DMCA.com Protection Status
title="৭

ক্রমশঃ ক্ষীন হয়ে আসছে সংলাপ-সমঝোতার সম্ভাবনাঃ অনিশ্চিত যাত্রায় বাংলাদেশ!

93708_1ক্রমশঃ   ক্ষীণ হয়ে আসছে সংলাপের সম্ভাবনা। দেশের ভেতরে ও বাইরে থেকে সংলাপের প্রয়াজনীয়তা ও প্রস্তাব নিয়ে যখন প্রতিনিয়ত কথা হচ্ছে, তখন বড় দুই দলের বৈরী আচরণে তা বারবার হোঁচট খাচ্ছে। সর্বশেষ শনিবার রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গেলে গুলশান কার্যালয়ের ফটক বন্ধ রেখে তাকে ঢুকতে না দেয়ার ঘটনায় সংলাপ নিয়ে নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে বলেও মনে করেন অনেকে। সংলাপের পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করা অনেক বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি বলছেন, আলোচনার যে সূত্রপাত সৃষ্টি হয়েছিল তা বিএনপির জন্য নষ্ট হয়েছে। এর দায়ভার বিএনপিকে নিতে হবে।

অবশ্য গতকাল বেগম খালেদা জিয়াকে নাশকতার হুকুমের আসামী করে সরকার দায়ের করলে তা সংলাপ-সমঝোতা জন্য বড় অন্তরায় বলে মনে করছে বিএনপি।

আর ক্ষমতাসীনরা বলছেন, বিএনপির সামনে একটি সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল সংলাপ ও সমঝোতার। কিন্তু নিজের কার্যালয়ের দরজা বন্ধ করে খালেদা জিয়া সমঝোতাকে অবরুদ্ধ করে ফেললেন। সংলাপকেও অসম্ভব করে ফেললেন। তবে ২০ দলীয় জোটের নেতারা এখনও বলছেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে অবশ্যই সংলাপ হওয়া দরকার। সংলাপ ছাড়া উদ্ভূত পরিস্থিতির নিরসন সম্ভব নয়।

 

বিএনপির সঙ্গে সংলাপের কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ। রোববার তিনি আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, সংলাপের কোনো সম্ভাবনা আমি দেখছি না। শনিবার রাতে গুলশান কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে তা সংলাপের সহায়ক নয় বলেও মনে করেন এই নেতা।

 

এছাড়া রোববার আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তৃতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল গুলশান কার্যালয়ের ঘটনা। সংলাপ নিয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। 'লাথি মার সংলাপে'_ এমন কথাও বলতে দেখা গেছে ক্ষমতাসীনদের কাউকে কাউকে।

 

এদিকে আলোচনার মাধ্যমে সঙ্কট সমাধানের পক্ষে অবস্থান নেয়া টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রধানমন্ত্রী যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, এটা আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক সংস্কৃতির অংশ হলেও যে পরিপ্রেক্ষিতে ও যে সময়ে তিনি এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তার মধ্যে একটা রাজনৈতিক উপাদান ছিল। কারণ মানুষ মনে করে, এই জ্বালাও-পোড়াওয়ের অশান্ত পরিবেশ থেকে মুক্তির পথ হিসেবে আলোচনা দরকার। তাই সবাই ভেবেছিলেন প্রধানমন্ত্রী যদি খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে পারতেন তাহলে ইতিবাচক কিছু ঘটতে পারত। এর ওপর ভিত্তি করে আলোচনা হয়ে যেত না বা সমঝোতা হয়ে যেত না। তবে একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হতো। এটি মানুষের ধারণা ছিল। কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে সেই পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সজ্ঞানে। আলোচনার যে সূত্রপাত সৃষ্টি হয়েছিল তা বিএনপির জন্য নষ্ট হয়েছে। এর দায়ভার বিএনপিকে নিতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।

 

তবে হাল ছাড়ছেন না সংলাপের পক্ষে অবস্থানকারীরাও। রোববার তথ্য মন্ত্রণালয়ে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের সঙ্গে মতবিনিময়ে আলোচনার মাধ্যমে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধানে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রিন্ট ও অনলাইন গণমাধ্যমের সম্পাদকরা।

 

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনের পর থেকেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে সবার অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে আসছিল। দাবি আদায়ে কঠোর আন্দোলনের হুমকিও দেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও জোট নেত্রী খালেদা জিয়া। পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ার আভাস থেকে দুই দলকে সংলাপে বসার আহ্বান জানানো হয় দেশে-বিদেশে বিভিন্ন মহল থেকে। ৫ জানুয়ারি সরকারের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে আবারও অশান্ত হয়ে ওঠে রাজনৈতিক অঙ্গন। এ অবস্থায় ৩ জানুয়ারি রাত থেকে গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে। ৫ জানুয়ারি প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৪৪ ধারা জারি করার কারণে কর্মসূচি পালন করতে না পারায় ওইদিন সন্ধ্যায় অনির্দিষ্টকালের অবরোধ ঘোষণা করেন খালেদা জিয়া, যা এখনও চলছে।

 

২০ দলের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জ্বালাও-পোড়াও, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ শুরু হয়। বোমা ও পেট্রলবোমা হামলায় সারা দেশে শতাধিক মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়। শুধু রাজধানীতেইঅগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৫ সাধারণ মানুষের।যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে এধরনের নাশকতার অভিযোগ বার বার অস্বকার করে বরং এসব ঘটনার জন্য সরকারকেই দোষারোপ করা হয়েছে।

পক্ষান্তরে অবরোধের মধ্যে চলা নাশকতা প্রতিরোধে সরকারের পক্ষ থেকেও বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের ধরপাকড় শুরু করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চালানো হয় যৌথ বাহিনীর বিশেষ অভিযান। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপিসহ সমাজের বিভিন্ন অংশ সংলাপের মাধ্যমে পরিস্থিতি সমাধানের পক্ষে দাবি অব্যাহত রাখে। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন বিদেশি সংস্থার পক্ষ থেকেও আলোচনার আহ্বান জানানো হচ্ছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল বিএনপির সঙ্গে সংলাপের দাবি প্রত্যাখ্যান করে কঠোর অবস্থান নিয়েছে।

 

এ অবস্থায় শনিবার বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে গুলশান কার্যালয়ে যাওয়ার প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় সবার মধ্যে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ না হওয়া ও গুলশান কার্যালয়ে ঢুকতে না দেয়ার ঘটনায় আবারও সংলাপ নিয়ে নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছে সচেতন মহল। এজন্য বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকেই মনে করছেন, ক্ষীণ হয়ে আসছে সংলাপের সম্ভাবনা।

 

এদিকে রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজে ছাত্রলীগের শিক্ষা উপকরণ বিরতণ অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নিজ কার্যালয়ের দরজা বন্ধ রেখে খালেদা জিয়া সংলাপের পথও রুদ্ধ করে দিলেন। তিনি বলেন, গতকাল (শনিবার) একটি সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল সংলাপ ও সমঝোতার। কিন্তু নিজের কার্যালয়ের দরজা বন্ধ করে খালেদা জিয়া সমঝোতাকে অবরুদ্ধ করে ফেললেন। সংলাপকেও অসম্ভব করে ফেললেন। শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন যে তিনি দেশে শান্তি চান।

 

গুলশান কার্যালয়ে শিমুল বিশ্বাসের বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, এরকম বেয়াদব, অর্বাচীন, মূর্খ যদি খালেদা জিয়ার পাশে থাকে, তার পরিণতি ভরাডুবি ছাড়া আর কিছু হবে না। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া এসব মূর্খ, অর্বাচীন দ্বারা পরিবেষ্টিত হওয়ার কারণেই তার এই পরিণতি। জনগণ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

 

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক বলেছেন, হরতাল-অবরোধ দিয়ে খালেদা একদিকে মানুষ পুড়িয়ে মারছেন; অপরদিকে আলোচনার কথা বলছেন। আসলে তিনি আলোচনা চান না। আলোচনার ইচ্ছা থাকলে সহিংসতা বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করতেন।

 

রোববার ১৪ দলের এক সভায় বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, লাথি মার সংলাপকে। সংলাপের নামে যারা দেশে অশান্তি সৃষ্টি করছে তাদের সঙ্গে আবার আলোচনা কিসের।

 

সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, বিএনপির চূড়ান্ত রাজনৈতিক পরাজয় হয়েছে। এখন আর দেশে কোনো সঙ্কট নেই। শুধু সন্ত্রাসীদের উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা এগিয়ে যেতে চাই।

 

খালেদাকে উদ্দেশ করে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, পেট্রলবোমা দিয়ে মানুষ হত্যা করবেন, আর আমরা আপনার সঙ্গে আলোচনা করব_ এটা চিন্তা করাও আপনার মহাপাপ। আপনার সঙ্গে আলোচনা হবে না। পাপের শাস্তি আপনি পাবেনই। ঢাকা পাহারা দিতে আমরা কমিটি করছি।

 

এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, চলমান আন্দোলনে দেশের পরিস্থিতি খুব খারাপ পর্যায়ে চলে গেছে। এ পরিস্থিতি কারও কাম্য নয়। তারপরও দেশে গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনার জন্যই ২০ দলীয় জোটকে আন্দোলন করতে হচ্ছে। তবে দেশের বর্তমান এই রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে অবশ্যই সংলাপ প্রয়োজন। এজন্য দুই পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে। সংলাপের সম্ভাবনা ও পরিবেশ আছে বলেও দাবি করেন তিনি।

 

বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক বলেন, সংলাপের সম্ভাবনা অর্ধেক অর্ধেক আছে। আমরা সবাই দাবি জানাচ্ছি, চাচ্ছি যেন সংলাপ হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এবং বাংলাদেশেও অতীতে এর চেয়ে কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। সংলাপের মাধ্যমেই তার উত্তরণ হয়েছে। আমরা আশা করব, প্রধান দুই জোট সংলাপে বসবে এবং জনসম্পৃক্ত রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করবে। তিনি বলেন, ২০১১ সালে বাংলাদেশের সংবিধান থেকে চুপেচাপে গণভোটের একটি ধারা তুলে দেয়া হয়েছে। এটি থাকলে জনগণের ওপর প্রশ্ন তুলে দেয়া যেত। কিন্তু তা না থাকায় সংলাপের মাধ্যমেই তা জনগণের কাছে তুলে ধরতে হবে।

 

ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে অবশ্যই সংলাপ হওয়া দরকার। সংলাপ ছাড়া উদ্ভূত পরিস্থিতির নিরসন সম্ভব নয়। সব পক্ষের বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনীতিবিদরাই সংলাপের কথা বলছেন। এজন্য সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা নেয়া প্রয়োজন। উদ্যোগ নিলে সংলাপ অসম্ভব কিছু নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

 

Share this post

scroll to top
error: Content is protected !!