ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বাংলাদেশ সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তীব্র সমালোচনা করলেন আওয়ামী লীগের অত্যন্ত কাছের ও আস্থাভাজন ভারতীয় কংগ্রেস দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট রাহুল গান্ধী। তাদের সখ্য (ফ্রেন্ডশিপ) নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
রাহুল বলেন, ইউপিএ সরকার যখন ভারতের ক্ষমতায় ছিল তখন মমতার নীতি ছিল ‘একলা চল রে’। কিন্তু তিনি এখন গাঁটছড়া বেঁধেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে।
রাহুল গান্ধী বলেন, যখন আমাদের (ইউপিএ) সরকার ক্ষমতায় ছিল, আমাদের প্রধানমন্ত্রীও বাংলাদেশ সফরে গিয়েছিলেন। আমরা এ নিয়ে মমতার সঙ্গে কথা বলেছি। তাকে আমাদের সঙ্গে যেতে অনুরোধ করেছি। তিনি বলেছিলেন- না। ‘একলা চলো রে’। এখন মোদিজি বাংলাদেশে। কিন্তু এখন আর ‘একলা চলো রে’ নেই। এমনটা কেন ঘটছে? কিসের বিনিময়ে এই সখ্য?
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে এমন কটাক্ষ বিরল হিসেবে অভিহিত করেছে আনন্দবাজার পত্রিকা। রাহুল গান্ধী গতকাল নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে দলীয় কর্মিসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে এমন আক্রমণ শানান
। মমতার উদ্দেশে আক্রমণ এখানেই থেমে থাকেনি। রাহুল গান্ধী সেখানে আধ ঘণ্টার ভাষণ দেন। তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরও সমালোচনা করে বলেন, বাম আমলে বাংলার উন্নয়ন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আশা ছিল তৃণমূলের আমলে উন্নয়নের গাড়ি তরতরিয়ে চলবে। কিন্তু সেই উন্নয়নের গাড়ি ‘ঘাস ফুলের’ সরকার আরও জোরে স্তব্ধ করে দিয়েছে। গাড়িতে সওয়ার হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দু’পায়ে ব্রেক চেপে বসে আছেন। প্রতিশ্রুতি পূরণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ এই রাজ্য সরকার।
তিনি আরও জানিয়েছেন, বাংলার উন্নয়নের গাড়ি এগিয়ে নিয়ে যাবে কংগ্রেস নেতাকর্মীরা। দেশের মধ্যে আবারও এক নম্বর আসনটি দখল করবে বাংলা। কিন্তু তাদের কাজটি খুবই কঠিন, কারণ এখানে প্রতিনিয়ত তাদের মার খেতে হচ্ছে।
উল্লেখ্য, আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। সেই নির্বাচনকে সামনে রেখে আঁটঘাট মেরে মাঠে নামার ইঙ্গিত দিলেন রাহুল গান্ধী।
ওদিকে, বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এবারের বাংলাদেশ সফরে তিস্তা চুক্তি না হওয়ার এটাও একটি কারণ। তিনি তিস্তা ইস্যুতে রাজ্যের ভোট মাটি করতে চান না। রাহুল গান্ধী বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গকে তিনি বামদের আমলের দুর্দশা থেকে মুক্ত করবেন। কিন্তু মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর সেই হয়রানি দ্বিগুণ হয়েছে।
উল্লেখ্য, এই পশ্চিমবঙ্গেই ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেসের দোস্তি হয়েছিল। তারা একসঙ্গে নির্বাচন করেছিল। এর মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বামদের ৩৫ বছরের শাসনের ইতি ঘটে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দিকে সমালোচনার তীর ছুড়ে রাহুল গান্ধী বলেন, মোদি সরকার তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করে নি। এদিনও মোদিকে ‘সুট-বুট কি সরকার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
বলেন, তার সরকার ধনিক শ্রেণীর পক্ষের, গরিব বিরোধী ও কৃষক বিরোধী। এদিন জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত বিলের সমালোচনা করেন রাহুল। তিনি বলেন, এক বছরের বেশি নতুন সরকার দিল্লিতে। মমতাজি যেমনটা করেছিলেন তেমনই প্রচুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেই সরকার। তারা কর্মসংস্থান, উন্নয়ন, কারখানা খুলে দেয়ার কথা বলেছে। মোদি ও মমতা দু’জনেই এসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। দু’জনই এক বছর পার করলেন। মোদি ‘স্বচ্ছতা’ নিয়ে কথা বলেছেন। তা শেষ হয়ে গেছে। এখন তিনি রাজপথে যোগব্যায়ামের আহ্বান জানাচ্ছেন। তার মুখে কর্মসংস্থানের কোন কথাই নেই। প্রতিদিনই তিনি নতুন নতুন কথা বলছেন। তিনি প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন। তা ঢাকতেই এসব কথা বলছেন তিনি। মোদি বলেছেন, আমরা এখন যোগব্যায়াম করছি। তোমরা পরে কথা বলো।
রাহুল গান্ধী তার আক্রমণের তীর ছুড়েছেন পশ্চিমবঙ্গের বাম দলগুলোর প্রতিও। আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছে, কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদি সরকারের এক বছর পূর্তিতে সরকারের ব্যর্থতার বিভিন্ন দিক সাধারণের সামনে তুলে ধরতে বিভিন্ন রাজ্যে সফর শুরু করেছেন রাহুল গান্ধী।
উত্তর প্রদেশ, কেরালা, মধ্যপ্রদেশ সফরের পর শনিবার তিনি যান পশ্চিমবঙ্গে। সেখানে গিয়েই তিনি তোপ দাগলেন রাজ্যের বর্তমান এবং প্রাক্তন দুই শাসকের বিরুদ্ধেই। এদিন সকালে রিষড়ার ওয়েলিংটন জুটমিলে চটকল শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেন রাহুল। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের বন্ধ এবং ধুঁকতে থাকা চটকলের বেশকিছু শ্রমিক তার সামনে তাদের অভাব-অভিযোগ তুলে ধরেন। রাজ্যে চটকল শিল্পের বেহাল পরিস্থিতির জন্য তৃণমূল এবং পূর্বতন বাম সরকারের নীতির সমালোচনা করেন তিনি। রাহুলের দাবি, বামেরা রাজ্যে উন্নয়নের চাকা থামিয়ে দিয়েছিল। রাজ্যকে উন্নয়নের পথে ফেরাতে মানুষ তৃণমূলকে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার উন্নয়নের ব্রেক কষে দিয়েছে। প্রতিশ্রুতি রাখতে ব্যর্থ হয়েছে তারা।
মোদি সরকারের বিরুদ্ধেও এদিন মুখ খোলেন রাহুল। বলেন, এক বছরের মধ্যেই সরকারের উন্নতির বেলুন চুপসে গিয়েছে। পুরোপুরি ব্যর্থ কেন্দ্রের বর্তমান সরকার। শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে সংসদে কথা বলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাহুল জানান, যত দ্রুত সম্ভব চটকলগুলোর স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে সরকারকে অনুরোধ করবেন তিনি। বেশ কিছুদিন অজ্ঞাতবাসে থাকার পর ফিরে এসে বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন রাহুল।
সম্প্রতি কেন্দ্রের জমি অধিগ্রহণ বিলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজ্যে গিয়ে কৃষকদের সঙ্গে কথাও বলেছেন। এই অবস্থায় এ রাজ্যে এসে কৃষকদের কোন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কেন তিনি কথা বললেন না, উঠছে সেই প্রশ্ন। শ্রমিকদের সঙ্গে বৈঠকের পর রিষড়ার থেকে কলকাতার উদ্দেশে রওনা হয়ে যান রাহুল। গতকাল সন্ধ্যায় দিল্লি ফিরে যাওয়ার কথা তার।