উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের ১৩/বি নম্বর সড়কের ৪৯/বি নম্বর বাড়ি। এ বাড়ি থেকে তুলে নেয়া হয় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে। তুলে নেয়ার পাঁচ দিন হয়ে গেলেও তার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। এ নিয়ে পরিবার ও দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে।
গতকাল সকালে ওই বাড়িটির সামনে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িটিতে পুলিশের দুই সদস্য পাহারা দিচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর তারা একটি গাড়িতে চলে যান। উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টর কল্যাণ সমিতির কয়েকজন নিরাপত্তারক্ষীকে সেখানে দেখা গেল। বাড়ির সামনের রাস্তায় কোন ব্যক্তিকে সন্দেহভাজন হলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। পুলিশের হয়রানির আতঙ্কে ওই বাড়ির অন্যান্য লোকজন সেখান থেকে চলে গেছেন।
বাড়িটির প্রতি তলায় দুটি করে ব্লক রয়েছে। দ্বিতীয় তলার ২/বি নম্বর ফ্ল্যাটে ছিলেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। তৃতীয় তলায় হাবিব নামে এক ব্যাংক কর্মকর্তা থাকেন। দ্বিতীয় তলায় ২/বি নম্বর ফ্ল্যাটে ডাকাডাকি করলে ফাতেমা নামে গৃহকর্মী দরজা খোলেন। তিনি জানান, ওই ফ্ল্যাটে আর কেউ থাকেন না। তিনিই শুধু থাকেন।
বাড়ির কেয়ারটেকার আশরাফ জানান, বাড়িটি মূলত সিরাজউদ্দৌলা নামে এক ব্যক্তির। তিনি মারা গেছেন। তার মেয়ে বাড়িটির বর্তমান মালিক। তিনি আমেরিকায় থাকেন। বাড়িটি আমি ও দুই দারোয়ান মিলে দেখাশোনা করি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই বাড়ির এক দারোয়ান জানান, বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিনকে তুলে নেয়ার সময় পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ওই বাসায় আর কোন নেতার যাতায়াত ছিল কিনা বা কে কে আসতেন তা আমাদের কাছে জানতে চায়।
ওই দারোয়ান আরও জানান, একটি সাদা মাইক্রোবাসে পরা সাত-আটজন যুবক বাড়ির মূল গেট খুলতে বলে। গেট খুলতে দেরি হলে তাদের পরিচয় জানতে চাইলে আমাদের চড়থাপ্পড় মেরে নিচতলার ছোট একটি কক্ষে আটকে রাখে। এরপর তারা দ্বিতীয় তলায় গিয়ে সালাহউদ্দিনকে গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে ফেলে। সালাহউদ্দিন ওই সময় লুঙ্গি পরা ছিলেন। তারা সাদা মাইক্রোবাস করে ১১ নম্বর রোডের দিকে চলে যায়।
উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টর কল্যাণ সমিতির নিরাপত্তারক্ষী মনসুর আহমেদ জানান, আমার রাতের বেলায় বেশি ডিউটি থাকে। ১৩/বি নম্বর রোডের মাথায় আমাদের প্রধান অফিস। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তাচৌকি রয়েছে। তিনি আরও জানান, রাতের বেলায় সাইকেল নিয়ে আমি ৩ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন রাস্তায় টহল দিই। আবাসিক এলাকা হওয়ায় রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এলাকায় লোকজনের আনাগোনা কমে যায়। সেদিন ১১ নম্বর রোডের মাথায় একটি আবাসিক ভবনের সামনে সাদা মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। সুঠাম দেহের ছয় থেকে সাতজন যুবক। তাদের পরিচয় জানতে চাইলে তারা নিজেদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দেয়। এরপর আমি নিজের কাজে চলে যাই।
আরেক নিরাপত্তারক্ষী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, আনুমানিক রাত সাড়ে ১২টায় ১৩/বি নম্বর রোডের ৪৯ নম্বর বাড়িতে ওই মাইক্রোবাসটি দাঁড়ায়। পরে ওই বাড়ির এক ব্যক্তিকে তারা তুলে নিয়ে চলে যায়। তাকে কেন ধরা হচ্ছে নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে ওই মাইক্রোবাসের লোকজনের কাছে জানতে চাইলে তারা জানায়, আসামি হিসেবে তাকে ধরা হয়েছে। ওই নিরাপত্তারক্ষী জানান, তাদের গায়ে কোন বাহিনীর পোশাক ছিল না। তবে একজনের হাতে রাইফেল দেখা গেছে। ওই বাড়ির সামনের ৫১/সি নম্বর বাড়ির এক দারোয়ান জানান, দায়িত্বরত অবস্থায় সেদিন বাড়ির বাইরে একটি সাদা মাইক্রোবাসে করে কয়েকজন যুবককে আসতে দেখেন। তারা গাড়ি থেকে নেমেই বাড়ির নিরাপত্তারক্ষীদের মারধর শুরু করে। পরে শুনি ওই বাড়িতে আশ্রয় নেয়া বিএনপির এক নেতাকে ধরে নিয়ে গেছে। এদিকে ঘটনার পর থেকে ওই বাড়ির বাসিন্দারাও বাড়িতে থাকছেন না। নিরাপত্তাকর্মীরা দায়িত্ব পালন করলেও তারা আতঙ্কে আছেন বলে জানিয়েছেন।
যে ফ্ল্যাট থেকে সালাহউদ্দিন আহমেদকে তুলে নেয়া হয় ওই বাসায় থাকা গৃহকর্মী ফাতেমা জানিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কয়েক দফায় তার কাছ থেকে তথ্য জানতে চেয়েছে। তবে তিনি এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কোন কথা বলতে রাজি হননি। তিনি শুধু বলেন, আপনাদের সঙ্গে কথা বললে আমার ক্ষতি হবে। হাইকোর্টে প্রতিবেদন: ‘সালাহউদ্দিনের খোঁজ পায়নি’ কোন বাহিনী বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে খুঁজে বের করে আদালতে হাজির করতে জারি করা রুলের শুনানি আজ পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে।
বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী এবং বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল এ শুনানি মুলতবি করে। এদিন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। ঢাকা মহানগর পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র্যাব, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশের বিশেষ শাখার প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
প্রতিটি বিভাগই জানায়, সালাহউদ্দিন আহমেদকে পুলিশের কোন শাখা আটক বা গ্রেপ্তার করেনি। তাকে খুঁজেও পাওয়া যায়নি। পুলিশ তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাচ্ছে। অ্যাটর্নি জেনারেল রুল নিষ্পত্তি করে দেয়ার আবেদন জানান। সালাহউদ্দিন আহমেদের স্ত্রীর পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। তিনি বলেন, আমরা পুলিশের প্রতিবেদনের অনুলিপি পাইনি। এ বিষয়ে আমাদের কিছু জবাব দেয়ার আছে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মামলা। এর সঙ্গে মানুষের জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন জড়িত। পরে আদালত আজ পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করে।
পরিবারের সদস্যদের দেয়া তথ্যমতে, গত মঙ্গলবার রাতে উত্তরার একটি বাড়ি থেকে সালাহউদ্দিন আহমেদকে সাদা পোশাকের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে যায়। তার সন্ধান চেয়ে বৃহস্পতিবার হাইকোর্টে একটি আবেদন করেন তার স্ত্রী হাসিনা আহমেদ। সেদিন হাইকোর্ট তাকে কেন খুঁজে বের করে হাজির করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিল। একইসঙ্গে আদালত এও মন্তব্য করেছিল, যে কোন নিখোঁজ নাগরিককে খুঁজে বের করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
সালাহউদ্দিনকে ফেরত দিন: ন্যাপ-এনডিপি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও ২০দলীয় জোটের মুখপাত্র সালাহউদ্দিন আহমেদকে অক্ষত অবস্থায় তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছে জোটের শরিক দল এনডিপি ও ন্যাপ। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো পৃথক বিবৃতিতে তারা এ দাবি জানান।
বাংলাদেশ ন্যাপ চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি ও মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেয়া সরকারের দায়িত্ব। সরকার যদি এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, তাহলে তাদের ক্ষমতায় থাকার কোন অধিকার নেই। সালাহউদ্দিন আহমেদ একজন রাজনীতিবিদ। তাকে অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে না দেয়া হলে দেশের রাজনীতিতে কালো ক্ষত সৃষ্টি হবে। বিবৃতিতে বলা হয়, সরকার রাজনৈতিকভাবে আন্দোলন মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে গুম, হত্যা, জেল-জুলুমের মাধ্যমে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা করছে। একজন সাবেক প্রতিমন্ত্রীকে উঠিয়ে নিয়ে গায়েব করে ফেলার ষড়যন্ত্র হচ্ছে, যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিনের নিখোঁজের ঘটনার দায় বর্তমান সরকার কোনভাবেই এড়াতে পারে না। সালাহউদ্দিনের কিছু হলে তার দায়-দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে। আমরা আশা করি, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সরকার সালাহউদ্দিন আহমেদকে আদালতে হাজির করবে।
ওদিকে আরেক বিবৃতিতে ২০ দলীয় জোটের শরিক দল এনডিপি’র চেয়ারম্যান খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মঞ্জুর হোসেন ঈসা বলেছেন, দেশের রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে। দেশব্যাপী চলমান অবরোধ-হরতাল বন্ধ করতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সংলাপে অবশ্যই বসতে হবে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ফর্মুলা সরকারকেই বের করতে হবে। যেই ফর্মুলায় সকল দল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে। বিবৃতিতে তারা বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাউদ্দিন আহমেদসহ যাদেরকে গুম করা হয়েছে তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে দেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টির দাবি জানান।