দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ প্রতিবেদনঃ বাংলাদেশে কর্মস্থলে নারীর যৌন নিপীড়নের মাত্রা ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। কর্মজীবী নারীরা বস কিংবা কলিগদের কাছে প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের ধরণ ভিন্ন হওয়ায় নির্যাতনকারীর পরিচয় সব সময় গোপন থাকছে। আড়ালে থেকে যাচ্ছে যৌন নিপীড়নের লোমহর্ষক সব ঘটনা। নিজের এবং সংসারের কথা চিন্তা করে নারীকর্মীরা এসব মুখ বুজে সহ্য করছেন। নিপীড়নের মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছালে কেউ কেউ নীরবে চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। বিভিন্ন সরকারি অফিস, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মিডিয়া হাউস, কর্পোরেট হাউস, প্রাইভেট অফিস, হাসপাতাল, প্রাইভেট ক্লিনিক, গার্মেন্টস ও বায়িং হাউসগুলো থেকে অনুসন্ধান চালিয়ে জানা যায় এর ভয়াবহ চিত্র।
বেসরকারি সংস্থা উইম্যান ফর উইম্যান এর এক গবেষণায় বলা হয়, নারীকর্মীরা কর্মক্ষেত্রে সাধারণ হয়রানি ছাড়াও যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। এতে আরো বলা হয়, শতকরা ২৬ জন গার্মেন্টসকর্মী, ৩৫ জন গৃহকর্মী, ২ জন দিনমজুর, ১৫ জন কর্মজীবী নারী ধর্ষণের শিকার হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী বলেন, বর্তমান সভ্যসমাজে হাতেগোনা কিছু বিকৃত চিন্তাসম্পন্ন মানুষের জন্য কর্মজীবী নারীরা এমন পরিস্থিতিতে পড়ছেন। মানসিক হতাশা, পারিবারিক অশান্তি ও সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে এসব কুরুচিপূর্ণ কাজকর্ম দিন দিন বেড়ে চলেছে।
সূত্র জানায়, বিভিন্ন অফিসে বা কর্মস্থলে নারীদের যৌন নিপীড়নের দুই একটা ঘটনা মাঝে মধ্যে প্রকাশ হয়ে পড়ে। এ নিয়ে কিছুদিন তোলপাড় চলে দেশব্যাপী। নারী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো নানা কর্মসূচি করে। কিন্তু এর পরও যৌন নিপীড়ন থামছে না। সুযোগ পেলে কিছু সিনিয়র কর্মকর্তা তাদের অধিনস্ত নারী কর্মকর্তাকে এমনকি নারী সহকর্মীদের বাগে আনার রাস্তা খুঁজেন। অনেকে ফাইল কিংবা স্ক্রিপ্ট গ্রহণ করার সময় ইচ্ছে করে নারীর হাতের আঙুলে ছোঁয়া লাগান। যেন সেই স্পর্শে লুকিয়ে আছে স্বর্গীয় কোনো সুখ। কোউ কোনো প্রকার আপত্তি করলে আটকে রাখা হয় পদোন্নতি। ইচ্ছাকৃতভাবে কর্মঘণ্টার অতিরিক্ত সময় অফিসে আটকে রাখা হয় বিভিন্ন অজুহাতে। অফিসিয়াল বিভিন্ন কাজের অজুহাতে বস কিংবা ঊর্ধ্বতনদের বাসায় ডাকা হয়। কোনো কোনো সময় ইচ্ছার বিরুদ্ধে নারীদের একরকম জোর করেই বিভিন্ন অফিস পার্টিতে বসের সঙ্গে যেতে বাধ্য করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে অনেকের কর্মক্ষেত্রে সমস্যার পাশাপাশি দাম্পত্য জীবনেও টানাপোড়নের সৃষ্টি হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায় বেশ কয়েকটি ঘটনার কথা। শারমিন সুলতানা (ছদ্ম নাম) পুলিশের একজন কনস্টেবল। হালকা-পাতলা গড়ন, মায়াবী চেহারা, চলন-বলনেও অনেক স্মার্ট। শারমিন সুলতানার পোস্টিং হয় রাজধানীর একটি থানায়। ঐ থানায় যোগদানের কয়েকদিনের মাথায় ওসি'র কুদৃষ্টি পড়ে শারমিনের ওপর। ওসি প্রায় সময় শারমিনকে ডেকে তার রুমে নিয়ে বসিয়ে রাখতেন। এরপর ওসি'র আচরণ আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ওসি তাকে বিছানায় যাবার আহ্বান জানান। এতে রাজি হননি তিনি। এরপর উল্টাপাল্টা ডিউটি দিয়ে শারমিনকে হয়রানি করতে থাকেন ওসি। শারমিনকে রাস্তায় টহল ডিউটিতে পাঠাতে থাকেন নিয়মিত। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় অতিরিক্ত পরিশ্রম করার কারণে শারমিনের গর্ভপাত ঘটে। ওসি'র অমানবিক আচরণের বিচার চেয়ে শারমিন দ্বারস্থ হন একটি মানবাধিকার সংস্থার কাছে। তারা শারমিনের অভিযোগ গ্রহণ করলেও এ ব্যাপারে বাড়তি ঝামেলায় যেতে চাননি। পরবর্তীতে শারমিন অন্যত্র বদলি হয়ে যান।
একটি মিডিয়া হাউসের কম্পিউটার অপারেটর সুপ্তি। তার পাশের কম্পিউটারে বসে কাজ করেন সহকর্মী জামিল। কাজের ফাঁকে জামিল সুপ্তিকে নানাভাবে মন ভোলানোর চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে সুপ্তির কাছে প্রেম নিবেদন করেন। সুপ্তি জামালকে জানিয়ে দেয় তার 'বয়ফ্রেন্ড' আছে। এরপর থেকে শুরু হয় সুপ্তিকে নানাভাবে মানসিক নির্যাতন। একদিন সুপ্তির ই-মেইলে ৫৫টি পর্নোছবি আসে। এছাড়া কম্পিউটারের সার্ভার থেকে সুপ্তির বিভিন্ন কাজের ফাইল মুছে দেয়া হতো। এমন অবস্থায় একদিন চাকরি ছেড়ে দেন সুপ্তি।
রাজধানীর অভিজাতপাড়া গুলশানের একটি কর্পোরেট অফিস। ঝকঝকে-তকতকে গোছানো অফিসটিতে ৩৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে ৯ জন নারী। প্রতিষ্ঠানটির কাজ আমদানি-রফতানি নির্ভর। জব সেটিসফেকশনে কোনো অভাব না থাকলেও প্রতিমুহূর্তে চাকরি ছেড়ে দিতে ইচ্ছা করে অনন্যার। কারণ আর কেউই নন, স্বয়ং তার বস আনোয়ার সাহেব। প্রথম প্রথম আনোয়ার সাহেব অনন্যাকে নোংরা জোকস শোনাতেন। ভদ্রতার খাতিরে অনন্যাও হাসতেন। সুযোগ পেলেই আনোয়ার সাহেব অনন্যার হাত ধরেন। যৌন উত্তেজক মন্তব্য ছুড়ে দেন হাসতে হাসতে।
সংসারের কথা চিন্তা করে সবকিছু নীরবে সহ্য করতেন অনন্যা। কিন্তু এক রাতে তার মোবাইল ফোনে অশ্লীল এসএমএস পাঠান তার বস। এসএমএসটি পড়ে অনন্যার স্বামী উত্তেজিত হয়ে ঘুম থেকে অনন্যাকে জেগে তুলে নানান প্রশ্ন করেন।
স্বামীর প্রশ্ন বানে জর্জরিত হন অনন্যা। কিন্তু স্বামীর কোনো প্রশ্নের জবাব দেয়া সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। ভেঙে যায় তার সাজানো সুখের সংসার। বসের কুপ্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায় চাকরিও চলে যায় অনন্যার।
একটি মধ্যম সারির দৈনিক পত্রিকার রিপোর্টার কল্পনা বিশ্বাস কাজ করতেন নারী-শিশু বিটে। তার ওপর কুদৃষ্টি পড়ে পত্রিকার চিফ রিপোর্টারের। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে তিনি কল্পনাকে বাগে আনার চেষ্টা করেন। কল্পনা বুঝেও সবকিছু না বুঝার ভান করেন। বিশেষ প্রতিবেদনের আইডিয়া দেয়ার নামে চিফ রিপোর্টার কল্পনাকে তার বাসায় ডাকতেন। ডাকে সাড়া না দেয়ায় তিনি কল্পনার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। দিতে থাকেন ওল্টাপাল্টা এ্যাসাইনমেন্ট।
চিফ রিপোর্টার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন কল্পনা বেয়াদব। এরপরও বিভিন্ন ফন্দি আটতে থাকেন চিফ রিপোর্টার। তিনি কর্মঘণ্টা শেষ হওয়ার পরও প্রায়ই মিটিংয়ের নামে কল্পনাকে অফিসে বসিয়ে রাখতেন রাত ১০টা-১১টা পর্যন্ত। ১১টার পরে জানিয়ে দিতেন মিটিং হবে না। চিফ রিপোর্টারের এমন আচরণ মেনে নিতে পারেননি কল্পনা। তিনি এসব কাউকে না জানিয়েই চাকরি ছেড়ে দেন।
রাজধানীর শান্তিনগর এলাকায় একটি মিডিয়া হাউজে চাকরি করেন জুঁই। নিতান্তই পেটের তাগিদে অল্প বেতনে ১০টা-৫টা অফিস ডিউটি করেন তিনি। কাজের ফাঁকে বিভিন্ন সময় জুঁইকে বস ডেকে কাজের কথার পরে রোমান্টিক গল্প জমান। আকার ইঙ্গতে তার সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কের মাজেজা দেন। জুঁই তা বুঝতে পারেন। কিন্তু সংসারের অভাবে কথা চিন্তা করে বসের মন যুগিয়েই চলতে হয় তাকে।
শামীম আরা বেগম একজন ছোট-খাটো হ্যান্ডিক্রাফট ব্যবসায়ী। ব্যবসা ছেড়ে রিসিপশনিস্ট পদে চাকরি নেন একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। যোগদানের আগে কথা হয় ৬ মাসের মাথায় পদোন্নতি দেয়া হবে। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও পদোন্নতি হয়নি তার। এ বিষয়ে বসের সঙ্গে কথা বললে তাকে জানিয়ে দেয়া হয় এখানে পদোন্নতির বিশেষ 'মেথড' আছে। তা রপ্ত করতে পারলে পদোন্নতি হবে। এসব কথা পাত্তা না দিয়ে পদোন্নতির জন্য রাজনৈতিক চাপ দেয়া হয়। এতেও হিতে বিপরীত হয়। শামীম আরাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। চাকরি ক্ষেত্রকে অনিরাপদ মনে করে শামীম আরা এখন ব্যবসা করেন।