২০দলীয় জোটের টানা অবরোধ-হরতালে জ্বলছে দেশ, পুড়ছে মানুষ। জীবনের তাগিদে রাস্তায় বের হওয়া মানুষের ঘরে ফেরার নিশ্চয়তা নেই। প্রতিদিনই দগ্ধ, আহত, নিহতদের কান্নায় ভারি হচ্ছে বাতাস। স্কুলশিক্ষক, গাড়ির চালক, খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে নিহতের তালিকায় বাদ পড়ছে না ছোট্ট শিশুটিও। অবরোধের দুই সপ্তাহে নিহত হয়েছে ২৭ জন, যাদের ১৯ জনেরই রাজনীতির সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। এর মধ্যে পেট্রলবোমায় নৃশংসভাবে পুড়িয়ে মারা হয়েছে ১২ জনকে। পেট্রলবোমায় দগ্ধ ৩২ জন এখনও ঢাকা মেডিকেলসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। তাদের চোখের জলের প্রশ্ন- এ সংঘাতের শেষ কোথায়? কবে ফিরবে স্বস্তি?
তবে বিরোধী দলের মধ্যবর্তি নিরপেক্ষ নির্বাচন সহ অন্যান্য দাবীর প্রতি সরকার মোটেই আমল না দেয়ায় পরিস্থিতি ক্রমেই গুরুতর হয়ে উঠছে।সরকার কোন অবস্থাতেই এই সংকট আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চাইছে না বরং নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে কঠোর ভাবে এই আন্দোলন দমন করতে গিয়েই সংকট চলে গেছে পয়েন্ট অব নো রিটার্নের দিকে।
এদিকে নাশকতা বন্ধ করতে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে চলছে র্যাব-পুলিশের চিরুনি অভিযান। অভিযানের নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে হয়রানির অভিযোগও রয়েছে। নাশকতারোধে যোগাযোগ সফটওয়্যার ভাইবার ও ট্যাঙ্গোর পর সোমবার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ, মাইপিপল ও লাইন।
কিন্তু সোমবারও কার্যত রাজধানী থেকে সারা দেশ বিচ্ছিন্ন ছিল। গাড়িতে আগুন, ভাংচুর ও রাজনৈতিক কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। রাজনৈতিক অবস্থার উত্তরণ আর সাধারণ মানুষ কবে স্বস্তিতে রাস্তায় বের হতে পারবে, তা জানা নেই রাজনীতিবিদ কিংবা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। বর্তমান অস্থিরতার রাজনীতিতে তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই বলেও তারা মন্তব্য করেছেন।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম. সাখাওয়াত হোসেন দৈনিক প্রথম বাংলাদেশকে বলেন, চরম আতঙ্ক এবং অস্বস্তিতে আছে দেশের মানুষ। এ অবস্থা দেশের মানুষের জন্য ভয়ঙ্কর; গণতন্ত্র ও রাজনীতির জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। এ অস্থিরতার জন্য সব রাজনৈতিক দলকেই চরম মূল্য দিতে হতে পারে। স্বস্তি কবে ফিরবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমান রাজনীতি রাজনীতিবিদদের কন্ট্রোলে নেই। তবে দেশ, গণতন্ত্র ও দেশের মানুষের জন্য যত দ্রুত সম্ভব, রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপের মাধ্যমে এ অবস্থার সমাধান করতে হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অবরোধের দুই সপ্তাহে রাজনৈতিক সহিংসতায় সারা দেশে নিহত হয়েছে ২৭ জন। এর মধ্যে রংপুরের মিঠাপুকুরে বাসে অগ্নিদগ্ধ হয়েই মারা গেছেন নারী-শিশুসহ পাঁচজন। অবরোধে পিকেটিং করার সময় গাড়িচাপায় মারা গেছে একজন। পিকেটারদের ধাওয়ায় গাড়ি উল্টে ও বাস থেকে লাফিয়ে পড়ে আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতদের বেশিরভাগেরই রাজনীতির সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। গাইবান্ধার আলতাফ হোসেন ছিলেন স্কুলশিক্ষক। নাটোরের ইমাদুর রহমান, সিরাজগঞ্জের ইসমাইল হোসেন, বরিশালের আবুল কালাম ও নোয়াখালীর জমির হোসেন পেশায় গাড়িচালক। চট্টগ্রামের এনাম হোসেন ও নোয়াখালীর মিজানুর রহমান দোকান করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত ২৭ জনের মধ্যে ১৯ জনই রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। এদিকে সহিসংতায় আহত হয়েছে আট শতাধিক মানুষ।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, ৫ জানুয়ারি বিএনপির সমাবেশে নাশকতার কথা বলে সরকার সমাবেশ করতে দিল না। নাশকতার আশঙ্কাটা সরকার পরিষ্কার করেনি।অথচ এক সমাবেশের ঘটনাকে কেন্দ্র করে অবরোধের নামে যে সন্ত্রাসী কর্মকা- হচ্ছে, তা কখনোই মানা যায় না। নাশকতার শিকার সাধারণ মানুষ। মনে রাখা উচিত, রাজনীতির নামে মানুষ হত্যার অধিকার কারও নেই।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, অবরোধে সারা দেশে গাড়িতে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ ও দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে ৭৭ জন গুরুতর দগ্ধ হয়েছে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আবাসিক চিকিৎসক পার্থ শঙ্কর পাল জানান, সাম্প্রতিক নাশকতায় গাড়িতে আগুন ও পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে ৩৪ জন চিকিৎসা নিয়েছে। বর্তমানে ১৬ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এর মধ্যে ছয়জনের অবস্থায় আশঙ্কাজনক। এছাড়া রংপুরের মিঠাপুকুরে বাসে আগুনে দগ্ধ ১৪ জনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা চলমান সঙ্কট নিয়ে কথা বলেছেন।
সোমবার স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকের পর পরবর্তী ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত অবরোধ চলবে বলে জানিয়ে দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী খালেদা জিয়া। সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ঢামেকের বার্ন ইউনিটে দগ্ধদের দেখতে গিয়ে বলেন, রাজনীতিবিদ হিসেবে তার ঘৃণা হচ্ছে। আমরা যদি কান্না নিবারণের জন্য রাজনীতি করি, তাহলে সমস্যার সমাধানে আলোচনায় বসি। চলমান সঙ্কট নিরসনে সরকারকে সাত দিনের আলটিমেটাম দিয়েছেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। সাত দিনের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে না পারলে সরকারকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানান তিনি। তবে বিএনপি আইএস ও আল কায়দার মতো জঙ্গি সংগঠনে পরিণত হয়েছে- দাবি করে দলটিকে ‘নির্মূলের’ ঘোষণা দিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম।
দুই সপ্তাহে নিহত ২৭ : এখন পর্যন্ত সবচেয়ে নির্মম ঘটনা ঘটেছে ১৩ জানুয়ারি রংপুরের মিঠাপুকুরে। ওই রাতে একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুনে নিহত হয় শিশুসহ পাঁচজন। তারা হলো রহিমা বেগম, তার ছেলে রহিম বাদশা, মেয়ে জেসমিন আক্তার, তছিরন বেগম ও ২ বছরের এক শিশু। ঢাকার ইস্কাটনে পেট্রলবোমায় দগ্ধ প্রাইভেট কার চালক আবুল কালাম সাত দিন ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে থাকার পর ১৫ জানুয়ারি মারা যান। একই রাতে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে বাসের ভেতর পুড়ে মারা যান চালকের সহযোগী তোফাজ্জল হোসেন।
১২ জানুয়ারি চট্টগ্রামের দোকান কর্মচারী এনাম হোসেন পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে মারা যান। একই দিন অবরোধকারীদের ধাওয়ায় নিহত হন গাড়িচালক জমির হোসেন। ১১ জানুয়ারি রাতে গাইবান্ধায় যাত্রীবাহী বাসে পেট্রলবোমা ছুড়লে ভয়ে লাফিয়ে পড়ে মারা যান পারভেজ মিয়া। একই দিন মারা যান দগ্ধ যশোরের ট্রাকচালক মুরাদ। ১৮ জানুয়ারি বরিশালে পিকেটারদের জোড়া পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে সোহাগ নামে এক ট্রাক হেলপার মারা যান। এর আগে ৫ জানুয়ারি পুলিশ, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জোটের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীতে প্রাণ গেছে চারজনের। অবরোধের দ্বিতীয় দিন ৭ জানুয়ারি তিনজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। নোয়াখালীতে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান মহসিন ও রুবেল। একই দিন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় মারা গেছেন ইসমাইল হোসেন নামে এক ব্যক্তি।
তবে বিপুল সংখ্যক নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতিতে নাশকতামূলক ঘটনা ঘটলেও এখন পর্যন্ত দোষী কাউকে চিন্হিত করা যায়নি, বরং সন্দেহের বশে দেশ ব্যাপি বিপুল সংখ্যক বিরোধী নেতাকর্মী গ্রেফতার হওয়ায় অবস্থা আরও ভয়াবহ রূপ ধারন করেছে।