গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সংকল্পবদ্ধ বিএনপি। ৫ জানুয়ারির ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবসের’ কর্মসূচি পালনে বদ্ধপরিকর ‘বারবার ব্যর্থ হওয়া’ বিএনপি। ওই দিন শান্তিপূর্ণভাবে ‘সফল’ কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে যে কোনো মূল্যে ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে চায় দলটি। দিকভ্রান্ত অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আর পালিয়ে থেকে সরকারপক্ষের আঘাত নীরবে সহ্য করবে না বিএনপি। কর্মসূচি সফল করতে বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোট নেত্রী খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারি সকাল ১০টায় যে কোনো প্রকারে নয়াপল্টনে আসবেন বলেও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান কর্মসূচি পালনে দলের প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবসে দলের পক্ষ থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করা আছে। নেতাকর্মীরা এ কর্মসূচি পালনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমরা কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালন করতে চাই। আমি আশাবাদী মানুষ। আশাকরি সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। আমাদের কর্মসূচিতে তারা বাধা সৃষ্টি করবে না।’
২০ দলীয় জোট শরিক লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, ‘৫ জানুয়ারি কর্মসূচি পালনে আমাদের জোট নেত্রী রাজপথে থাকার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা নেত্রীর নির্দেশমতো যে কোনো মূল্যে ও ত্যাগের বিনিময়ে ওই দিন রাজপথে থাকব।’বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, নতুন বছরে নতুন করে সরকারবিরোধী আন্দোলনে আঘাত এলেই পাল্টা আঘাতের নীতিগত সংকল্প আছে দলটির নেতাকর্মীদের। জোটের শরিক জামায়াত-শিবির ও অন্যরাও সক্রিয় অংশগ্রহণের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে। দিনটির বিশেষত্ব হচ্ছে- গণতন্ত্র হত্যা দিবসকে কেন্দ্র করে ওই দিনই ঢাকার রাজপথে নামতে পারেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সরকারের অনুমতি না মিললেও ওই দিন নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে বড় ধরনের সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। তার এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দল ও জোটের সিনিয়র নেতাদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনাও দিয়েছেন ২০ দলীয় জোট নেত্রী।
৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম বর্ষপূর্তি। দিনটিকে ক্ষমতাসীনরা ‘গণতন্ত্র রক্ষা দিবস’ হিসেবে উদযাপনের পূর্ণপ্রস্তুতি ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে। রাজধানীর মোট ১৬টি স্থানে ওই দিন এলাকাভিত্তিক সমাবেশ ও মিছিল করবে আওয়ামী লীগ। একই দিনকে ভোটারবিহীন প্রহসনের নির্বাচন অভিধা দিয়ে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা আগেই দিয়েছে বিএনপি। সারাদেশে কালোপতাকা মিছিল ও সমাবেশ করার পাশাপাশি ঢাকায় বড় ধরনের সমাবেশ করার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলটি।
এদিকে, ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ উপলক্ষে রাজধানীতে জনসভা করতে ঢাকার তিনটি স্থানের জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাছে আগেই আবেদন করেছে বিএনপি। গত ২২ ডিসেম্বর এ অনুমোদনের জন্য দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে ডিএমপির কাছে পত্র দেয়। অনুমতির বিষয়ে জানতে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল ডিএমপির কার্যালয়ে যায়। তবে পুলিশের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা তাদের সঙ্গে দেখা না করলে তারা ফিরে আসেন। সর্বশেষ শনিবার দুপুরেও বিএনপির প্রতিনিধি দল যায় ডিএমপি কার্যালয়ে। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুল আউয়াল মিন্টু, প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবদিন ফারুক ও সহ-দফতর সম্পাদক আব্দুল লতিফ জনি প্রায় ৪০ মিনিট অপেক্ষা করেন। এ সময় তাদের চা-পান করিয়ে আপ্যায়ন করা হলেও সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা তাদের সঙ্গে দেখা করেননি।
এ ব্যাপারে বিএনপির প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, ‘৫ তারিখের সমাবেশের অনুমতির জন্য আমরা ডিএমপি কার্যালয়ে গিয়েছিলাম। ইজতেমার কারণে কোনো দায়িত্বশীল কর্মকর্তা উপস্থিত নেই বলে আমাদের জানানো হয়েছে। আমরা জানিয়েছি, ইজতেমা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের সমাবেশও তেমনি গুরুত্বপূর্ণ।’
এর আগে ৫ জানুয়ারিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ আখ্যা দিয়ে যে কোনো মূল্যে রাজধানীতে জনসভার ঘোষণা দেয় বিএনপি। বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে শুক্রবার বিকেলে এক জরুরী সংবাদ সম্মেলনে দলের পক্ষ থেকে এ ঘোষণা দেন দলটির যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ।
ওই দিনই (শুক্রবার) সকালে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শেরেবাংলা নগরের মাজারে ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর ৫ জানুয়ারি কর্মসূচি পালনে দলের নেতাকর্মীদের মাঠে থাকার ঘোষণা দেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান। তিনি বলেন, ‘৫ জানুয়ারিতে ঢাকায় গণতন্ত্র হত্যা দিবসের সমাবেশ করব। অনুমতি দেবে কি দেবে না, তা সরকারের বিষয়। আমাদের যা করণীয়, তা আমরা করব।’ আবার শুক্রবারই বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি আলোচনা সভায় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সিনিয়র আইনজীবী এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘৫ জানুয়ারি হবে গণতন্ত্রের নতুন অভিযাত্রা। সরকার এতে বাধা দিলে সেদিন থেকেই শেষ খেলা শুরু হবে।’
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ পালন করতে ঢাকায় বিকল্প ৩ ভেন্যুর অন্তুত একটিতে পূর্বনির্ধারিত জনসভা করতে মরিয়া দলটি। এ জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতির পাশাপাশি নেতাকর্মীদের রাজপথে থাকতে ‘গোপন ও কঠোর’ নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। এক্ষেত্রে দলের কর্মপরিকল্পনায় তিনটি বিকল্প নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপি।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়ক অথবা মতিঝিলের শাপলা চত্বর। তিন স্থানের যে কোনো একটিতে জনসভার জন্য গত ২২ ডিসেম্বর বিএনপির পক্ষ থেকে অনুমতি চেয়ে ডিএমপিতে আবেদন করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত অনুমতি দেওয়া হয়নি।
জানা গেছে, ৫ জানুয়ারিতে মাঠে থাকতে প্রতিটি থানা ও ওয়ার্ডকে এরই মধ্যে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। এই কর্মসূচিতে মাঠে থাকাই মহানগরের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিতে মহানগর বিএনপি ছাড়াও ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দলসহ সব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রস্তুতির অংশ হিসেবে স্থগিত করা হয় শুক্রবার সোহরাওয়ার্দীতে ছাত্রদলের সমাবেশ। কেন্দ্র ছাড়াও দেশের সব মহানগর, জেলা ও উপজেলা নেতাদের ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বাত্মক সতর্ক থাকতে তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘দৃঢ়তার সঙ্গে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে আমরা বলতে চাই, ৫ জানুয়ারি আমরা কর্মসূচি করবই। আমরা বারবার অঙ্গীকার করছি, ৫ জানুয়ারি ২০ দলীয় জোটের জনসভা হবে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। আমরা এ জনসভায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সার্বিক সহযোগিতা চাই। অনুমতি না দিলে সে ক্ষেত্রে আমাদের কর্মসূচি দিতেই হবে। এ জন্য সরকারকেই দায় নিতে হবে।’
যদিও গতকাল দুপুরে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘নাশকতার আশঙ্কা থাকলে বিএনপিকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না।’
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, ৫ জানুয়ারি ঢাকায় বড় ধরনের শোডাউন ও সমাবেশ করার বিষয়ে অনড় আছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কোনো কারণেই আর পিছু হটতে নারাজ তিনি। ঘোষণা দিয়েও গত ২৭ ডিসেম্বর গাজীপুরে সমাবেশ করতে না পারার ব্যর্থতা ৫ জানুয়ারি সমাবেশ সফল করার মাধ্যমেই ভুলতে চান তিনি। গত কয়েক দিনে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় তিনি যে কোনো উপায়ে ৫ জানুয়ারি সমাবেশ সফল করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
সূত্রমতে, ৫ জানুয়ারির সমাবেশ সফল বিষয়ে তিনি কয়েক দফা কথা বলেছেন দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে। সমাবেশ সফল করতে খোকার সহযোগিতা নিতেও আব্বাসকে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া খোকাও কর্মসূচি সফলে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ২৬ ডিসেম্বর দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠককালে খালেদা জিয়া আন্দোলন-ব্যর্থতা বিষয়ে তার ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ওই দিন তিনি বলেন, ‘মূল দল বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনে প্রায় ৫ হাজার কেন্দ্রীয় নেতা রয়েছেন। সব কেন্দ্রীয় নেতাও যদি নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে একসঙ্গে সমবেত হতে পারেন, তাহলে দলের অন্য নেতাকর্মীরা অবশ্যই মাঠে থাকবে। আন্দোলনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নেতারাই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন। এ ব্যর্থতা আর মেনে নেয়া হবে না। ব্যর্থদের বিরুদ্ধে শিগগিরই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার কঠোর মনোভাবের পর দলের সিনিয়র নেতারা ৫ জানুয়ারির সমাবেশ সফল করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতির কথা জানিয়েছেন। এ লক্ষ্যে সব ধরনের প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে আন্দোলন মাঠে জামায়াতকে সক্রিয় করার ক্ষেত্রেও দলটির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েক নেতা। জোট নেত্রী খালেদা জিয়াও তার বিশ্বস্ত নেতাদের মাধ্যমে জামায়াতের কাছে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা পাঠাচ্ছেন। এছাড়া, জামায়াতকে অনুপ্রাণিত করতে লন্ডন থেকে তারেক রহমানও ‘ম্যাসেজ’ পাঠিয়েছেন। ৫ জানুয়ারি ঢাকার রাজপথে জামায়াতের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সক্রিয়তার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ওই দিন জোট নেত্রীকেও রাজপথে নামার অনুরোধ জানানো হয়েছে। সেই আলোকে বিদায়ী বছরের শেষদিন গুলশানে নিজের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া নিজেই ‘সময় হলেই রাজপথে নামার’ ঘোষণা দেন।
৫ জানুয়ারি জনসভার বিষয়ে বাংলাদেশ ন্যাপের মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভুইয়া দ্য রিপোর্টকে জানান, ‘৫ জানয়ারি গণতন্ত্র হত্যা দিবসের কর্মসূচি পালনে আমরা দলীয়ভাবে সকল প্রস্তুতি ইতোমধ্যেই সম্পন্ন করেছি। আমরা সমাবেশ করবই। নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে যথাসময়ে নয়াপল্টনে জড়ো হওয়ার জন্য।’
মোস্তফা বলেন, আমি মনে করি গণতন্ত্রের স্বার্থে সরকারের উচিত এ সমাবেশের অনুমতি দেয়া। ওই দিন যদি সমাবেশ করতে বাধা দেওয়া হয়, তাহলে জোট নেত্রী সরকার পতনের একদফা কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবেন।’
২০ দলীয় জোট শরিক বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মো. এমএম আমিনুর রহমান কর্মসূচির প্রস্তুতি বিষয়ে বলেন, ‘সরকারের একতরফা সিদ্ধান্তে ৫ তারিখে ২০ দলীয় জোটকে তাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে দিচ্ছে না। আমরা জনসভার জন্য রাজধানীর তিনটি জায়গার উল্লেখ করে অনুমতি চেয়েছি। কিন্তু এখনও সরকার অনুমতি দিচ্ছে না।
আমিনুর আরো বলেন, ‘৫ জানুয়ারির কর্মসূচি সফলে আমরা বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির সকল নেতাকর্মীকে ওই দিন সকাল ১০টার আগে নয়াপল্টনে হাজির হওয়ার জন্য আমাদের পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ সকাল ১০টার মধ্যে আমাদের জোট নেত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন সেখানে উপস্থিত হবেন।’