চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে বিদেশী কুটনীতিকদের ফর্মুলায় সরকার যদি সাড়া না দেয় কী হবে? বিএনপি কী অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকবে? নানা অংক চলছে বিএনপির রাজনীতিতে। এদিকে দেশের সন্মানিত নাগরিকদের সংলাপের আহবানে সাড়া দেয়নি সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেবল নিজের ফর্মুলায় অটল আছেন। সরকার চায় এমন উপায় যেখানে আবার তাদের ক্ষমতায় আসার পথ খোলা থাকে। একপক্ষীয় নীতিতে চলার ফলে জট খুলছে না রাজনীতিতে।
গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা আপসহীননেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবার আরো কঠোর হলেন। এবার তিনি উপায় খুঁজতে নিজের দলের নেতাদের বেড়িয়ে আসতে বললেন। আত্মগোপনের নামে ‘নিরাপদে লুকিয়ে থাকা’ বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের প্রায় আড়াই হাজার কেন্দ্রীয় নেতাকে সরকার বিরোধী আন্দোলনে রাজপথে নামার নির্দেশ দিয়েছেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া।
একইসঙ্গে অবরোধসহ হরতালকালে ২০-দলীয় জোট নেতাদের মালিকানাধীন গণপরিবহন বন্ধ রেখে ‘সাময়িক ক্ষতি’ মেনে নিতে ‘বিশেষ অনুরোধ’ করা হয়েছে। যেসব নেতা নির্দেশ-অনুরোধ উপেক্ষা করবেন, তাদের বিরুদ্ধে পরবর্তীতে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার ‘কঠোর হুঁশিয়ারি’র কথাও জানানো হয়েছে সংশ্লিষ্টদের। বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য।
সূত্রমতে, গত এক সপ্তাহ ধরেই খালেদা জিয়ার ‘নতুন নির্দেশনা’ গুলশান কার্যালয়ে অবস্থানকারী বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য, একজন ভাইস চেয়ারম্যান, মহিলা দলের একজন নেত্রী ও জাসাসের রাজনীতি সংশ্লিষ্ট বিএনপি চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইংয়ের একজন কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট নেতাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন।
ইতিমধ্যে ৫ শতাধিক নেতাকে খালেদা জিয়ার নির্দেশনা জানানো হয়েছে বলেও সূত্রগুলো দাবি করেছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় রাজনীতি সংশ্লিষ্ট বরিশাল জেলা বিএনপির দু’জন নেতা প্রতিনিধি মারফত বিএনপি চেয়ারপারসনের নির্দেশনা পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। ঢাকা মহানগর বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় স্বেচ্ছাসেবক দলের একজন প্রভাবশালী নেতা ও মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক পদে থাকা আরও দু’জন নেতাও নির্দেশনা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয় সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের দাবি, ৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া বিরতিহীন অবরোধসহ দফায়-দফায় হরতালকালে বিএনপির কেন্দ্রীয় ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের প্রায় আড়াই হাজার কেন্দ্রীয় নেতা একদিনের জন্যও মাঠে নামার চেষ্টা করেন নি। এমনকী এসব নেতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহানগর, জেলা কিংবা থানার কোনও নেতারও যোগাযোগ নেই। কোনো-কোনো নেতা আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ককে পুঁজি করে নিরাপদে রয়েছেন। এমনকি অতিতে বিএনপির দুঃসময়ে বলিস্ঠ এবং সাহসী ভূমিকা রাখা প্রবাসী বিএনপি নেতাদেরও তেমন তৎপর দেখা যাচ্ছে না এবার।এদের মধ্যে কেউ কেউ দেশে অবস্থান করে নিজস্ব ব্যবসা বানিজ্যে ব্যস্ত রয়েছেন বলে জানা গেছে।এর বাইরে অনেকেই ‘ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের’ নানাভাবে ‘ম্যানেজ’ করে নিরাপদে আছেন।
লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান দেশনায়ক তারেক রহমান বিভিন্ন মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে ‘নিষ্ক্রিয়’ ও কথিত ‘আত্মগোপনে’ থাকা নেতাদের একটি তালিকা তৈরি করে বিএনপি চেয়ারপারসনের কাছে ই-মেইল করে পাঠিয়েছেন।
তালিকাভুক্ত ওইসব নেতাদের মধ্যে যারা ‘গণপরিবহন’ ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন, অবরোধ-হরতালকালে তাদের মালিকানাধীন গণপরিবহনগুলো আন্দোলনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ‘নিয়মিত চলছে’ বলেও খালেদা জিয়াকে তথ্য দিয়েছেন তারেক রহমান। সংশ্লিষ্টদের রাজপথে নামার চূড়ান্ত নির্দেশ দিতে খালেদা জিয়াকে পরামর্শও দিয়েছেন বিএনপির দ্বিতীয় প্রধান নেতা।
সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের মতাতমকে গুরুত্ব দিয়েই খালেদা জিয়া তার প্রতিনিধিদের প্রায় আড়াই হাজার কেন্দ্রীয় নেতাকে ‘প্রকাশ্য হওয়ার’ চূড়ান্ত নির্দেশ জানিয়ে দিতে বলেন। প্রসঙ্গত, বিএনপি ও দলটির ১১ অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনে কেন্দ্রীয় পদধারী নেতার সংখ্যা ৫ হাজারেরও বেশি। এরমধ্যে সর্বোচ্চ শতাধিক নেতা কারাবন্দী রয়েছেন। কারাবন্দীদের কেউ-কেউ আন্দোলন থেকে দূরে থাকতে সরকারপক্ষের লোকজনের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতেই ‘স্বেচ্ছায়’ মামলার আসামি হয়ে কারাগারকে ঠিকানা করেছেন বলেও বিএনপির বিশ্বস্ত নীতিনির্ধারকদের কাছে তথ্য-প্রমাণ রয়েছে।
কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে খালেদা জিয়ার ‘নতুনবার্তা’ পাঠানোর দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট (গুলশান কার্যালয়ে অবস্থানকারী) বিএনপির এক নেতা জানান, অবরোধ-হরতালে বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক নেতা দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতার পাশাপাশি তাদের গণপরিবহন ঢাকাসহ বিভিন্ন রুটে চালানোর তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পর বিএনপি চেয়ারপারসন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছেন। বিশেষ করে ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসের ‘ঢাকা পরিবহন’, ভোলা-ঢাকা রুটে চলাচলকারী ২০-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক বিজেপি সভাপতি ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থের মালিকানাধীন এমভি লালী, এমভি বালিয়াসহ ২০-দলীয় জোটের কমপক্ষে অর্ধশত নেতার গণপরিবহন চলাচল বন্ধ না হওয়ায় বিষয়টি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান ভালো চোখে নেননি।
তাদের গণপরিবহন চলাচল করার কারণে বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বলেও মনে করেন তারা। তৃণমুলে আন্দোলনের মাঠে থাকা নেতারা বিষয়টি প্রতিনিধি মারফত খালেদা জিয়ার কাছে অভিযোগ আকারে উপস্থাপনও করেছেন। এজন্যই খালেদা জিয়া নেতাদের প্রকাশ্য হওয়ার নির্দেশনার সঙ্গে যাদের গণপরিবহন রয়েছে, তাদেরকে আন্দোলনের স্বার্থে ‘সাময়িক ব্যবসায়ীক ক্ষতি’ মেনে নিতে ‘বিশেষ অনুরোধ’ করেছেন।
চলমান এসব নির্দেশনা যারা অমান্য করবেন, বিএনপির রাজনীতিতে তাদের অবস্থান ‘প্রশ্নবিদ্ধ ও অবিশ্বস্ত’ তালিকায় স্থান দিয়ে সময়-সুবিধামত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে দিতে বলা হয়েছে।