেখকের নাম প্রকাশ করা গেলো না-স.প্র.বা.) গত সপ্তাহে কয়েকবার ক্ষমতায় যাওয়া বর্তমানে বিরোধী দল বিএনপি গাজীপুরে ভাওয়াল বদরে আলম কলেজে সমাবেশ করার জন্য অনুমতি চায়। প্রশাসন অনুমতি দেয় কিন্তু ছাত্রলীগ ঐ সমাবেশ করতে দিবে না বলে পুলিশের সহযোগিতায় মঞ্চ দখল করে। আমি ভাওয়াল কলেজের সাবেক ছাত্র ও গাজীপুর চৌরাস্তা এলাকায় আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকায় আমার ঐ এলাকায় ভালই প্রভাব প্রতিপত্তি আছে। আমরা যে কোন মূল্যেই সমাবেশ করব বলে শপথ নিলাম। আমাদের সাথে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ছিল।
সমাবেশ হওয়ার চার পাঁচ দিন আগে থেকে আমরা বিএনপির নেতা কর্মীরা রাতে বাসায় থাকতাম না। কারন যেকোন মুহুর্তে গোপালী পুলিশ হামলা করতে পারে। আমি বৃহস্পতিবার রাতে আমার দোকান বন্ধ করে বাড়ীর দিকে যাত্রা করি। আমার সাথে আমার দোকানের একজন কর্মচারী ছিল। আমরা মটর সাইকেলে ছিলাম। বাড়ী গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে আমি রাতে থাকার উদ্দেশ্যে গাজীপুর শহরের একটি বাড়ীতে রাত যাপন করার উদ্দেশ্যে বের হব- এটা আমাদের প্ল্যান ছিল। কিন্তু দোকান থেকে বের হবার কিছুক্ষন পরে আমাকে গাড়ীর সামনে হঠাত একটা মাইক্রো থামে। আমি বুঝে গেলাম ভিতরে গোপালী পুলিশ। এখান থেকে পালাতে হবে। মটর সাইকেল উলটা দিকে ঘুরালাম। দেখি পেছনেও একটা মাইক্রো, সেখান থেকে ইতি মধ্যে কিছু লোক নেমে গেছে। একজন আমার গাড়ীর সামনে দাঁড়াল। আমি বুঝলাম এখন আর পালাবার চেষ্টা করে লাভ নেই। পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করবেই। পালাতে গেলে পেছন থেকে গুলি করলে বাঁচার সম্ভাবনা খুব কম। এখন তো পুলিশের আর বুলেটের হিসাব দিতে হয় না।
আনুমানিক ঘন্টা খানেক পরে আমাকে আরেকটা গাড়ীতে ওঠানো হল। আগের লোকগুলি এখন নেই। এরা সবাই চুপচাপ, কেউ কথা বলছে না। গাড়ী জুড়ে একটা ভূতুড়ে নীরবতা বিরাজ করছে। আমি মনে মনে যত দোয়া জানি তা আওড়াতে লাগলাম। বার বার আমার মেয়ের ছবি ভেসে আসছিল। আমার ছোট ছেলেটা যার জন্মের সময় আমি জেলে ছিলাম তার কথাও মনে পড়ল।
বার বার আমার মনে একটা কথাই মনে আসছে- আজ কি আমাকে ক্রস ফায়ারে দেয়া হবে?ওদের কারো গায়ে ইউনিফর্ম পরা ছিল না। গাড়ীতে ঢুকিয়েই আমার চোখ বাঁধা হল। আমি এর আগে চার বার গ্রেফতার হয়েছিলাম। নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে হয়। কিছু মামলাও ঝুলে রয়েছে। সুতরাং পুলিশে ভয় পাই না। এছাড়া রাজনীতি করতে গেলে পুলিশে ধরবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এইবারই একটু অন্য রকম মনে হয়েছিল। এর আগে কখনো আমার চোখ বাঁধা হয় নি। চোখ বাঁধার পরে আমি আসলেই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আবার ক্রস ফায়ারে না দেয়! আমার মোবাইল সীজ করা হল। গাড়ীর ভেতরের লোক গুলোর কথা শুনতে পাচ্ছি। আমার মোবাইল থেকে কিছু নম্বরে ফোন করা হল। তার মানে আমার নম্বর থেকে কিছু কিছু লোককে ট্রেস করার চেষ্টা চলছে। অবশ্য চেষ্টা করে লাভ নেই। কাউকে খুঁজে পাবে না।
মঈন ইউ আহমেদের আমলে একবার আর্মী ধরেছিল। এক মেজর আমার কাছে ৫০ কোটি টাকা দাবী করেছিল। তার ধারনা আমি বিএনপি আমলে কন্ট্রাক্টরি করে অনেক টাকা কামিয়েছি। ৫০ কোটি টাকা না দিলে আমাকে ওরা খুন করবে বলেছিল। শেষমেষ ঐ আর্মি অফিসারকে ২ কোটি টাকা দিলাম। এ জন্য আমাকে ভাওয়াল কলেজের সামনের একটা পৈত্রিক জমি বিক্রি করতে হয়েছিল।
এবার যদি টাকা চায় তাহলে আমার দেয়ার মত কিছু নেই। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসে আমার ফার্স্ট ক্লাস কন্ট্রাক্টারীর লাইসেন্স বাতিল করেছে। চৌরস্তার দু’টি দোকান ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে যেখানে প্রায় দশ কোটি টাকার মত মালামাল ছিল। অবশ্য মঈন ইউ আহমেদের আমল থেকে শিক্ষা নিয়ে আমি আমার ছোট বোনকে এক আর্মি অফিসারের সাথে বিয়ে দিয়েছি যাতে ভবিষ্যতে উপকারে লাগে। সে এখন সিনিয়ার মেজর, পোষ্টিং রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টনমেন্টে। তার মাধ্যমে এক কর্ণেলের সাথে ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠে। উনিও একই জায়গায় ডিউটি করছেন।
অনেকক্ষন পরে আমাকে আরেকটা গাড়ীতে ওঠানো হল। মাঝখানে গাড়ী ঘন্টাখানেক বন্ধ ছিল। নতুন গাড়ীতে উঠে টের পেলাম আমার সাথে আরো কিছু বন্দী রয়েছে। কেউ ভয়ে কথা বলছে না। একজন বন্দী কাশি দিল। কাশির শব্দটা খুব পরিচিত মনে হল। সম্ভবত তার বাড়ী টঙ্গী, সরকার বাড়ীর ছেলে। টঙ্গী সরকারী কলেজের ছাত্র সংসদের একজন। এবার আমার টেনশন আরো বেড়ে গেল। কয়েকজন বন্দীকে নিয়ে তারা কী করবে? আমাকে যেখান থেকে ধরেছে সেখান থেকে থানার দূরত্ব বেশি হলে বিশ মিনিট অথচ আমাদের ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তায় ঘোরানো হচ্ছে। আমার ডায়াবেটিস আছে, নির্দিষ্ট সময় না খেলে শরীর কাঁপে। গত এক ঘন্টা ধরে আমার শরীর কাঁপছে। এর আগে জেলে থাকার সময় আমার সময়ের হিসাব মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। এখন বলতে পারি আমাকে কতক্ষন কোন গাড়ীতে রাখা হয়েছিল।
আমাদেরকে গাড়ী থেকে নামতে বলা হল। চোখ বাঁধা অবস্থায় গাড়ী থেকে নামতে হলে কারো না কারো সাহায্য নিতে হয়। আমাদের একজন লোক ধরে নামাচ্ছে। আমার একটা সন্দেহ হল! সন্দেহ প্রমানের জন্য আমি যে আমাদের গাড়ী থেকে নামাচ্ছিল কৌশলে তার মাথায় হাত রাখি। আমার ধারনা সঠিক হল- এই লোকের মাথার চুল আর্মি স্টাইলে ছাঁটা। তবে কি আমাদেরকে সেনানিবাসে আনা হল? আমাদের যতক্ষন গাড়ীতে চড়ানো হল সেই দূরত্ব আন্দাজ করলে রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাসই মনে হল। আমি বললাম “বাথরুমে যাব”
কোন উত্তর এলোনা । কিছুক্ষন পরে একজনের পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। রুমে নতুন কেউ ঢুকেছে। আমাদের সাথে থাকা পাহারাদার ওনাকে আমার কথা জানাল। কিন্তু ততক্ষনে ওদের কথা বার্তা শুনে আমার মনে হল আমাদের আর্মির কাছে রাখা হয়েছে। আমি বললাম “কর্ণেল ওমুক আমার আত্মীয়। আমি ওনার সাথে দেখা করতে চাই”
কোন উত্তর এলো না।
অনেকক্ষন পরে একজন লোকের শব্দ টের পেলাম। কে যেন বলল “উনি কর্ণেল অমুকের আত্মীয়”
এদিকে আমার পরিবারে আমি বলে রেখেছি আমাকে যদি কখনো পাওয়া না যায় তাহলে থানায় খোঁজ নেয়ার জন্য। সদর থানার দুই এসআই আমার খব কাছের মানুষ। র্যাবের নম্বর ও সেই কর্ণেল সাহেবের নম্বরে ফোন দিতে।
দুই দিন পরে আমাকে আমার বাসার কাছে এনে ছেড়ে দেয়া হয়।
মুক্তি পাওয়ার পরে জানতে পারলাম আমি সহ গাজীপুরের প্রায় শখানেক নেতা কর্মীকে পুলিশ ধরে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। বিএনপি নেতাদের সাথে দর কষাকষি করে আমাদের মুক্তির ব্যপারে। ওদের দাবী ছিল একটাই- যেকোন মূল্যে গাজীপুরের সমাবেশ বাতিল করতে হবে। সমাবেশ করতে গেলেই আমাকে সহ অনেক নেতা কর্মীকে খুন করে ফেলা হবে। আমার পরিবার রাতেই বিএনপি নেতা হান্না শাহ, সালাহউদ্দিন সরকার, মেয়র মান্নান, আমার ভগ্নীপতি মেজর সাহবে সবাইকে জানায়।
ভোর রাতে বিএনপির হাই কমান্ড জানতে পারে আমাদের গুম হবার খবরটি। সারা দিন বিএনপির অফিসে দফায় দফায় বৈঠক হয়। রাতে ২০ দল বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেয় শখানেক প্রাণ বাঁচানোর জন্য আপাতত বিএনপি কোন একশনে যাবে না। এভাবে বিএনপির কর্মীদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়া হল। মানুষ ভেবেছে বিএনপি একটা অকর্মার দল। কিন্তু আসল ঘটনা খুব কম লোকই জানে।