ইদানিং বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ বলছেন বিএনপির সিনিয়ার ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান কে দেশে ফেরৎ এনে তাকে বিচারের সম্মুখীন করা হবে অতি শিগ্রী।বিষয়টি কি আসলে এতোটা সহজ?এই প্রসঙ্গেই আমাদের এই প্রতিবেদনঃ
বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘদিন থেকে লন্ডনে অবস্থান করছেন। সামরিক বাহিনী সমর্থিত ডক্টর ফখরুদ্দিন আহমেদের অস্থায়ী সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি গ্রেফতার হন। এসময় তাকে সামরিক বাহিনীর কয়েকজন অফিসারের হাতে নির্যাতিত হতে হয়। পরবর্তিতে সরকার তারেক রহমানকে লন্ডনে চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করে। তখন থেকেই তিনি লন্ডনেই সপরিবারে অবস্থান করছেন।
প্রথম কয়েক বছর জনাব তারেক রহমানকে কোন ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যকলাপে দেখা না গেলেও ইদানিং তিনি সবকিছুতেই সক্রিয় হয়েছেন বলা যেতে পারে। সম্প্রতি তার দেয়া কিছু রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে বাংলাদেশে এখন তোলপাড় শুরু হয়েছে। হঠাৎ করে লন্ডনে বসে বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বলা জনাব তারেক রহমানের রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে বাংলাদেশে সরকারী দলে যথেষ্ট উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।
অন্যদিকে তার এই রাজনৈতিক সক্রিয়তায় সরকারেরও টনক নড়েছে বলে মনে হচ্ছে। ইতোমধ্যে জনাব তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে সরকার থেকে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে যুক্তরাজ্য সরকারকে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে সরকার থেকে জানানো হয়। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সম্প্রতি মিডিয়াকে তারেক রহমানকে ফেরত চেয়ে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দফতরে একটি চিঠি পাঠানোর কথা জানান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী স্বাক্ষরিত ওই চিঠি গত বুধবার ঢাকা থেকে পাঠানো হয় বলেও তিনি নিশ্চিত করেন।
এখন প্রশ্ন হলো বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার যে প্রক্রিয়া সরকার শুরু করেছে তা কি আদৌ সফল হবে? এর আগে আমরা সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিপু মনির কাছ থেকেও শুনেছি এমন কথা। শুধু দিপু মনিই নয়, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের মুখেও একই কথা শুনা গেছে। শুধু তারেক রহমানই নয়, এই দুই মন্ত্রী তখন বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসার কথা। বর্তমানে দু’জনই এখন আর মন্ত্রী নন।
যাদের ধরে দেশে নিয়ে আসবেন বলে বলেছিলেন তারা সকলেই বিদেশে বহাল তবিয়তেই অবস্থান করছেন। এখন আবার নতুন করে আলোচনায় এসেছেন জনাব তারেক রহমান। লন্ডনে কিভাবে আছেন তারেক রহমান? ইউরোপিয়ান আইন কি বলে? তিনি নিশ্চয়ই সেদেশে বেআইনিভাবে বসবাস করছেন না? করার কথাও নয়। কারণ তিনি বাংলাদেশের একটি বড় রাজনৈতিক দলের আগামী দিনের নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ সন্তান। তাহলে কিভাবে এতদিন থেকে তিনি লন্ডনে অবস্থান করছেন?
অনেকের মতে তারেক রহমান বৃটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। তবে ঢাকায় অবস্থানরত তার উকিল বিষয়টিকে নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, তারেক রহমান বৃটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেননি । সাধারণত ইউরোপীয় দেশগুলোতে বসবাসের ক্ষেত্রে কিছু আইন রয়েছে।
তার একটি হলো রাজনৈতিক আশ্রয়। জেনেভা কনভেনশনের ১৯৫১ আইন অনুসারে যদি কোনো ব্যক্তির তার দেশে রাজনৈতিক সমস্যা থাকে এবং এই কারণে সে দেশের সরকার তাকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয় অথবা সরকার নিজেই সে ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে আগ্রহী হয় তাহলে ইউরোপের যেকোনো দেশ তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে বাধ্য থাকবে। এই আইনের অধীনে যারা আশ্রয় পায় তাদের যাতায়াতের সুবিধার্থে পরবর্তিতে ট্রাভেল ডকুমেন্ট দেয়া হয়। তবে সেই ট্রাভেল ডকুমেন্টে উল্লেখ থাকে ,বাহক সকল দেশেই যাতায়াত করতে পারবে, শুধুমাত্র নিজ দেশ ছাড়া। এই আইনে যারা বসবাসের অনুমতি লাভ করে তাদের সে দেশে সব ধরনের সুযোগ -সুবিধা পাওয়ার অধিকার থাকে। পরবর্তিতে চার কিংবা পাচ বছর অবস্থানকালে ওই ব্যক্তি চাইলে সে দেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারে। তা না হলে পুনরায় সে ব্যক্তির নামে ট্রাভেল ডকুমেন্ট ইস্যু করা হয়ে থাকে। এখন যদি দেখা যায় আশ্রয় আবেদনকারী ব্যক্তির রাজনৈতিক সমস্যা ততটা জটিল নয়, তবে দেশে ফেরত পাঠালে নাজেহাল অথবা গ্রেফতার হওয়ার সম্ভবনা হয়তো ধাকতে পারে ,এক্ষত্রেও বসবাসের অনুমতি দেয়া হয়ে থাকে।
কিন্তু এধরনের অনুমতির বেলায় সে ব্যক্তির দেশের পাসপোর্ট থাকলে সেখানে অনুমতি সিল না থাকলে এলাইন্স পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়ে থাকে। এখন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান যদি ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে থাকেন তাহলে এই দুই পাসপোর্টের যে কোনো একটি তিনি বর্তমানে বহন করছেন।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ট্রাভেল ডকুমেন্ট যারা পায় তাদের বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করতে হলে কোনো ভিসার প্রয়োজন হয় না। তবে এলাইন্স পাসপোর্টের বেলায় ভিসা নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এখন যদি তারেক রহমানের উকিলের কথা সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আর কিভাবে আইনের আওতায় তারেক রহমান বৃটেনে অবস্থান করতে পারেন? ইউরোপীয় নাগরিকের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে বসবাসের অনুমতি দেয়ার নিয়ম রয়েছে। যেহেতু তারেক রহমান বিবাহিত, সেক্ষেত্রে এধরনের প্রশ্ন অবান্তর।
এছাড়া আরেকটি আইনে তারেক রহমানের বৃটেনে বসবাসের অনুমতি পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। যদি তিনি সে দেশে নিজস্ব অর্থ বিনিযোগ করে থাকেন অর্থাৎ ব্যবসা ক্ষেত্রে অর্থ বিনিয়োগ করেন তাহলে প্রাথমিক অবস্থায় অস্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি তিনি পেতে পারেন। পরবর্তিতে ব্যবসার মাধ্যমে নিজেকে অর্থনৈতিক দিক থেকে যদি তিনি স্বাবলম্বী দেখাতে পারেন তাহলে অস্থায়ী অনুমতিকে নবায়ন করা যায় এবং অবশেষে এভাবে পাঁচ বছর চলাকালে স্থায়ী অনুমতির জন্য আবেদন করা যেতে পারে।
তাহলে কি তারেক রহমান এভাবেই আছেন লন্ডনে? উপরোক্ত নিয়মের বাইরেও আরো কিছু নিয়ম রয়েছে, যার মাধ্যমে বৃটেনে বসবাসের জন্য আবেদন করা যেতে পারে। এর একটি হলো কাজের বিনিময়ে অনুমতি। অর্থাৎ কথা ও কাজ করে ট্যাক্স পেমেন্ট করলে প্রাথমিকভাবে দু’ বছর, পরবর্তিতে পুনরায় দু’ বছর এবং সবশেষে স্থায়ী বসবাসের অনুমতির জন্য আবেদন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে তারেক রহমান কথা ও কাজ করবেন কি না বলা কঠিন।
তবে তিনি কাজ না করলেও কাজ আছে এবং রীতিমত ট্যাক্স পেমেন্ট করছেন দেখালেও অনুমতি পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। লন্ডনের স্থানীয় বিএনপি নেতারা এক্ষেত্রে সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারেন। তাছাড়া কোনোকিছু না করেও নিজস্ব অর্থায়ন দেখিয়ে ব্রিটেনে বসবাস করা যায়। কোনো ব্যক্তি যদি বৃটেনে নিজস্ব অর্থে বসবাস করার মতো সম্পদ দেখাতে পারে তাহলেও বসবাস করার অনুমতি পাওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে একটি পরিবারের থাকা –খাওয়া, শিক্ষা -চিকিৎসা মিলে একটা মোটা অংকের অর্থের প্রয়োজন রয়েছে।
সম্প্রতি মিডিয়ায় তারেক রহমানের অর্থের যোগান নিয়ে লন্ডনসহ কয়েকটি দেশের বিএনপি নেতাদের নাম প্রকাশ হয়েছে। বাংলাদেশে তারেক রহমানের উকিলের কথা অনুসারে এখন যদি তিনি বৃটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় না নিয়ে থাকেন তাহলে তার নিজস্ব ব্যয়ে কিংবা মানবিক কারণে বসবাসের অনুমতি নিয়ে বৃটেনে অবস্থান করতে পারেন তারেক রহমান। নিজস্ব অর্থায়নে কিংবা মানবিক কারণে লন্ডনে তারেক রহমান বসবাস করলে এখন পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশী পাসপোর্ট বহন করে চলছেন।
অন্যদিকে যেহেতু তিনি দীর্ঘদিন থেকে লন্ডনে অবস্থান করছেন সেক্ষেত্রে তারেক রহমান বৃটিশ পাসপোর্টও বহন করতে পারেন। তবে বাংলাদেশী পাসপোর্ট পাঁচ বছর পর পুনরায় নতুন করে নিতে হয়। সেক্ষেত্রে লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে তারেক রহমানের জন্য কোনো নতুন পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়েছে কি না তা সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভালো করে বলতে পারবে। তবে এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, তারেক রহমানের বাংলাদেশী পাসপোর্ট হোক আর ট্রাভেল ডকুমেন্ট কিংবা এলাইন্স পাসপোর্ট অথবা ব্রিটিশ পাসপোর্টই হোক ,যেকোনো একটাতো তিনি অবশ্যই বহন করছেন। এই কারণেই বৈধ ভাবে বৃটেনের বাইরে যাতায়াত করতে পারছেন তারেক রহমান।
বৃটেনে কিভাবে আছেন তারেক রহমান তার সবকিছু না জেনেশুনে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কথা মিডিয়ায় বলা উচিত নয় বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। সব কথার শেষ কথা হলো তারেক রহমানকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা সরকারের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। বৃটেন সরকার কোনদিনও তারেক রহমানকে বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দেবে না।
একমাত্র নিজে যেদিন স্বইচ্ছায় বাংলাদেশে ফিরে আসতে চাইবেন সেদিনই বাংলাদেশে আসতে পারবেন। সুতরাং মিডিয়ায় মূল্যহীন বক্তব্য দেয়া থেকে সরকারকে বিরত থাকাটাই ভালো বলে অনেকে মনে করেন।
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিপু মনি কিংবা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের মতো অবাস্তব কথা মিডিয়ায় না বলাই ভালো। সরকারের যেটা দেখা উচিত সেটা হলো লন্ডন হাইকমিশন থেকে তারেক রহমানের নামে কোনো পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়েছে কি না। যদি না করা হয়ে থাকে তাহলে বুঝতে হবে তারেক রহমান বৃটেনে আশ্রয় গ্রহণ করে ট্রাভেল ডকুমেন্ট কিংবা এলাইন্স পাসপোর্ট অথবা পরবর্তিতে বৃটিশ পাসপোর্ট বহন করছেন।
এধরনের পাসপোর্টধারীকে বৃটেন সরকার কখনো বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে পারে না, পাঠাতে পারবে না।