শিরোনাম দেখে পাঠকরা বিভ্রান্ত হতে পারেন। বেশি সচেতন যারা তারা মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহর কথাও ভেবে বসতে পারেন, যিনি ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট পর্যন্ত দেশের সেনাপ্রধান ছিলেন। তার সময়ই এক অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছিলেন বাকশাল সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান।
ওই হত্যাকাণ্ডের দায় অন্যদের ঘাড়ে চাপিয়ে সাবেক এই জেনারেল ‘ভালো মানুষ’ হিসেবে বহু বছর বহাল তবিয়তেই ছিলেন। মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর সফিউল্লাহর জীবনে ‘শনৈঃ শনৈঃ’ উন্নতি হয়েছিল। ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত তিনি চুটিয়ে রাষ্ট্রদূতের চাকরি করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য পর্যন্ত বানিয়েছেন।
কিন্তু ২০০৯ সালে এসে প্রথমে ঝামেলা বাঁধিয়েছিলেন শেখ ফজলুল করিম সেলিম। মরহুম নেতার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত দুটি পৃথক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ ‘নেপথ্য ভূমিকায়’ ছিলেন। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শেখ সেলিম বলেছিলেন, সেদিন আক্রান্ত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান একাধিকবার সফিউল্লাহকে টেলিফোন করে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন।
কিন্তু জবাবে সফিউল্লাহ দেশের রাষ্ট্রপতিকে তার বাসভবন থেকে ‘পালিয়ে যাওয়ার’ পরামর্শ দিয়েছিলেন! শেখ সেলিম আরো বলেছিলেন, সেনা প্রধান হিসেবে সফিউল্লাহ কেন রাষ্ট্রপতির টেলিফোন পাওয়ার পরও ব্যবস্থা নেননি তা ‘রহস্যজনক’। তাছাড়া হত্যাকাণ্ডের পর ‘খুনিরা’ সেনানিবাসে গিয়েছিল। সেখানে রেড অ্যালার্ট জারি করেও ‘খুনিদের’ গ্রেফতার করা যেতো। কিন্তু সফিউল্লাহ উল্টো তাদের কাছে ‘আত্মসমর্পণ’ করেছিলেন। রেডিওতে গিয়ে ‘খুনিদের’ প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, দু’টি অনুষ্ঠানের মধ্যে একটিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন। সফিউল্লাহ নিজেও ছিলেন সামনের সারিতে।
এর কিছুদিনের ব্যবধানে, ২০০৯ সালের অক্টোবরে শেখ মুজিব হত্যা মামলার শুনানিতে আসামি পক্ষের আইনজীবী আবদুর রেজ্জাক খান বলেছিলেন, তৎকালীন সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ তার সাক্ষ্যে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বলেছেন, ওইদিন সকাল ছয়টা বাজার তিন-চার মিনিট আগে তিনি নাকি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছিলেন। অথচ অন্য সাক্ষীরা জানিয়েছেন, সেদিন ভোর চারটা থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই সব ঘটনা ঘটে গিয়েছিল।
তাছাড়া সফিউল্লাহর সাক্ষ্যতেই জানা গেছে, আক্রান্ত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব টেলিফোনে তাকে ফোর্স পাঠাতে বলেছিলেন। কিন্তু সেনাপ্রধান হলেও রাষ্ট্রপতির প্রাণ বাঁচানোর জন্য সফিউল্লাহ সেনা পাঠাননি। ঠিক এ পর্যায়ে এসেই মাননীয় আদালত বলেছিলেন, সফিউল্লাহ ‘একজন কাপুরুষ, ভীতু এবং মিথ্যাবাদী সেনাপতি’। এভাবে হঠাৎ আক্রান্ত হওয়ার পর পুরোপুরি ডিফেন্সিভে চলে গিয়েছিলেন সফিউল্লাহ। কিন্তু যুৎসই কোনো জবাব দিতে পারেননি। তার বক্তব্যে বরং প্রমাণিত হয়েছিল, হয় তিনি হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন; না হলে নিজের অধীনস্থদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন!
বলা দরকার, শেখ সেলিমের মতো শীর্ষ একজন নেতা হঠাৎ হাটে হাড়ি ভেঙে দেয়ায় এবং সর্বোচ্চ আদালত তার সম্পর্কে কঠোর মন্তব্য করায় প্রমাদ গুনতে হয়েছিল সফিউল্লাহকে। তাকে এমনকি মুজিব হত্যা মামলায় আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানোরও দাবি উঠেছিল সে সময়।
শুরুতে কে এম সফিউল্লাহর কথা বললেও আজকের নিবন্ধের নায়ক কিন্তু অন্য এক জেনারেল। নাম তার মইন উ আহমেদ। পাঠকদের নিশ্চয়ই তার সম্পর্কে বিস্তারিত স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না। ‘গণতন্ত্রের লাইনচ্যুত ট্রেনকে উদ্ধার’ করার নামে দেশে ‘ব্ল্যাকমেইলিং’-এর রাজত্ব কায়েম করেছিলেন তিনি। নোংরা নানা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অনেকভাবেই তিনি নাকি দেশে-বিদেশে বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন।
তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো, যে প্রতিষ্ঠান তাকে দেশের প্রথম জেনারেল বানিয়েছিল, সে সেনাবাহিনীকেই পঙ্গু ও ধ্বংস করার আয়োজন সম্পন্ন করে গেছেন তিনি। তার নেতৃত্বাধীন অবৈধ সরকার সম্পর্কে আলোচনা করা নয়, এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য মইন উ’র জীবনের একটি অনালোচিত ঘটনা সম্পর্কে জানানো। এর পেছনেও বিশেষ কারণ রয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলী নিয়ে এবারও অনেক গালগল্প শুনতে হয়েছে।
এ বিষয়ে আগেই ব্যতিক্রম ঘটিয়ে রেখেছেন জেনারেল (অব.) মইন উ আহমেদ। সর্বতোভাবে আওয়ামী ঘরানার এবং প্রমাণিত ভারতপন্থী হলেও তিনি কিন্তু অন্য রকম ‘সঠিক ইতিহাস’ শুনিয়েছেন।
‘শান্তির স্বপ্নে সময়ের স্মৃতিচারণ’ নামের রাজকীয় স্টাইলে প্রকাশিত গ্রন্থে সাবেক এ সেনাপ্রধান দিনটির বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। কিন্তু লক্ষ্য করেননি, ঘটনাপ্রবাহে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেনা অফিসার হিসেবে কর্মজীবনের শুরুতেই তিনি ভীরু-কাপুরুষের মতো আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
যেমনটি দেখা গেছে কে এম সফিউল্লাহর ক্ষেত্রেও। এটা ১৯৭৫ সালের ৬-৭ নভেম্বরের ঘটনা। মইন উ’র গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দেয়ার আগে ইতিহাসের উল্লেখ করলে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে। সে বছরের ১৫ আগস্ট এক অভ্যুত্থানে একদলীয় বাকশাল সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর পদটিতে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। শেখ মুজিবের মন্ত্রীদের নিয়েই মোশতাক সরকার গঠন করেছিলেন। ৩ নভেম্বর অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ও মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গ্রেফতার করে তিনি সেনাপ্রধানের পদ দখল করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাককে বঙ্গভবনে বন্দী করা হয়েছিল। খালেদ মোশাররফের এই অভ্যুত্থান বাকশালী শাসনে ফিরিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে একটি ভারতপন্থী পদক্ষেপ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। ফলে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি জনগণের মধ্যেও খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে চরম বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল।
৬ নভেম্বর রাত থেকে শুরু হয়েছিল সিপাহী-জনতার বিপ্লব। এই বিপ্লবে কয়েকজন সহযোগীসহ খালেদ মোশাররফ মারা গিয়েছিলেন। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান মুক্তি পেলেও জাসদ এবং ভারতপন্থী একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর উদ্যোগে সেনা অফিসারদের হত্যার অভিযান চালানো হয়েছিল। অফিসার মাত্রই খালেদ মোশাররফের সমর্থক এমন এক প্রচারণায় সৈনিকরাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল।
ফলে বেশ কিছু অফিসারের মৃত্যু ঘটেছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেছিলেন জিয়াউর রহমান। মইন উ’র বর্ণনা পড়ার আগে ৭ নভেম্বরের এই প্রেক্ষাপট মনে রাখতে হবে। তখন সবে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন।
‘বঙ্গভবন : নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি’ শিরোনামের অধ্যায়ে ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা দিতে গিয়ে মইন উ’ জানিয়েছেন (পৃ ৯০-১০০), রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদকে ‘পাহারা’ দেয়ার দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি। তার দায়িত্ব ছিল খন্দকার মোশতাক যাতে আত্মহত্যা না করে বসেন তা লক্ষ্য রাখা। মোশতাক নাকি মইন উ’র সঙ্গে ‘রাজ্যের গল্প করতেন’ এবং তার নিজের হাতেও ‘অফুরন্ত সময়’ থাকায় গল্প শুনতে তারও নাকি ‘খারাপ লাগতো না’!
৬ নভেম্বর রাতে বাইরে গোলাগুলি শুরু হওয়ার পর পালিয়ে যাওয়ার আগে কর্নেল সাফায়াত জামিল নাকি মইন উ’কেই ট্রুপস কমান্ড করার এবং বঙ্গভবনের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব দিয়েছিলেন! বঙ্গভবনের মেইন গেটে গিয়ে মইন উ ছয়-সাতটি গাড়ি ভর্তি লোকজনকে বঙ্গভবনের দিকে আসতে দেখেছিলেন। তারা ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই’ স্লোগানে এলাকা ‘প্রকম্পিত’ করে তুলেছিল (স্লোগানটি আসলে ছিল ‘সিপাহী-জনতা ভাই ভাই’। সেটাও জানেন না মইন উ!)। তিনি নাকি ‘লোকজনকে’ মেশিনগানের গুলি চালানোর ভয় দেখিয়েছিলেন এবং ওতে নাকি ‘কাজও’ হয়েছিল! কিন্তু এর পরপরই এসেছিল হাজার হাজার মানুষ। সঙ্গে ছিল ট্যাঙ্ক।
মইন উ লিখেছেন, ‘বন্যা যেমন ধেয়ে আসে, সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায় তেমনি মানুষের ঢল ধেয়ে এলো বঙ্গভবনের দিকে। … গেটের সামনে লাখ জনতা, সিভিলিয়ান ও আর্মি; সঙ্গে কামান, মর্টার, মেশিনগান, ফায়ার ব্রিগেড সবকিছু বঙ্গোপসাগরের প্রলয়ঙ্করী টর্নেডোর উন্মত্ততা নিয়ে প্রস্তুত। আমি কয়েকজন সৈনিকসহ যেন খড়কুটো, এক নিমিষে উড়ে যাবো।…’ এর পরের ঘটনা সম্পর্কে মইন উ লিখেছেন, ‘স্লুইস গেট খুলে দিতেই পানির স্রোতে যেমন সবকিছু খড়কুটোর মতো ভেসে যায়, তেমনি ভেসে গেলো সব। আমি কোথায়, কে কোথায় বলতে পারলাম না। এক ধাক্কায় অসংখ্য লোক বঙ্গভবনে ঢুকে গেলো। মুহূর্তের ভেতর আমি নিজেকে বঙ্গভবনের মূল ফটকে আবিষ্কার করলাম। …’
এ পর্যন্ত এসেই মইন উ তার ভীরুতা ও আত্মসমর্পণের কাহিনী শুনিয়েছেন। লিখেছেন, ‘জনতা মারমুখী হয়ে উঠতে লাগলো। ওই ভিড়ের মধ্য থেকে দু’জন সৈনিক আমাকে বঙ্গভবনের পেছন দিকে নিয়ে গেলো। সেখানে একটি পুকুর ছিল। … আমি তখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। যে দু’জন আমাকে নিয়ে গেলো সে দু’জন এসেছে ক্যান্টনমেন্ট থেকে। তাদের হাতে অস্ত্র। তাদের চোখের দিকে তাকালাম, ঘোলা চোখ, খুনে দৃষ্টি। বুঝলাম তারা একটা ঘোরের মধ্যে আছে। তারা কোনো কথা বললো না। আমিও বলিনি। জানি কথা বলে কাজ হবে না। যুক্তি বোঝার মতো অবস্থা তাদের নেই। বুঝলাম আমার সময় শেষ। তারা আমাকে গুলি করে মারার জন্যই ভবনের পেছনের দিকে নিয়ে এসেছে। সত্যি সত্যি ওরা রাইফেল তাক করলো। আমি রাইফেলের ক্ষুধার্ত কালো নল দেখলাম। ট্রিগারে আঙুল দেখলাম। কিন্তু আমি নির্বিকার। এক মুহূর্তের জন্য শুধু মায়ের মমতাময়ী মুখটা চোখে ভেসে উঠলো। চোখ বন্ধ করলাম। অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য প্রস্তুত হলাম। মনে মনে শেষবারের মতো কলেমা পড়া শুরু করেছি। জানি হয়তো শেষ করতে পারবো না। …এমন সময়ে একটা চিৎকারে আমার হুঁশ ফিরে এলো।’
এরপর ‘চোখ খুলে’ মইন উ দেখলেন, মিলিটারি পুলিশের একজন সার্জেন্ট এসে রাইফেলের নল দুটি তার দিক থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। ‘সে আমাকে চিলের মতো ছোঁ মেরে নিজের কাছে নিয়ে এলো।’ এখানে এসেই গালগল্প জুড়েছেন মইন উ। রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাককে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছেন। লিখেছেন, ‘খোন্দকার মোশতাক আমাকে দেখে যেন ধড়ে প্রাণ ফিরে পেলেন। ওই অবস্থাতেই তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন।… তারা (অভ্যুত্থানকারীরা) তখন মোশতাকের নামে স্লোাগান দিতে দিতে আমাকে গালাগাল শুরু করলো।…সবার দাবি, তারা জনাব মোশতাককে নিয়েই যাবে। আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়া খোন্দকার মোশতাক জানালেন, তিনি নামাজ পড়ে বের হবেন। তিনি ছিলেন লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি পরা। নামাজ শেষ হতে অনেক সময় নিচ্ছেন দেখে রুমে উঁকি দিয়ে দেখি পাজামা পরতে গিয়ে তিনি তা পরতে পারছেন না। খেয়াল করে দেখলাম পাজামার একই অংশে তিনি দুই পা ঢুকিয়ে দিয়ে বসে আছেন। বুঝলাম, এটা হচ্ছে তার নার্ভাসনেসের কারণে। আমি তাকে পাজামার দুই অংশে দুই পা রাখতে বললাম। তিনি আমার হাত ধরে ফেললেন এবং গাড়িতে উঠা পর্যন্ত আমার হাত ছাড়লেন না। এমনকি আমাকেও তিনি তাঁর সাথে নিতে চাচ্ছিলেন।’ ‘আমি দ্রুতই সবার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঐদিনটা ছিল আসলেই অন্য রকম।…বললাম, আপনাদের সাথে আমিও যাবো।…তবে আমার নিরাপত্তার জন্য আমাকে গাড়ির সামনের আসনে বসতে বারণ করা হলো। সিনিয়র জেসিও বললো, স্যার, আপনি সামনে বসলে আপনাকে মেরে ফেলবে। তাই আমি সবার সাথে গাড়ির পেছনে বসেই রওয়ানা দিলাম।’
পাঠকরা ইতিহাসের আলোকে মইন উ’র বর্ণনা লক্ষ্য করে দেখুন। ‘মারমুখী’ জনতার মধ্য থেকে যে দু’জন তাকে বঙ্গভবনের পেছনে ‘নিয়ে’ গিয়েছিল তারা কি আদর-সোহাগ করতে করতে নাকি ঘাড়ে ধাক্কা দিতে দিতে ‘নিয়ে’ গিয়েছিল সে কথা জানাননি মইন উ। এতেও অবশ্য বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এর পরের অংশটুকুই যথেষ্ট। ‘জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে’ দাঁড়িয়ে পড়া থেকে অস্ত্রধারীদের ‘ঘোলা চোখ, খুনে দৃষ্টি’ এবং ‘বুঝলাম আমার সময় শেষ’ পর্যন্ত শুধু নয়, ‘রাইফেল তাক’ করা এবং গভীর অন্ধকারেও ‘রাইফেলের ক্ষুধার্ত কালো নল’ ও ‘ট্রিগারে আঙুল’ দেখা পর্যন্ত বর্ণনাও বুঝিয়ে দেয়, মইন উ ‘আত্মসমর্পণ’ করেছিলেন।
‘চোখ বন্ধ’ করা এবং ‘মনে মনে শেষবারের মতো কলেমা পড়া’ শুরু করার স্বীকারোক্তিরও নিশ্চয়ই অন্য কোনো অর্থ হতে পারে না। মইন উ’র অবশ্য ‘দোষ’ নেই। কারণ, একটি সত্য কথাও রয়েছে তার বর্ণনায় ‘ঐদিনটা ছিল আসলেই অন্য রকম।’ এজন্যই তাকে সিপাহীদের সঙ্গে ট্রাকের পেছনে বসে (নাকি শুয়ে এবং লুকিয়ে?) যেতে হয়েছিল। কিন্তু মইন উ তার বর্ণনায় কিছু তথ্য এড়িয়ে গেছেন। যেমন জানাননি, কার হুকুম বা অনুরোধে মিলিটারি পুলিশের ওই সার্জেন্ট গিয়ে তাকে বাঁচিয়ে এনেছিলেন।
তবে পাঠকরা মইন উ’র বর্ণনা থেকে দুটি অংশ লক্ষ্য করতে পারেন। প্রথমত, মইন উ জানিয়েছেন, ‘সে সময় তিনি (খন্দকার মোশতাক) রাজ্যের গল্প করতেন। আমার হাতেও তখন অফুরন্ত সময়। গল্প শুনতে খারাপ লাগতো না।’ অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে তার এক ধরনের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিল। পিতার বয়সী মোশতাক তাকে সম্ভবত স্নেহও করতে শুরু করেছিলেন।
দ্বিতীয়ত, ‘তিনি (মোশতাক) আমার হাত ধরে ফেললেন এবং গাড়িতে উঠা পর্যন্ত আমার হাত ছাড়লেন না। এমনকি আমাকেও তিনি তাঁর সাথে নিতে চাচ্ছিলেন।’ এখানে মইন উ সম্ভবত উল্টোটা বলেছেন। তা সত্ত্বেও একটি বিষয় কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেটা হলো, সেনা অফিসার হিসেবে জীবনের শুরুতেই তিনি আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
মইন উ সম্পর্কে বলতে গিয়ে আরেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহকে টেনে আনার কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন উঠতে পারে। দু’জনই আসলে ইতিহাসের ‘সোর্স’ হিসেবে ঘটনাক্রমে এসে গেছেন। অধীনস্থদের কাছে পরাজিত হওয়ার এবং আত্মসমর্পণ করার দিক থেকে দুই জেনারেলের অসাধারণ ‘মিল’ দেখে যে কাউকেই বিস্মিত ও স্তম্ভিত হতে হবে।
পার্থক্য হলো, প্রথমজন সেনাপ্রধান হিসেবে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আত্মসমর্পন করেছিলেন। অন্যদিকে দ্বিতীয়জনের সৈনিক জীবনের শুরুই হয়েছিল আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। জাতির দুর্ভাগ্য হলো,এধরনের কাপুরুষ দু’জন জেনারেলই বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের পদ ‘অলংকৃত’ করে গেছেন!!