২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর দুই দিনের সফরে ঢাকা এসেছিলেন সুজাতা সিং। আওয়ামী লীগের একতরফা নির্বাচনের যখন তোড়জোর চলছে ওই সময় ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের ঢাকা সফর অন্য রকম গুরুত্ব বহন করেছিল।
সেসময় সুজাতা সিং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রধান বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে গণতন্ত্র, নির্বাচন, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিয়ে ভারতের অবস্থান তুলে ধরেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রী, সচিব, এবং জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গেও মতবিনিময় করেন তিনি। এসময় ভারতের অবস্থান তুলে ধরতে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। আর যেকোনো নির্বাচনে সর্বোচ্চসংখ্যক দলের অংশগ্রহণ বাঞ্ছনীয়।’
এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রায় ২০ মিনিট বৈঠক করেন সুজাতা সিং। এ সময় পররাষ্ট্রসচিবসহ অন্য জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এরপর শেখ হাসিনার সঙ্গে একান্তে ৩০ মিনিটের বেশি সময় আলোচনা করেন সুজাতা সিং। মনে করা হয়, একান্ত বৈঠকের সময় ভারতের তৎকালীন কংগ্রেস নেত্বাত্বাধীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কোনো বার্তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি।
৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরপরই ভারতের জাতীয় নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার। তখন ধারণা করা হয়েছিল, মোদি সরকার বিএনপির জন্য ইতিবাচক হবে। একতরফা নির্বাচনে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকার কিছুটা বেকায়দায় পড়বে। যদিও মোদি সরকার সবার আগে সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির কথা জানায়।
সামগ্রিক বিষয় নিয়ে ২০১৪ সালের ১ জুলাই খালেদা জিয়ার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে ভারতীয় দৈনিক দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ভারত সফরের সময় ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশেষ দূতিয়ালী করেন সুজাতা সিং। তিনি বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য বিশেষভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিলেন বলে সেই সাক্ষাৎকারে জানান খালেদা জিয়া।
সেই সাক্ষাৎকারে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে প্রশ্ন করা হয়েছিল- ভারতের পূর্ববর্তী সরকার নির্বাচনে আপনাকে সমর্থন না দেয়ায় আপনি কি হতাশ? জবাবে তিনি বলেন, ‘তাদের পররাষ্ট্রসচিব (সুজাতা সিং) এখানে এসেছিলেন এবং তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন, নির্বাচনে এইচ এম এরশাদের অংশগ্রহণ করা উচিৎ, তা না হলে নির্বাচন হবে না এবং মৌলবাদীরা ক্ষমতায় আসবে। তিনি আমাদেরও প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু পারেননি। কেন নির্বাচনে যেতে পারব না, তা আমরা তাকে বলেছিলাম। আমরা একটা রাজনৈতিক দল, আন্ডারগ্রাউন্ডের দল নই। নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে তাতে অংশগ্রহণের কোনো যুক্তি নেই। এরশাদও প্রকাশ্যে বললেন, তিনি নির্বাচনে যাবেন না। কিন্তু পরে দেখা গেল, কোনো না কোনো পন্থায় হোক… আমি জানি না, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার কোনো ভূমিকা রেখেছিল কি না; অনেকেরই বিশ্বাস যে (এটা হয়েছিল), বিশেষ করে যখন পররাষ্ট্রসচিব এ রকম কথা বললেন…। এরশাদ পরে বললেন, পররাষ্ট্রসচিব তাকে চাপ দিয়েছিলেন এবং একমাত্র তারাই (ভারত) এ নির্বাচনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কমনওয়েলথ ও জাতিসংঘ বলেছে, তারা কোনো একদলীয় নির্বাচন সমর্থন করে না… সেখানে কোনো নির্বাচন পর্যবেক্ষকও ছিলেন না, তাই তারা এটা গ্রহণ করেনি। এ দেশের জনগণও এটা গ্রহণ করেনি। আর তাই, এটা একটা অবৈধ সরকার। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের শিগগিরই নির্বাচন দিতে বলছে।
আওয়ামী লীগ আমাদের বলছে, তোমরা প্রথমে আমাদের বৈধ সরকার বলে স্বীকৃতি দাও, এরপর আমরা সংলাপে আসব। সুতরাং, তাদের অবৈধ হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ হয়ে গেছে…। আমি সুষমাকে বলেছি, কোনো দেশ এমন নির্বাচন দেখেনি, যেখানে পার্লামেন্টের ৩০০ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৫৪ জন (সরকারি হিসেবে ১৫৩ জন) বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ২, ৪, ৫ জন হতে পারেন… তাই বলে ১৫৪ জন? মন্ত্রিসভার সব সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। শেখ হাসিনারও কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না, কিন্তু ডামি প্রার্থী দাঁড় করিয়ে তারা দেখিয়েছে, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে।’
তবে যাইহোক গতকাল বুধবার সুজাতাকে বরখাস্ত করেছে মোদি সরকার। একেবারে আকস্মিকভাবেই। স্বাভাবিক অবসরের সাত মাস আগেই তাকে বরখাস্ত করা হলো। চলতি বছরের ৩১ আগস্ট তার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল।
২৮ বছর আগে ১৯৮৭ সালে পররাষ্ট্রসচিবের পদ থেকে এপি ভেঙ্কটেশ্বরণকে আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই অপসারণ করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। ওই ঘটনার পর এই প্রথম এমন ঘটনা ঘটলো।
ভারতীয় পত্রিকাগুলো বলছে, সুজাতা সিংয়ের ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন মোদি। বিগত সময়ে প্রধানমন্ত্রীর এ অসন্তুষ্টি গোপন থাকেনি। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ চাননি সুজাতা সিং বরখাস্ত করা হোক। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভারত সফর শেষ হওয়ার এক দিন পরই পররাষ্ট্রসচিবের বিষয়ে মোদি সরকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিল।
সুজাতার বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা টিভি রাজেশ্বর রাজীব গান্ধীর আমলে গোয়েন্দা সংস্থার (ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো) পরিচালক ছিলেন। উত্তর প্রদেশের সাবেক এই গভর্নর কংগ্রেসের অনুগত বলে পরিচিত।
২০১৩ সালের আগস্টে পররাষ্ট্রসচিব পদে নিয়োগ পান সুজাতা। তার নিয়োগ নিয়ে তৎকালীন সরকারের মধ্যে বিভক্তি ছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের পছন্দে ছিলেন জয়শঙ্কর। অন্যরা ছিলেন সুজাতার পক্ষে। শেষ পর্যন্ত পেরে ওঠেননি মনমোহন। কারণ সুজাতাকে নিয়োগের পক্ষে সিদ্ধান্তটা আসে খোদ কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর কাছ থেকে।