দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ প্রতিবেদনঃ গত ৩১ দিন ধরে চলমান সরকার বিরোধী অবরোধে এখন কঠোর অ্যাকশনে রয়েছে আওয়ামী সরকার। এতদিন বিএনপির আন্দোলন চলায় তারা ধীরে ধীরে বিএনপি জোটকে দমন করার কৌশল অবলম্বন করেছিলো। সেই সঙ্গে বিএনপির শক্তিও পরীক্ষা করে নেয় সরকার। এখন সরকার বুঝে গেছে বিএনপি-জামায়াতের আসলে ঢাকায় তেমন কোন তৎপরতা নেই।
ঢাকায় অবস্থানরত বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা তেমন কোন আন্দোলন করছেন না। ফলে সরকারের বিশেষ কোন ঝুঁকি নেই। আর যারা তৃণমূল পর্যায়ে আন্দোলন করছে সরকার তাদেরকে সেই সুযোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মঙ্গলবার থেকে সেটা কার্যকর করা হয়েছে।
চলমান আন্দোলন শুরুর আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার এবং দল ভাবতেই পারেনি বিএনপি সমস্ত প্রতিকূলতার মাঝেও মাসাধিক কাল ধরে লাগাতার অবরোধ কার্যকর করে রাখতে পারবে।বিএনপির আন্দোলনে ব্যপক জনসম্পৃক্ততা দেখে তারা এখন মোটামুটি হতবাক।
উপরন্তু শত চেষ্টা করেও ঢাকার বাইরের আন্দোলন এখনও সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসেনি। সেখানে আন্দোলন শুরুর পর থেকে একের পর এক ব্যবস্থা নিলেও কোন ব্যবস্থাই কাজে আসছে না।সরকারের সব কৌশল মার খেয়েছে।
এই কারণে ঢাকার বাইরের একের পর এক নাশকতার ঘটনা ঘটেছে।
সরকারের একটি সূত্র জানায়, যদিও সরকার গত ৩০ দিন ধরেই বলে আসছিল সব কিছুই সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে যতটুকু পরিস্থিতি অস্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে সেটাও ৭-১১ দিনের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবেন।
সরকারের মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের নেতা ও পুলিশ সেটা বললেও পুরোপুরি সেটা করা সম্ভব হয়নি। ওই সময় পাড় হয়ে যাওয়ার পরও কুমিল্লার চৌদ্দ গ্রামে পেট্রোল বোমার মারা ঘটনা ঘটেছে। সাতজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনায় সরকার আরো কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
একদিকে সরকার বলছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, অন্যদিকে সরকার অবরোধ ও হরতালের কারণে পরীক্ষা নিতে পারছে না। পরীক্ষার সময়সূচিও পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। এখন এই পরীক্ষা যথাসময়ে অনুষ্ঠিত করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এই কারণে সরকার এতদিন বিএনপিকে ছাড় দিলেও এখন আর দিতে চাইছে না।
পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য এখন সরকার জিরো টলারেন্সের নীতি থেকে অ্যাকশনে নেমেছে। আর এই অ্যাকশনে নামার পর পরই বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে মঙ্গল ও বুধবার দুই দিনে তিনটি মামলা হয়েছে, বিএনপির সাবেক দুই এমপি সহ দলের অঙ্গ সংগঠনের শতাধিক নেতা আটক হয়েছেন, যেসব নেতারা গ্রেপ্তার হয়েছেন তাদেরকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তাদের সকল জামিন আবেদন নাকচ করে দিচ্ছেন আদালত।
সূত্র জানায়, পাশাপাশি বিএনপির যে সব নেতা আন্দোলনের মাঠে রয়েছেন, হরতাল অবরোধ সফল করছেন ওই সব নেতাদের তালিকা করে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার অভিযান শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
আগামী দুই দিনে আরো ব্যাপক সংখ্যক বিএনপির মাঠ পর্যায়ে থাকা নেতাদের আটক করার টার্গেট রয়েছে। ইতোমধ্যে ওই সব নেতাদের গ্রেপ্তারের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি তালিকাও মাঠে পর্যায়ে পুলিশের কাছে দেওয়া হয়েছে।ইতিমধ্যেই বিএনপি জামাতের অন্ততঃ ৩০০০ নেতা কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে,আন্দোলন স্থিমিত করতে বহু কর্মীকে গুম করা হয়েছে এবং তাদের বাড়িঘর তছনছ করা হয়েছে।
এই সব নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন, হামলা, নাশকতা, সহিংসতার ঘটনা ঘটানোর ইন্ধন দিচ্ছেন, ও অর্থের যোগান দিচ্ছেন। ওই সব নেতাদেরকে গ্রেপ্তার করার জন্য ঢাকাসহ দেশের সকল জেলায় সহ সব থানার পুলিশ কাজ করছে।
এছাড়াও সরকার বিএনপি চেয়ারপারসনকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। তাকে তার অফিস থেকে বাইরে বের করে আনারও উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়াও আরো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার।
এই ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আমরা বিএনপির এই সব জ্বালাও পোড়াও অনেক সহ্য করেছি। এখন এটা সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই কারণে দেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা কঠোর অবস্থানে রয়েছি। বিএনপি যে স্তরের নেতা কিংবা যেই হোন না কেন এখন আর ছাড় দেওয়া হবে না। বিএনপির চলমান আন্দোলন কোন ভাবেই সফল হবে না। তিনি বলেন, আর কয়েকটা দিন সময় পেলেই সব নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
এদিকে আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক বলেন, এখন সরকার আর বিএনপিকে কোন ছাড় দিবে না। এতোদিন আমরা একটু নমনীয় ছিলাম। এখন সেই সুযোগ নেই। সরকারের অ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে। আমরা আরো কঠোর অ্যাকশনে যাবো। আপানারা বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তিনি বলেন, এখন আর এটা বলতে চাই না। দেখতে পাবেন। সরকারতো বলেছিল এসএসসি পরীক্ষা সময় মতো নিবে সেটাতো নিতে পারলো না শিক্ষার্থীরা ও অভিভাবকরা এখন উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠার সমধ্যে রয়েছে। তাদের কি হবে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেটা আমরাও বুঝতে পারছি। কিন্তু আমরা ছাত্রছাত্রীদের জীবন নিয়ে কোন ধরনের ঝুঁকি নিতে পারবো না। এই কারণে পরীক্ষা পিছানো হয়েছে। প্রয়োজন হলে আর একটু পিছাবে। তবে দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সরকারকে কিছুটা সময় দিতে হবে। এখন বিএনপি যা করছে সেটা প্রতিহত করার জন্য বেশি কঠোর হলে মানুষ সরকারের সমালোচনা করবে। কিন্তু যেভাবে বিএনপি মানুষ মারছে জানমালের ক্ষতি করছে এটাতো কেউ বলবে না।
তিনি বলেন, তাছাড়াও আমরা শুরুতেই অতটা কঠোর হতে চাইনি। বিএনপির শক্তিও পরীক্ষা করার চেষ্টা করেছি। আর কয়েকদিন তাদের শক্তি পরীক্ষা করা হবে। এরপর জনগণ দেখতে পাবে সরকারের আ্যাকশন কি। আমরা বিএনপির সঙ্গে কোন ধরনের সংলাপ ও সমঝোতা চাই না। বিএনপি যতদিন পারে আন্দোলন করুক। একদিনের জন্যও তাদের সঙ্গে সমঝোতা হবে না ২০১৯ সালের আগে। তাদের কোন দাবি মানা হবে না। সব আন্দোলন বন্ধ করিয়ে দেওয়া হবে।
সরকারের সূত্র জানায়, সরকার এখন অ্যাকশনে থাকায় কোন ছাড় দিবে না। এতোদিন বেগম খালেদা জিয়াকে বিভিন্ন বিষয়ে ছাড় দিলেও এখন দিচ্ছে না। আর এরই অংশ হিসাবে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে বাসে পেট্রোল বোমা মেরে সাতজনকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করে দুটি মামলা হয়েছে। ওই মামলায় জামায়াতে ইসলামীর ওই এলাকার সাবেক সাংসদ সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরকেও আসামি করা হয়েছে।
মঙ্গলবার ভোররাতে উপজেলার জগমোহনপুর এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বাসে পেট্রোল বোমায় আগুনে সাতজনের মৃত্যু হয়। এরপর ওই দিন রাতেই চৌদ্দগ্রাম থানার এসআই নুরুজ্জামান বাদী হয়ে দুটি মামলা দায়ের করেন। এদিকে ওই মামলায় বিএনপির আরো নেতাদেরও আসামি করা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইন অনুযায়ী করা দুই মামলায়ই বিএনপি-জামায়াতের ৫৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়।
চৌদ্দগ্রাম থানা সূত্রে মেলেছে, ওই সব নেতা ছাড়াও অজ্ঞাত পরিচয় আরো ১৫ থেকে ২০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর কয়েকদিন আগেও চৌদ্দগ্রামে কাভার্ড ভ্যান পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় পুলিশ একটি মামলা করে। ওই মামলায় খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করা হয়।
যাত্রাবাড়িতে বাসে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ ও মানুষ হত্যার ঘটনায় তাকে হুকুমের আসামি করে ২৪ জানুয়ারি দুটি মামলা করে পুলিশ।
এছাড়াও তার বিরুদ্ধে ২ ফেব্রুয়ারি সরকার সমর্থক এক ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য অবরোধ-হরতালে সহিংসতা ও নাশকতায় ৪২ জনের মৃত্যুর জন্য দায়ী করে খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করে আদালতে অভিযোগ দায়ের করেন। আদালত গুলশান থানার ওসিকে অভিযোগ তদন্ত করে ১ মার্চের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
এদিকে খালেদার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করা ছাড়াও কুমিল্লার ঘটনায় জেলা প্রশাসক কার্যালয় সাংবাদিকদের জানিয়েছে, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. গোলামুর রহমানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা ঘটনার তদন্ত করে রিপোর্ট দিবে। ইতোমধ্যে ওই হামলায় জড়িতের গ্রেপ্তারে পুলিশ ব্যাপক অভিযান চালাচ্ছে। পাশাপাশি র্যাব ও বিজিবিও অভিযান পরিচালনা করছে।
এদিকে কুমিল্লার ঘটনায় সরকার কেবল মামলা করেই দায়িত্ব শেষ মনে করেনি এই ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো সতর্ক থাকতে বলেছেন। র্যাবও কাজ করছে। র্যাবের মহাপরিচালক বুধবার চৌদ্দগ্রাম পরিদর্শন করেছেন। সেখানে বলেছেন, যাত্রীবাহী বাসে পেট্রলবোমা মেরে সাতজন পুয়িয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি প্রতিশোধ নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, আন্দোলনের নামে শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোকে হত্যা করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা কী অর্জন করতে চান। এই হত্যাকাণ্ড জাতির জন্য একটি লজ্জার বিষয়।
দুদক সূত্র জানায়, সাত বছর পর গ্যাটকো মামলাটি আবারও সচল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা গ্যাটকো দুর্নীতি মামলার বৈধতার প্রশ্নে জারি করা রুলের শুনানি শুরুর দিন আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি ধার্য করেছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি জেবিএম হাসানের হাইকোর্ট বেঞ্চ বুধবার এ দিন ধার্য করেন। ২৮ জানুয়ারি এ আবেদনটি হাইকোর্টের কার্যতালিকায় আসে। তখন খালেদা জিয়ার আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন দুই সপ্তাহের সময়ের আবেদন করেন। ওই দিন শুনানি শেষে এক সপ্তাহ সময় দিয়ে শুনানির দিন ধার্য করতে আদেশ দেন হাইকোর্ট। সেই হিসাবে বুধবার সেটি কার্যতালিকায় আসে।
এদিকে সরকার বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করছে অন্যদিকে বিএনপির আন্দোলন সফল করতে ভেতরে যারা কাজ করছেন তাদেরকেও আটক করতে অভিযান পরিচালনা করছে। বুধবার বিএনপির লক্ষ্মীপুরের দুই নেতাকে আটক করা হয়। তারা সাবেক সংসদ সদস্য। তারা দুপুরে মতিঝিলে কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা করে বের হবার পর মতিঝিল থেকে আশরাফ উদ্দিন নিজান ও নাজিম উদ্দিন আহমেদকে আটক করে পুলিশ। তাদের আটক করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগের কথা জানায়নি পুলিশ। অবরোধ-হরতালের কারণে সংকট কাটাতে দুই নেত্রীকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মতিঝিলে দলীয় কার্যালয়ের সামনে কয়েক দিন ধরে অবস্থান করছেন কৃষক, শ্রমিক, জনতা লীগের সভাপতি আব্দুল কাদের সিদ্দিকী।
এদিকে আন্দোলনের শুরুর দিকেই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, শমসের মুবিন চৌধুরী, শামসুজ্জামান দুদুকে আটক করা হয়। ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে রিমান্ডেও নেয়া হয়েছে। দশদিনেরও রিমান্ড চাওয়া হয় নতুন করে। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও খালেদার উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী ফালুকে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
এদিকে গত এক মাসে অবরোধ, হরতাল ও সহিংসতার ঘটনায় ৫৮ জনের প্রানহানির ঘটনা ঘেেটছ। এছাড়াও প্রায় ৫’শ গাড়ি পোড়ানোর ঘটনা ছাড়া বিভিন্ন ধরনের নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। সরকার এই সব ঘটনায় বিএনপির আন্দোলনের নেতাদের গ্রেপ্তার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঢাকা ছাড়াও ঢাকার বাইরে থেকে প্রতিনিয়ত সেটা করা হচ্ছে। মঙ্গলবার রাত থেকে বিশেষ সতর্কতাও জারি করা হয়েছে। এরপর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আরো সোচ্চার রয়েছে।
এতো কিছুর পরেও আন্দলন দমন করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী নামানোর সিদ্ধান্তে আলোচনা চলছে সর্বোচ্চ মহলে।