বিরোধী জোটের টানা অবরোধ-হরতাল এবং সরকারের অনড় অবস্থানের প্রেক্ষিতে দেশে জননিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়েছে বলে মনে করেন খ্যাতিমান নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহীদুজ্জামান।
তিনি বলেন, সরকার পরিস্থিতির স্বাভাবিকতা বোঝানোর জন্য কথায় কথায় ঢাকা শহরের যানজটের কথা প্রচার করে। কিন্তু এটা বাস্তব চিত্র নয়। ঢাকা শহরে তো ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও যানজট হতো। কিন্তু আজকে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষা হচ্ছে না। অর্থনীতির ওপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে তা অর্থমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন। শিল্প-বাণিজ্য ভয়ঙ্কর খারাপ অবস্থায় নিপতিত হয়েছে। সরকার শুধু বিরোধী দলকে ব্লেম করার মধ্য দিয়েই তার দায়িত্ব শেষ করছে। এটা তো স্বাভাবিক রাষ্ট্রের চরিত্র হতে পারে না। তিনি বলেন, জনসাধারণের পক্ষ থেকে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারকে একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানোর ব্যাপারে সম্মত করা না গেলে পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ জায়গায় চলে যাবে, যা আমরা এখন হয়তো কল্পনাও করতে পারছি না।
বিরোধী জোটের আন্দোলন দমনের বর্তমান কৌশল থেকে সরকার যদি সরে না আসে, তাহলে সন্ত্রাস ও সহিংসতা নতুন মাত্রায় চলে যেতে পারে এবং তাতে প্রাণঘাতি আধুনিক অস্ত্র এবং উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যাবে না। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেরই এমন অভিজ্ঞতা রয়েছে।
সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিরোধী জোটের অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচি টানা দুই মাস ধরে চলছে। এই কর্মসূচি কোথায় গিয়ে থামবে তা কেউই জানে না। অন্যদিকে সরকারও তার অবস্থানে অনড়। এই পটভূমিতে দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াবে এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক শাহীদুজ্জামান বলেন, বিরোধী জোট তাদের যেসব রাজনৈতিক দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছিল সরকার সেসব দাবির ব্যাপারে কোনো সাড়া দেবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, এক সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। এ অবস্থায় চারদিক থেকে অনিশ্চয়তা ঘনীভূত হচ্ছে। সরকার যতই বল প্রয়োগ করছে, ততোই সামগ্রিক পরিস্থিতি নৈতিকতার দিক থেকে তাদের বিপক্ষে চলে যাচ্ছে। সরকারের রাজনৈতিক বৈধতার সঙ্কট ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। দেশে-বিদেশে সবার কাছে একটা বিষয় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে যে, দ্রুত একটি সত্যিকার নির্বাচন দেওয়ার প্রশ্নে সরকার তার অঙ্গীকার ভঙ্গ করছে। কারণ, ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনের আগে তারা বলেছিল যে, নিয়ম রক্ষার ওই নির্বাচন শেষে তারা দ্রুতই একটি সত্যিকার নির্বাচন দেবে। কিন্তু এখন তারা সেখান থেকে পুরোপুরিই সরে গেছে। এ অবস্থায় সন্ত্রাস-সহিংসতার অভিযোগ সত্ত্বেও বিরোধী দলের প্রতি জনসাধারণের সহানুভূতি পরিষ্কারভাবেই বেড়ে যাচ্ছে।
বিরোধী দলের আন্দোলন ব্যর্থ হলে সেটার ফল কি দাঁড়াবে এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক শাহীদুজ্জামান বলেন, সরকার যদি বিরোধী দলের আন্দোলনকে আমলে না নিয়ে এটাকে দমনের পথেই চলতে থাকে, তাহলে এটা শেষ পর্যন্ত সন্ত্রাসকেই উল্টো নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে পারে। মায়ানমার এবং থাইল্যান্ডসহ অনেক দেশেই এমনটি দেখা গেছে। কোনোভাবে যদি দেশের ভিতরে ব্ল্যাক আর্মস বা অবৈধ অস্ত্রের চালান ঢুকে পড়ে এবং সেটা সহিংসতাকারীদের হাতে পৌঁছে যায়, তবে সেটা আমাদের জন্য ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনবে এবং সত্যিকার অর্থেই তা দেশে গৃহযুদ্ধের ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, এটা তো প্রমাণিত যে আমাদের দেশের ভিতর দিয়েই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে অস্ত্রের চালান যেতো। সুতরাং আমাদের এখানেও অবৈধ অস্ত্রের চালান ঢুকে পড়া অসম্ভব কিছু নয়। আর সরকারের অব্যাহত দমন-পীড়নের মুখে এ ধরনের অস্ত্রের চালান হাতের নাগালে পেয়ে গেলে যে কোনো সহিংসতাকারী গোষ্ঠীই সেটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে। তিনি বলেন, এ রকম সহিংসতাপূর্ণ অনিশ্চিত পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে সেটার পরিণতিতে আরও ব্যাপকভিত্তিক সহিংসতার নিয়ন্ত্রণ মৌলবাদী জঙ্গিদের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ কারণেই পশ্চিমা দেশগুলো আমাদের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে খুবই উদ্বিগ্ন। তারা ভালো করেই জানে যে, সহিংসতাকে দীর্ঘমেয়াদী ধারাবাহিকতায় যেতে দিলে সেটার পরিণতি কি হতে পারে।
বাংলাদেশে টেলিভিশন টক শো’র জনপ্রিয় মুখ অধ্যাপক শাহীদুজ্জামান বলেন, সরকার হয়তো আশঙ্কা করছে যে, তারা এই মুহূর্তে ক্ষমতা ছাড়লে তাদেরকে বড় রকমের প্রতিশোধমূলক পরিস্থিতির মুখে পড়তে হতে পারে। সে কারণেই তারা ক্ষমতা ছাড়তে কিংবা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দিতে নারাজ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, চলমান পরিস্থিতি যতোই প্রলম্বিত হবে, প্রতিশোধ আশঙ্কার ব্যাপ্তিও বাড়তে থাকবে ততোই। তিনি বলেন, সরকার সহিংসতার জন্য দায়ী করছে বিরোধী জোটকে। অন্যদিকে বিরোধী জোট রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের জন্য অভিযুক্ত করছে সরকারকে। কিন্তু নির্মোহ বাস্তবতা হলো, চলমান সরকার বিরোধী আন্দোলনে সহিংসতার হয়তো বিশেষ মাত্রা যুক্ত হয়েছে, তবে বাংলাদেশে এত ব্যাপকভিত্তিক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস অতীতে কখনোই দেখা যায়নি। সবকিছু দেশে-শুনে মনে হচ্ছে, এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের পরিকল্পনা অন্য কোনো দেশ থেকে আসছে। এগুলো স্থানীয় পরিকল্পনায় হচ্ছে না। এর মাধ্যমে কার্যত সর্বব্যাপী সন্ত্রাস-সহিংসতাকেই উস্কে দেয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানোর ব্যাপারে সরকারের প্রত্যাখ্যানমূলক ভূমিকার ফলে দেশের জননিরাপত্তা ব্যবস্থা ইতোমধ্যেই সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়েছে। এটা সরাসরি যুদ্ধাবস্থা না হলেও তারচেয়ে কম কিছুও নয়। প্রতিটি মানুষই প্রতিমুহূর্তে আতঙ্কে থাকছে। কখন কার দরজায় কে কড়া নাড়বে, কে কাকে ধরে কোথায় নিয়ে যাবে, জীবিত ফিরে আসতে পারবে কিনা, এমন আতঙ্ক ও আশঙ্কা সবার মধ্যে সব সময়। দেশের কারাগারগুলোতে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি বন্দী রয়েছে এখন। এদের অধিকাংশই বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী। কারাগারগুলোতে কেউ ৪ ঘণ্টার বেশি ঘুমাতে পারে না। পালাক্রমে কেউ ঘুমাচ্ছে তো, অন্যরা দাঁড়িয়ে থাকছে। এভাবে চলতে থাকলে কিছু দিনের মধ্যে পুরো দেশটাই কারাগারে পরিণত হয়ে যাবে।