গত ২৮ এপ্রিল ৩ সিটি নির্বাচনে নজীর বিহীন অনিয়ম ও কারচুপির মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বিভিণ্ন মহলের কাছে চরম বিতর্কিত হয়েছে। একইসঙ্গে এ নির্বাচনে আস্থা হারিয়েছেন নির্বাচন কমিশন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রিসাইডিং অফিসাররাও বলে অভিযোগ করেছিলো বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০দলীয় জোট সহ দেশের অন্যান্য নির্বাচন পর্যবেক্ষনকারী সংগঠন সমূহ।
সরকার দলীয় ক্যাডাররা নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সবার সহায়তা নিয়ে দল সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে ব্যপক ভোট জালিয়াতি করার অভিযোগে ২০ দলীয় জোট নির্বাচন বর্জন করেছে।
অপরদিকে সরকার দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরাও অনেকে ভোট কারচুপি ও জালিয়াতির অভিযোগ করেন। এমন কি ভোট কারচুপি করেও কোন কোন ওয়ার্ডে দল সমর্থিত প্রার্থী জয়ী হতে পারেননি।
তবে কিছু কিছু বিদ্রোহী প্রার্থী জয় লাভ করেছেন। এ সব মিলিয়ে সিটির প্রায় ওয়ার্ডেই সরকারি দল আওয়ামী লীগের জয় ও পরাজয় হওয়া প্রার্থী এবং তাদের সমর্থকদের মধ্যে বিরাজ করছে চাপা উত্তেজনা, ক্ষোভ ও অভ্যন্তরীণ কোন্দল। এ কোন্দল যে কোন সময়ে দলের ভয়ংকর সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে। সিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল সামগ্রিক জয় পেলেও দলের মধ্যে শত্রুতা বেড়েছে। এ যেন আওয়ামী লীগই আওয়ামী লীগের শত্রু। অন্যদিকে এ নির্বাচনের বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্তের বিষয়টি নিয়েও চাপ রয়েছে আন্তর্জাতিক মহলে। পাশাপাশি দেশি গোয়েন্দা সংস্থাও নির্বাচন ও নির্বাচন পরবর্তী সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর খোঁজখবর রাখছেন বলে জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে বিরোধীদের প্রশ্ন থাকলেও বেশিরভাগ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর হয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত ও তাদের বিদ্রোহীরাই। এখন চলছে এলাকার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। মাঝে মাঝে সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়ছে ক্ষমতাসীনরা। বিশেষ করে যে ওয়ার্ডে বিদ্রোহীরা জয় পেয়েছে ওই এলাকাতেই এমন ঘটনা বেশি ঘটছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন যুবলীগ নেতা আরিফুর রহমান তুহিন। তবে ২৮ এপ্রিলের নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী আবুল হাসেম হাসুর কাছে বিপুল ভোটের ব্যাবধানে হেরে যান তিনি। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীও তুহিনকে বাদ দিয়ে হাসুর পক্ষে কাজ করে।
এ নিয়ে এলাকায় চাপা উত্তেজনা চলছিল। আর নির্বাচনের পর দলের সঙ্গে ‘বেঈমানি’ এবং এলাকার আধিপত্য নিয়ে দুই গ্রুপ এখন চরম উত্তেজনায়। গত ১১ ও ১২ মে ওই উত্তেজনার সহিংস প্রকাশও ঘটে। আদাবরের মনসুরাবাদে দু’পক্ষের রক্তক্ষয়ী এ সংঘর্ষে কয়েকজন আহত হয়। যাদের দু’জন আসলাম ইসলাম সায়মন(২২) এবং মো. শহীদ(২৭) এখনো আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আহত এ দু’জনের স্বজনরা দাবি করছেন, তারা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হাসুর কর্মী ছিল। আর যারা হামলা করেছে, তারা আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী তুহিনের কর্মী। নির্বাচনের আগে হাসুর কর্মীদের নিস্ক্রিয় থাকতে এবং নিজেদের সঙ্গে কাজ করতে বলেছিল তুহিনের কর্মীরা। এরপর নির্বাচনে পরাজিত হলে হাসুর বেশকিছু কর্মীকে অব্যাহত হুমকি দিয়ে আসছিল তারা। এ নিয়ে এলাকায় চাপা উত্তেজনা চলছে।
এ বিষয়ে আদাবর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) গাজী রুহুল ইমাম বলেন, ‘মূলত এলাকার অধিপত্য নিয়ে এসব সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় দুইপক্ষ থেকে তিন-চারটি মামলা হয়েছে। আমরা ১৪ জনকে গ্রেপ্তারও করেছি।’ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত কাউন্সিলর মনির চৌধুরী পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন, আওয়ামী লীগ মনোনীত পরাজিত প্রার্থী মোক্তার হোসেনকে হারিয়ে জয়লাভের আগে ও পরে তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে নিবার্চনে যারা তাকে ভোট দিয়ে জিতিয়েছে তাদেরকেও প্রতিপক্ষের কাউন্সিলর প্রার্থীর লোকজন হুমকি দিচ্ছে। বিষয়টি থানা পুলিশকে জানিয়ে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
এ নিয়ে মগবাজার এলাকায় নির্বাচনের পর থেকেই চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। এভাবে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯২টি ওয়ার্ডে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর জয়-পরাজয় নিয়ে সরকার দলীয় ও বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জের ধরে কাউন্সিলর প্রার্থীরা একে অপরকে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। আবার ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে খুন করার হুমকি দেয়া হচ্ছে।
নির্বাচনের পর হত্যার হুমকি পেয়ে নবনির্বাচিত ১১ কাউন্সিলর প্রার্থী ইতোমধ্যে পুলিশের কাছে মৌখিক অভিযোগ করেছেন। এর মধ্যে উত্তরে পাঁচ জন এবং দক্ষিণে ছয় জন কাউন্সিরকে হুমকি দেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ অভিযোগগুলো গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছে বলে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর দাবি। এছাড়া কাউন্সিলর প্রার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় অন্তত ১০টি মামলা হয়েছে। আবার কাউন্সিলর প্রার্থীদের সমর্থনকারী দলীয় নেতাকর্মীদেরকেও প্রতিপক্ষের লোকজনকে হুমকি দেয়ার অভিযোগও পেয়েছে পুলিশ। নির্বাচিত ও পরাজিত কাউন্সিলরদের ক্যাডার বাহিনী প্রতিপক্ষের ভোটারদেরও হুমকি দিচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। সব মিলে কাউন্সিলর প্রার্থীদের নির্বাচন কেন্দ্রিক অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে যেকোন সময় বড় ধরনের সাংঘর্ষিক ঘটনার পাশাপাশি খুনোখুনির ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছে গোয়েন্দারা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘নির্বাচন পরবর্তী সময় পুরো রাজধানীকে কঠোর নিরাপত্তায় আনা হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতির উপর নজর আছে পুলিশের। অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। যেকোনো অভিযোগও গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে আইন গত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’ ঢাকার দুই সিটিতে কাউন্সিলরদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ব্যাপারে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এম এ আজিজ বলেন, ‘সিটি নির্বাচনে আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল মেয়র পদে জয়লাভ। ফলে আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকরা মেয়র প্রার্থীদের নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলেন। এ কারণে কাউন্সিলর প্রার্থীদের তেমন নজর দেয়ার সুযোগ ছিল না। তবে এখন বিদ্রোহী প্রার্থীসহ যেসব প্রার্থী জয়ী হয়েছে তাদের সঙ্গে কথা বলে এলাকায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনা হবে।
অভিযোগ পাওয়া যায়, ২৮ এপ্রিল নির্বাচনের পর গভীর রাতে এক কাউন্সির প্রার্থীর পক্ষে কাজ করায় ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক কে এম আরমানকে রাজধানীর মতিঝিল এলাকা থেকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যায় প্রতিপক্ষের লোকজন। তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ড (আরামবাগ) নির্বাচিত কাউন্সিলর একেএম মমিনুল হক সাঈদের পক্ষে কাজ করেন। আবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ইলিয়াছুর রহমান প্রতিপক্ষ মো. সেলিমের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী হামলা, কেন্দ্র দখলের অভিযোগ নির্বাচন কমিশনের কাছে দেয়ার পর তাদের মধ্যে চরম বিরোধের সৃষ্টি হয়। এলাকায় একে অপরের বিরুদ্ধে ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী দিয়ে পাল্টাপাল্টি হামলার পরিকল্পনার অভিযোগ পেয়েছে পুলিশও। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকায় উত্তেজনা চলছে। সূত্র জানায়, নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের জের ধরে কাউন্সিলর প্রার্থীদের বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ নিয়ে ডিবি ও র্যাবের গোয়েন্দা টিম মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে। গোপনে অপরাধী ও প্রার্থীদের গতিবিধি নজরদারিতে রাখছে সাদা পোশাকের গোয়েন্দারা।
গোয়েন্দা তথ্যমতে, নির্বাচন চলাকালীন যেকটি ভোট কেন্দ্রে কারচুপি, সংঘর্ষ, অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে, তা আওয়ামী লীগের একাধিক কাউন্সিলর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে আগে থেকেই দ্বন্দ্ব বিরোধের কারণে হয়েছে। একই সঙ্গে বিএনপির পক্ষ থেকেও নির্বাচনী এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগুলোরও খোঁজখবর নিচ্ছে গোয়েন্দারা। নির্বাচনের পরও ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের নিয়ন্ত্রণে থাকা অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠতে না পারে, এমন তথ্য থেকে অপরাধীদের উপর চোখ রাখা হচ্ছে।