ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ আলোচিত তিস্তার পানি আনতে গিয়েই মন্ত্রীত্ব হারান ডা. দীপু মণি। তিস্তা চুক্তি সইয়ে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যেখানে মমতাকে বুঝাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন সেখানে বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মণি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন মমতাকে। মমতার সঙ্গে তার এই আচরণেই ক্ষুব্ধ হয়ে প্রধানমন্ত্রী পরবর্তীতে তাকে আর মন্ত্রীপরিষদে রাখেননি বলে জানা গেছে।
‘‘কূটনৈতিক সূত্রে আগেই ইঙ্গিত মিলেছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন ঢাকা সফরে তিস্তা চুক্তি নিয়ে যে কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা হবে না, সে কথা এ দিন স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। শুধু তাই নয়, এ ধরনের অমীমাংসিত বিষয়ে আগামী দিনেও রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা না করে ভারত সরকার যে একতরফা কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না, এ কথাও তিনি জানিয়ে দিলেন।
তবে পানিচুক্তির বিষয়ে ঘরোয়া আলোচনা হতে পারে বলে কূটনৈতিক সূত্রের খবর। তাতে অবশ্য মমতার আপত্তি নেই। বস্তুত তিনিই বাংলাদেশ সফরের সময়ে এই আলোচনার প্রক্রিয়াটি শুরু করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা যাওয়ার এক সপ্তাহ আগেই রবিবার যেভাবে এ বিষয়ে সমস্ত জল্পনা অবসান ঘটানো হল সেটি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। সুষমা এ কথাও জানিয়েছেন, তিনি নিশ্চিত বাংলাদেশ সফরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর পাশেই থাকবেন। স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ও তিনি হাজির থাকবেন।
প্রশ্ন হলো, ঢাকায় মমতা ব্যানার্জিকে সঙ্গে পেতে কীভাবে সফল হলেন মোদি? ইউপিএ জমানায় মনমোহন সিংহ যে কাজে ব্যর্থ হয়েছিলেন? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, মনমোহন সিংহ যখন প্রধানমন্ত্রী এবং প্রণব মুখার্জি তার প্রধান সেনাপতি ছিলেন, তখন মমতার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় তিস্তা চুক্তিটি অনুমোদন করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। তাতে পরিস্থিতি আরো বিগড়ে যায়। মমতার দলের দীনেশ ত্রিবেদী তখন রেলমন্ত্রী। ইউপিএ সরকার ভেবেছিল মমতা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। ফলে রাজ্য সরকারকে জানানোর প্রয়োজন নেই। দীনেশের উপস্থিতিতেই কেন্দ্র এটা পাশ করিয়ে নেবে। কিন্তু বৈঠকের আগেই দীনেশ ফ্যাক্স করে মমতাকে মন্ত্রিসভার তিস্তা চুক্তির খসড়াটি পাঠিয়ে দেন।
সে প্রস্তাবটি পড়েই মমতা নির্দেশ দেন তৃণমূল এই চুক্তির বিরোধিতা করবে। ফলে মন্ত্রিসভায় এটি পাশ করানো চলবে না। এমনকী এই চুক্তি জোর করে পাশ করাতে গেলে সরকার থেকে তৃণমূল সমর্থন প্রত্যাহার করবে, এ কথাও জানিয়ে দেন। ফলে মনমোহনকে পিছিয়ে আসতে হয়। দিল্লি এবং ঢাকা দুপক্ষই মমতার উপর রুষ্ট হয়।
কিন্তু মমতাও জানিয়ে দেন, ‘আমি মুখ্যমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ দেখাই আমার কাজ।’ এরপর মনমোহন তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননকে পাঠান তিস্তা চুক্তি নিয়ে মমতার সমর্থন আদায়ের জন্য। তাতে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি টি কে এ নায়ারকে কলকাতায় পাঠানো হয়। নায়ারের সঙ্গে মমতার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভাল ছিল। কিন্তু তিনিও বরফ গলাতে পারেননি।
পররাষ্ট্র সচিব রঞ্জন মাথাইও মমতার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। কিন্তু ফল হয়নি। আবার কূটনৈতিক সূত্রের খবর, বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মণি কলকাতায় মমতাকে তিস্তা চুক্তির প্রয়োজন বোঝাতে গিয়ে বাগবিতন্ডা করে বসেন। পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়ে।
সূত্রের খবর, বৈঠকে মমতার অনড় অবস্থান দেখে দীপু মণি রেগে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তিস্তার পানি শুধু আপনাদেরই পানি নয়, আমাদেরও পানি। দরকার হলে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যালে যাব!’ বাংলাদেশের কূটনৈতিক সূত্রের খবর, দীপুর এই আচরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অসন্তুষ্ট হন। পরের দফায় মন্ত্রিসভায় আর রাখাই হয়নি দীপু মণিকে। রাজনৈতিক পর্যায়ে ঘরোয়াভাবে মমতার সঙ্গে বোঝাপড়া করায় যে আখেরে লাভ হতে পারে, সেটি নরেন্দ্র মোদি প্রথম থেকেই বুঝে যান। যেমন ইউপিএ জমানায় তিস্তা না-হলেও জমি বিল নিয়ে তৎকালীন গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ যে মমতার সমর্থন আদায় করে নিয়েছিলেন, সেটিও একেবারেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে। তিনি মমতার সঙ্গে দেখা করতে কলকাতায় চলে যান। মমতা ব্যস্ত থাকায় একটি টিভি চ্যানেলের দপ্তরে গিয়ে তিনি তার সঙ্গে দেখা করেন।
নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর পাকিস্তান ছাড়া কার্যত সবক’টি প্রতিবেশী দেশই সফর করেছেন। কিন্তু এতদিন বাংলাদেশে যাননি। কূটনৈতিক সূত্রে খবর, নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে যাওয়ার প্রস্তুতির কাজে অনেকটা সময় দিয়েছেন নিঃশব্দে ও গোপনে। জানুয়ারি মাসে সার্ক সম্মেলন হওয়ার কথা পাকিস্তানে। সেখানে নরেন্দ্র মোদির যাওয়ার কথা। তার আগে তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে সীমান্ত নিয়ে মনোমালিন্য কাটিয়ে ফেলতে চান।
কিন্তু এ ব্যাপারেও তিনি এগিয়েছেন ধীরে ধীরে ও ধাপে ধাপে। প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ের এক কর্তা বলেন, নরেন্দ্র মোদির একটি নিজস্ব ক্যালেন্ডার আছে, যা মেনেই তিনি এগোচ্ছেন। রাষ্ট্রপতি ভবনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সম্মানে ডাকা নৈশভোজে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিও মমতাকে বোঝাতে উদ্যোগী হন। এই নৈশভোজেই মমতার সঙ্গে মোদির প্রথম মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়। মমতাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির একেবারে সামনে বসার ব্যবস্থা করা হয়। মমতার পাশে ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির ছেলে। উল্টো দিকে বসেছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি তাকে ঢাকায় আসতে অনুরোধ করেন। এরপর মমতা ঢাকা সফরেও যান। শেখ হাসিনার সঙ্গে তার কথা হয়। স্থালসীমান্ত চুক্তিতে তিনি কেন্দ্রকে সমর্থন করেন। ওই নৈশভোজে কিন্তু মমতা ছাড়া তরুণ গগৈ বা মানিক সরকারের মতো অন্য কোনো মুখ্যমন্ত্রীকে ডাকা হয়নি।
মনমোহনের সফর থেকে শিক্ষা নিয়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে মোদিও আগাগোড়া সতর্ক পদক্ষেপ করেন। তার সচিবালয় ও মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ের মধ্যে সরাসরি হটলাইন যোগাযোগ তৈরি করেন। প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারের অফিসার ভাস্কর খুলবে এই যোগসূত্র রক্ষার জন্যই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঢাকা যাচ্ছেন। মমতার একান্ত সচিব গৌতম স্যান্যালের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছেন তিনি। আবার পররাষ্ট্র সচিব জয়শঙ্কর নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন রাজ্যের মুখ্যসচিবের সঙ্গে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ নিজে মমতাকে ফোন করে জানিয়েছেন, কী কী কর্মসূচি ঢাকায় নেওয়া হচ্ছে। এমনকী যে যৌথ বিবৃতি নেওয়া হবে, তা-ও মমতাকে আগাম জানিয়েই করা হচ্ছে।
তবে ভারতের কাছে বাংলাদেশের ভৌগোলিক-রাজনৈতিক গুরুত্ব যে অসীম, এ ব্যাপারে মোদি ও মমতা একমত। স্থলসীমান্ত চুক্তি কার্যকর হলে সেটি যে অনুপ্রবেশ দমনেও সাহায্য করবে, সে ব্যাপারেও কেন্দ্র ও রাজ্য সহমাত। কলকাতায় এসে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব হিলারি ক্লিন্টন পর্যন্ত মমতাকে বলেছিলেন— দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বাংলাদেশকে পাশে রাখা বিশেষ প্রয়োজন।
বিশেষত সন্ত্রাস দমন ও ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকারের সদর্থক ভূমিকার কথা মমতা নিজেও স্বীকার করেন। স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের সময় মমতা মোদির পাশে থাকায় বাংলাদেশ আরো আশাবাদী। বাংলাদেশ মনে করছে, মমতা যখন আসতে পারছেন, তখন তিস্তা চুক্তি নিয়ে জট কাটাতেও প্রধানমন্ত্রী মমতাকে পাশে পাবেন। যে কাজটি মনমোহন সিংহ করে উঠতে পারেননি।-আনন্দবাজার