বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা কি গোল্ডফিশ প্রজাতির! স্বল্পায়ু স্মৃতির! মাত্র এক সপ্তাহ আগের কথা। বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের আক্রমণের লক্ষ্যবিন্দুতে ছিলেন তামিম ইকবাল।
কি গণমাধ্যম, কি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সর্বত্রই চলছিল একচোখা সমালোচনা। তামিম ইকবাল যেন জীবনে কোনদিন ব্যাট হাতে ধরেনি কিন্তু জোর করে দলে জায়গা দখল করে রেখেছেন। চলছিল তামিমের মু-ুপাত। অবিবেচকের মতো তামিমের ব্যর্থতার কথা বলে আমরা তীরবিদ্ধ করছিলাম বাংলাদেশের সাবেক সফল অধিনায়ক তামিমের চাচা আকরাম খানকে। ব্যাপারটা যেন এমন, যত দোষ তার সবটাই আকরাম খানের। ব্যাপারটি এমন পর্যায়ে পৌছেছিল যে, পাকিস্তানের বিপক্ষে মারকুটে ব্যাটিং প্রদর্শনীর মাধ্যমে সেঞ্চুরির পর তা উদযাপন করতে গিয়ে নতুন সমালোচনার জন্ম দেন তামিম ইকবাল। পরে জানা গেল, তামিম আর আকরামই নয়- গভীর রাতে ফোন করে তামিমের বউকেও কটুবাক্য বর্ষণ করেছেন আমাদের ভদ্রক্রিকেটপ্রেমীরা।
বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের তখন মনে হচ্ছিল গোল্ডফিশ প্রজাতির মানুষ। তামিম ইকবাল ও তার পরিবারকে এভাবে আক্রমণ করতে পারে বাংলাদেশের মানুষ? বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছিল। আপনি নিশ্চয়ই ভুলে গেছেন। আকরাম খানের হাত ধরে বাংলাদেশ পা রেখেছিল বিশ্বকাপের মঞ্চে। নাফিস ইকবাল খান নামে তামিমের বড় ভাইটিও খেলেছেন জাতীয় দলে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে তামিম নামের ছেলেটি আসার আগে ওপেনাররা পেসবল মোকাবিলার সময় দোয়া-দরুদ পড়তেন। কারও কারও বুকে তাবিজও দেখা যেতো। কারও কারও ঠোঁট চড়াচড়া করতো। তামিম পাল্টে দিয়েছিল ওপেনারদের শরীরী ভাষা। আপনারা নিশ্চয়ই ভুলে গেছেন তার চাহনিকে আক্রমনাত্মক বলে অভিযোগ করেছিল ভারতের বোলাররা। দর্শকদের অবাক করে দিয়ে শটের ফুলঝুরি ছুটাচ্ছিল ব্যাটে।
আমরা মনে রাখিনি তামিমের কৃর্তি। লডর্সের অনার্স বোর্ডে যে কার জন্য বাংলাদেশের নামটি উৎকীর্ণ হয়ে আছে তা। মনে রাখিনি বিশ্বকাপের মঞ্চ থেকে ভারতকে বিদায় করে দিয়ে যে ছেলেটি স্থান করে নিয়েছে শচীন তেন্ডুলকরের আত্মজীবনীতে। লর্ডস-ওল্ড ট্রাফোর্ডের সেঞ্চুরি, উইজডেন বর্ষসেরার খেতাব। ইংল্যান্ডের মতো দলের বিরুদ্ধে টেস্টে টানা ৫ হাফসেঞ্চুরির পর আঙুল গুনে গুনে করেছিল উদযাপন। সেখানেই শেষ নয়, পরের ম্যাচটিতেই করেছিল সেঞ্চুরি। পরাশক্তির বিরুদ্ধে ওয়ানডেতে টানা ৫ হাফসেঞ্চুরির কথা। বিশ্বকাপ খেলতে যাবার আগের ১০টি ম্যাচে ২টি হাফ সেঞ্চুরিসহ তার গড় ছিল ২৭।
সবচেয়ে বড় কথা পুরো টিম যখন বিশ্বকাপে খেলতে গেছেন তখন চিকিৎসকের টেবিলে তামিম। সংশয় ছিল খেলতে পারা না পারার। আমরা মনে রাখিনি বাংলাদেশের সাবেক কোচ স্টুয়ার্ট ল’এর ‘তামিম সেই খেলোয়াড়দের একজন, যে মুডে থাকলে যে কোন পরিস্থিতিতে দলকে জিতিয়ে দিতে পারে’ কথাটি। কিন্তু সেটা বিশ্বকাপেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল তামিম। বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে তিনশতাধিক রান চেজ করে জেতার দিন যে ছেলেটি ৯৫ রানের ইনিংস খেলে। কিন্তু আমরা সেটা বিবেচনাতেই আনিনি। হ্যাঁ একজন পরিণত ব্যাটসম্যান হিসেবে বিশ্বকাপে ২৫ গড়ে তার ব্যাটিং নিশ্চয়ই আশাব্যাঞ্জক হয়নি। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ক্যাচ ফেলার পর সে সমালোচনায় আরেক ডিগ্রি বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু আপনার কি চোখে ভাসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এক মাচেই দুইটি দুর্দান্ত ক্যাচের মাধ্যমে কিভাবে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিয়েছিল তামিম। যা ক্রিকেট ইতিহাসের অবিশ্বাস্য ক্যাচগুলোর মধ্যে স্থান করে নিয়েছে।
মনে না থাকলে ইন্টারনেটে সার্চ করুন। আপনার চোখের সামনে ভেসে ওঠবে শূন্য ভাসমান তামিমের একহাতে লুফে নেয়া ক্যাচের দৃশ্য। পাকিস্তানের বিপক্ষে তৃতীয় ম্যাচের বাতিল হওয়া ক্যাচটির কথাই ধরুন না। কিন্তু আমরা সবাই দ্রুত ভুলে যাই। বিশ্বকাপের পর তামিমের বিরুদ্ধে সমালোচনার উৎসব এমন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল যে, ক্রিকেটপ্রেমীর বাইরে চট্টগ্রামের একজন ভূমিপুত্র হিসেবে আমার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। কেবল অপেক্ষা ছিল একটি চমৎকার জবাবের।
তামিম ইকবালকে ফের প্রমাণ করতে হলো সে কেবল পারফরমার নন, একজন ক্লাস ব্যাটসম্যান। দুদিন আগেও অনেকের চোখে অপাংক্তেয় হয়ে যাওয়া এই ব্যাটসম্যানটিই! টানা দুই সেঞ্চুরিতে দিয়েছেন সমালোচনার অসাধারণ জবাব। আপনি নিশ্চয় অস্বীকার করতে পারবেন না সিরিজে পাকিস্তান যে প্রতিটিতেই বড় ব্যবধানে হেরেছে তার অন্যতম প্রধান অবদান ছিল তামিমের। তিনটি ম্যাচেই ওপেন করতে নেমে কি ধারাবাহিক রান করেছেন। অর্জন করেছেন একটি ম্যান অব দ্যা ম্যাচসহ ম্যান অব দ্যা টূর্ণামেন্টের পুরস্কার। প্রথম ম্যাচটির সেরা খেলোয়াডের পুরস্কারও কি পেতে পারতেন না তামিম!
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তিনটি ম্যাচ যদি দেখে থাকেন তবে আপনাকে স্বীকার করতেই হবে পরিণত ব্যাটিং কাকে বলে, আক্রমণাত্মক ব্যাটিং কাকে বলে, টিকে থাকা কাকে বলে সবই দেখিয়ে দিয়েছেন চোখে আঙুল দিয়ে। পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম সেঞ্চুরির পর তার উদযাপন নিয়ে শুরু হয়েছিল সমালোচনার নতুন মাত্রা। যারা মুখে ফেনা তুলেন এক ম্যাচ ভালো খেলে একবছর বসে খান তামিম। তাদের জন্য তামিমকে আবার প্রমাণ করতে হলো হঠাৎ, আকস্মিক পারফরমান সে নন। পরের ম্যাচে সেঞ্চুরি এবং তার পরের ম্যাচে হাফসেঞ্চুরি করে জবাবটা বেশ কার্যকরভাবেই দিয়েছেন। জবাবটা দিতে হয়েছে আমাদের গোল্ডফিশ মেমোরির জন্য। বাস্তবে ধারাবাহিক ব্যাটিংয়ের কথা যদি ধরেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে তামিমের চেয়ে বেশি ধারাবাহিক ব্যাটসম্যান আর কে আছে? এখানেও সে এক নম্বর।
১৪৩ ইনিংসে ৩৫ বার ৫০ ছুঁয়েছেন তামিম। গড়ে ৪.০৮ ইনিংসে ১ বার। দ্বিতীয় স্থানে সাকিব ১৪৩ ইনিংসে ৩৪বার ৫০ ছুঁয়েছেন। গড়ে ৪.২০ ইনিংসে ১বার। ধারাবাহিকতার প্রতিমূর্তিতে পরিণত হওয়া মুশফিক? ১৩৮ ইনিংসে ২৫ বার ৫০ ছুঁয়েছেন। গড়ে ৫.৫২ ইনিংসে ১ বার। কাছাকাছি ধারাবাহিকতার অন্য দুইজন হচ্ছেন- শাহরিয়ার নাফীস (৪.৪১ ইনিংসে ১ বার) ও এনামুল বিজয় (৪.৫০ ইনিংসে ১ বার)। মুশফিক এখন আমাদের সেরা ও সবচেয়ে ধারাবাহিক ব্যাটসম্যান। কিন্তু একটা সময় গেছে যখন টানা ৩৯ ওয়ানডে ইনিংসে কোন ফিফটি পায়নি সে। ৫ ইনিংসে ৪ বার শূন্য রানেও আউট হয়েছেন। আর তামিমের ক্যারিয়ারের বাজে সময়টা ছিল ২০০৯ সালে টানা ১৪ ইনিংসে ফিফটি না পাওয়া। বাংলাদেশে বিশ্বকাপ তারকা রিয়াদ ওয়ানডেতে ফিফটি ছিল না টানা ১৫ ইনিংস।
কল্পনা করে দেখুন তো, তখন মুশফিক-রিয়াদকে ছুড়ে ফেললে কি হতো! কথা হচ্ছে, এই পারফরম্যান্স তামিমের জন্য কি নতুন? বাংলাদেশের রেকর্ড বুককে এখন তামিম বুক বললে অতুক্তি হবে না। রেকর্ড বইয়ের অনেক কিছুই তামিমের দখলে। রেকর্ড বইটা দেখুন, কী ভীষণ তামিমবান্ধব!
বিশ্বরেকর্ড:
ওয়ানডে ইতিহাসে তিন ম্যাচের সিরিজে সবচেয়ে বেশি (৪০) মারার বিশ্বরেকর্ড।
দেশীয় রেকর্ড: যেখানে তামিম এক নম্বর:
১. লডর্সের অনার্স বোর্ডে নাম লেখানো একমাত্র বাংলাদেশি।
২. উইজডেন বর্ষসেরা প্রথম বাংলাদেশি।
৩. ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সবচেয়ে ধারাবাহিক ব্যাটসম্যান ১৪৩ ইনিংসে ৪.০৮ ইনিংসে গড়ে ৫০ ছুঁয়েছেন ৩৫ বার।
৪. বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ (১৫৪) রান।
৫. বাংলাদেশের পক্ষে এ বছর সর্বোচ্চ (৫৭) বাউন্ডারি।
৬. বাংলাদেশের সর্বোচ্চ (৫০৪) বাউন্ডারি।
৭. বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের মধ্যে ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি (৪৪৪১) রান।
৮. টেস্টে সবচেয়ে বেশি (২৭৪৩) রান।
৯. তিন ধরনের ক্রিকেট মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি (৭৮১৮) রান।
১০. ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি (২৯টি) হাফ সেঞ্চুরি।
১১. তিন ধরনের ক্রিকেট মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি (১২) সেঞ্চুরি।
১২. তিন ধরনে সবচেয়ে বেশি (৬০) হাফ সেঞ্চুরি।
১৩. ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি (৫৮) ছক্কা।
১৪. তিন ধরনে সবচেয়ে বেশি (৮৫) ছক্কা।
১৫. ওয়ানডেতে টানা সর্বাধিক ৫ (পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ) হাফসেঞ্চুরি।
১৬. টেস্টে টানা সর্বাধিক ৫ (নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ইংল্যান্ড) হাফসেঞ্চুরি।
১৭. তিন ম্যাচের সিরিজে বাংলাদেশে সেরা গড় ১৫৬।
১৮. বাংলাদেশের উদ্বোধনী জুটিতে দ্বিতীয় ১৫৮ এবং শীর্ষ ৫ টির দুইটির পার্টনার।
১৯. দ্বিপাক্ষিক সিরিজে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ রান ৩১২ এবং শীর্ষ দ্বিতীয় শীর্ষ ৩০০ সংগ্রহ। যেখানে যৌথ বা শীর্ষ ১০:::-
২০. বাংলাদেশের ব্যাক টু ব্যাক তৃতীয় সেঞ্চুরীয়ান।
২১. টি-টোয়েন্টিতে দ্বিতীয় সর্বাধিক (৭০২) রান।
২২. ওয়ানডেতে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চারটি ইনিংসের ৩টি (১৫৪, ১৩২, ১২৯)।
২৩. ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি ৬টি (দ্বৈত সাকিব-তামিম) সেঞ্চুরি।
২৪. টেস্টে ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরী।
অনুসন্ধান করলে আরও কিছু পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই! জগতে কিছু মানুষ আছে যাদের কাছে সেরাটা আদায় করার জন্য ব্যয় করতে হয় একটু প্রশংসা। কিন্তু তাদের যদি সমালোচনার এসিডে চুবিয়ে দেন তাহলে ঘটে উল্টোটি। তামিম ইকবাল এ ধাঁচের মানুষ। বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের সাবেক মনস্তত্ত্ববিদ প্রফেসর ডা. সালাউদ্দিন কাওসার বিপ্লবের সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে জেনেছি, তামিম দেখতে যে রকম রাগি রাগি আসলে কিন্তু তার উল্টোটি। একটু অন্তর্মুখী প্রকৃতির। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, একটু প্রশংসার বদলে তামিমের কপালে জোটে ধমক আর সমালোচনা। আমরা সব দ্রুতই ভুলে যাই। পাকিস্তান সিরিজের পর তামিম আবার মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘ক্রিকেট খেলাটা একটা চক্রের মতো। কখনও কেউ ভালো খেলতে থাকবে, আবার খারাপ সময় আসবে। খারাপ করলে সমালোচনা হবে।
কিন্তু গত কয়েক মাসে আমার খারাপ পারফর্মেন্সের জন্য আমার পরিবারের সদস্যদের অনেক খারাপ সময়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। মাঠে আমি ব্যাট করি, আমার পরিবার নয়। আমি আপনাদের মাধ্যমে সবাইকে অনুরোধ করবো আবার খারাপ সময় এলে আমাকে যা বলার বলবেন, আমার পরিবারকে দয়া করে এর মধ্যে টানবেন না।’ বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে একটাই অনুরোধ, অবিবেচকের মতো সমালোচনা মুখর হবেন না। দুর্দিনে পাশে থাকুন।