ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দাবি অনুযায়ী বহুল আলোচিত ফেসবুক পেইজ বাঁশেরকেল্লার এডমিন প্রধান গ্রেফতার হয়েছেন। যার নাম খোন্দকার মো. জিয়া উদ্দীন ফাহাদ। এরপরেও বাঁশেরকেল্লা পেইজটি কিভাবে চালু রয়েছে তা নিয়ে পাঠকের মনে ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ এডমিন প্রধানকে (!) ধরতে পারলেও বন্ধ করতে পারছে না কেনো বাঁশেরকেল্লা সাইটটি?
অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য, খোন্দকার মো. জিয়া উদ্দীন ফাহাদের পরিবার মূলত আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। ফাহাদের বাবা মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার ছিলেন। ফাহাদের এক ভাই জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট। ফাহাদের বাবা আওয়ামীলীগের আমলে বাঁশখালি উপজেলার সাধনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হয়েছেন। ফাহাদের বাবা নিউজবিডিসেভেন.কমকে জানান, ফাহাদকে গোয়েন্দা পুলিশ গত ৯ মার্চ কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজের তার মেয়ের বাসা থেকে তুলে নিয়ে গেছে। চারদিন পর শুক্রবার তাকে বাঁশেরকেল্লার সঙ্গে জড়িয়ে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এ ঘটনায় আমরা বিস্মিত হয়েছি। তার পরিবার আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত দাবি করে ছেলে ফাহাদের মুক্তিও চেয়েছেন তিনি। কুমিল্লা গোয়েন্দা পুলিশের একজন সদস্য জানান, ফাহাদকে আটকে রেখে তার বাবার কাছে বিশাল অংকের টাকা দাবি করা হয়। টাকা দিতে অস্বীকার করায় ফাহাদকে ঢাকার মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তারপর কিভাবে কী হয়েছে আমি জানি না।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক সূত্র মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় বাঁশেরকেল্লা, বাকশাল, তিতুমীরের বাঁশেরকেল্লা, ভিশন২০২১, বিডি-ন্যাশনালিস্ট, ফ্রিডম অব স্পিচ, জেড ফোর্সসহ যেসব পেইজ সরকারের বিপক্ষে প্রচারণা চালায় তাদেরকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। ৪৮ ঘন্টা সময়ও বেঁধে দেন। কিন্তু গোয়েন্দা পুলিশ প্রযুক্তিগত বিষয়ে অপেক্ষাকৃত কম পারদর্শী হওয়ায় কাউকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়নি। এমনকি কোন পেইজ কোন দেশ থেকে পরিচালিত হচ্ছে তার সঠিক তথ্যও তারা ট্রেস করতে পারেনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় সম্প্রতি গোয়েন্দা সংস্থার উর্ধ্বতনদের ডেকে এ ব্যর্থতার কারণে ভর্ৎসনাও করেন।
আর এরই প্রেক্ষিতে ফাহাদকে বাঁশেরকেল্লার প্রধান এডমিন হিসেবে গ্রেফতারের নাটক সাজানো হয়েছে। অব্যাহত চাপের মুখে এ নাটকটি করতে গোয়েন্দা পুলিশ বাধ্য হয়েছে বলেও জানায় সূত্রগুলো। এদিকে পুলিশের দাবি অস্বীকার করে বাঁশেরকেল্লার পক্ষ থেকে একটি নোটিশ জারি করা হয়েছে। নোটিশে বলা হয়েছে, ‘বিভিন্ন টেলিভিশনে ও অনলাইন নিউজে ব্রেকিং নিউজ দেয়া হচ্ছে- ‘বাঁশেরকেল্লা পেইজের প্রধান সম্পাদক আটক। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে আপনাদের প্রিয় পেইজ বাঁশেরকেল্লার প্রধান এডমিনসহ সকল এডমিন নিরাপদ আছেন, আলহামদুলিল্লাহ।’ নোটিশে আরো লেখা হয়েছে, ‘এর আগেও কয়েকবার এরকম নাটক করে এডমিন গ্রেপ্তারের গুজব ছড়িয়েছিল সরকার। মেইনস্ট্রিম মিডিয়া সম্পূর্ন নিয়ন্ত্রন করার সাথে সাথে তারা স্যোশাল মিডিওয়ার উপরও কালো থাবা ফেলার অপচেষ্টা করে আসছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু জনতার কথা কি আর আটকে রাখা যায়!! সকলের কাছে দোয়া চাই, যেন অতীতের ন্যায় ভবিষ্যতেও সব সময় আমরা সত্যের পথে অবিচল থেকে সাহসিকতার সাথে সত্য উন্মোচনের কাজ চালিয়ে যেতে পারি। আল্লাহ আমাদেরকে সাহায্য করুন। আমীন।’ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মূখপাত্র মনিরুল ইসলাম শুক্রবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে জানান, বৃহস্পতিবার বিকেলে কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজের আবাসিক এলাকার একটি বাসা থেকে ফাহাদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে, ফাহাদ যদি বাঁশেরকেল্লার এডমিন প্রধান হয়েই থাকেন তবে সেই পেইজ বন্ধ হচ্ছে না কেন। সেই প্রশ্ন এখন সবার মনে। ‘বাকশাল’ পেইজের একজন এডমিন এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, কোন পেইজে প্রধান এডমিন বলতে কিছু নেই। একজন পেইজটা ক্রিয়েট করেন তিনি থাকেন প্রথম এডমিন। তিনি অন্যদের এডমিন এবং এডিটর করতে পারেন। এডমিনরা চাইলে একটা পেইজকে যেকোন সময় বন্ধ করে দিতে পারে এবং অন্যদের বাদ দিয়ে দিতে পারে। ফাহাদ যদি বাঁশেরকেল্লার প্রধান এডমিন বা এডমিনই হতো তাহলে নিশ্চয় সরকার তার আইডিতে ঢুকে পেইজটাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিত। পেইজটা পুলিশের হাতে চলে যেত। পুলিশ পেইজটা বন্ধ করে দিতো। কিন্তু তারা সেটা কেন করলেন না? গোয়েন্দারা নিশ্চয় ফাহাদের ফেসবুক আইডিতে ঢুকেই নিশ্চিত হবেন তার আইডিতে কী কী পেইজ রয়েছে। যেহেতু বাঁশেরকেল্লা এখনও বন্ধ হয়নি এবং নোটিশ দিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেবার পরও পুলিশ কোন সদুত্তর দিতে পারেনি তারমানে বুঝা যায়, ফাহাদ বাঁশেরকেল্লার এডমিন নয়। এটা সরকারের অন্যান্য নাটকের মতো একটি নাটক। মেইন স্ট্রিম মিডিয়ার পর সোস্যাল মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের নির্লজ্জ্ব চেষ্টা এটি। অন্যদিকে গোয়েন্দা পুলিশের যে দল নেতৃত্ব দিয়ে ফাহাদকে গ্রেফতার করেছেন তাদেরই একজন জানান, ২০১৩ সালে বাঁশেরকেল্লার মুল পেইজ বন্ধ হওয়ার পর নতুন করে চালু হয়। এরপর শুরু হয় তদন্ত। দীর্ঘ তদন্ত শেষে গোয়েন্দারা জানতে পারে চট্রগ্রাম বিভাগের কোনো এক স্থান থেকে বাঁশেরকেল্লা পরিচালিত হয়ে আসছে। গত কয়েকদিন আগে তারা জানতে পারেন কুমিল্লায় অবস্থান করছেন ওই ব্যক্তি। এরপর গত সোমবার (৯মার্চ) বিকেল থেকেই হানা দেওয়া হয়। সোমবার ফাহাদ গ্রেফতার হয়েছে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও আসলে সেদিন গ্রেফতার করা হয়নি। ওইদিন ফাহাদ সেখান থেকে সরে পড়ে। এরপর বৃহস্পতিবার তাকে গ্রেফতার করা হয়। এ বিষয়ে ‘বাঁশেরকেল্লার’ একজন এডিটর জানান, বাঁশেরকেল্লা মূলত কোন স্থান থেকে পরিচালিত হয় সেটা পুলিশের মতো বাহিনীর পক্ষে বের করা সম্ভব নয়। তারা তাদের ধারণা থেকে একেক সময় একেকটা বলেন। তারা এর আগে দাবি করেছেন, দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত হয়। এখন বলছে, চট্টগ্রাম থেকে। এগুলো সব মিথ্যা। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে এবং সত্য প্রকাশের লড়াইয়ের সাহসী অনলাইন এক্টিভিস্টদের ভয় দেখাতেই মূলত এসব অপপ্রচার ও মিথ্যা নাটক সাজানো হচ্ছে। উল্লেখ্য, ফেসবুকে বাশেঁর কেল্লা পেইজটির লাইক সংখ্যা ৯ লাখের ওপরে। জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্র ও ধর্ম নিয়ে আপত্তিকর প্রচারণা চালানোর অভিযোগে ২০১৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পেইজটি বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ কম্পিউটার সিকিউরিটি ইনসিডেন্ট রেসপনস টিম। কিন্তু পরে আবার `বাঁশেরকেল্লা` নামে নতুন করে তা চালু হয়। পেইজটি মোট ৩ বার বন্ধ করে দেয়া হয়। তারপরও পেইজটির লাইক সংখ্যা ৯ লক্ষের বেশি।