ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ গতকাল বৃটেনের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ইকোনমিস্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশ সফর নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষন করা হয়েছে।
‘বাংলাদেশ অ্যান্ড ইন্ডিয়া: টাইডিং আপ দেয়ার বর্ডার শ্যুড বি অনলি দ্য ফার্স্ট অর্ডার অব বিজনেস’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের এটি ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের ওপর ভর করে টিকে আছে শেখ হাসিনার শাসনের বৈধতা। ওই নির্বাচনের সময় বিরোধী দলীয় অনেক নেতা ছিলেন কারারুদ্ধ। অনেক আসনে ভোটই হয় নি। ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী।
রাজধানী ঢাকায় এমন একটি ধারণা দেখা যাচ্ছে যে, সেই সুবর্ণ জয়ন্তী পালন নিশ্চিত করতে যা যা করণীয় শেখ হাসিনা তা করবেন। ওই অনুষ্ঠানে সঠিক মানুষকে সভাপতি দেখতে চান তিনি। সঠিক মানুষ বলতে তাদেরকে বোঝানো হচ্ছে যারা তার পিতা ও বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধা করেন।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সীমান্ত চুক্তি বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দু’দেশের মধ্যকার বিবদমান সীমান্ত চুক্তি সম্পন্ন করেছেন। এই ফাঁকে নরেন্দ্র মোদি সাক্ষাত করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে।
ওই সাক্ষাতে মোদিকে খালেদা জিয়া হয়তো বলে থাকতে পারেন যে: বাংলাদেশে প্রয়োজন সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, যেখানে নির্বাচনের অখ-তা নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের থাকবে আস্থা। এদিকে বিশাল মাপের কোন নেতা বাংলাদেশ সফর করছেন এমনটা বিরল। সুতরাং যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বহনকারী বিমান এ সপ্তাহে মাটি স্পর্শ করল তাকে স্বাগত জানাতে টারমার্কে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে গেলেন মন্ত্রীপরিষদের সদস্যরা। তাদের নেতৃত্বে শেখ হাসিনা, যিনি দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে দীর্ঘ সময় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শাসনের পথে রয়েছেন, তিনিও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশের নেতার কাছ থেকে তিনি অনুমোদন পাওয়ার জন্য উদগ্রীব ছিলেন এবং তার কাছ থেকে সহায়তা নিয়ে অন্যভাবে ইতিহাস গড়তে চেয়েছেন। নরেন্দ্র মোদি হংকং দ্বীপের অর্ধেকের সমান ৪০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ভূখন্ড উপহার নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে। এ ভূখন্ড দু’দেশের অভিন্ন সীমান্তে। ৪১ বছর পরে ভারত ২০০ ছিটমহল নিয়ে বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে সম্মত হয়। এসব ছিটমহল দু’দেশের অনিষ্পন্ন সীমান্তে অবস্থিত। এই সীমারেখা ছিটমহলের প্রহেলিকায়। দু’অংশেই রয়েছে ছিটমহল। এসব অনুন্নত স্থানে বসবাস করেন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ।
অবশেষে তাদেরকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে ভারত ও বাংলাদেশ। এই যে ছিটমহল বিনিময় এটা দীর্ঘদিন অনিষ্পন্ন ছিল। নরেন্দ্র মোদির পূর্বসূরি মনমোহন সিং এ কাজটি করার জন্য ২০১১ সালে রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে আসেন। কিন্তু মাত্র গত মাসে ভারতের পার্লামেন্ট অনুমোদন দেয় ১৯৭৪ সালের সীমান্ত চুক্তি।
এখনও চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের রয়েছে বিরোধপূর্ণ সীমান্ত। নেপালের সঙ্গে রয়েছে ক্ষুদ্র অংশ। তবে এখন বাংলাদেশের সঙ্গে আর কোন বিরোধপূর্ণ সীমান্ত রইল না। নরেন্দ্র মোদির এ সপ্তাহের সফরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল বাংলাদেশের বিরোধী দলকে আস্থায় আনা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিপক্ষ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি কার্যকরভাবে তাদের রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহার করেছে। এ বছরের শুরুতে তারা নতুন নির্বাচন দেয়ার দাবিতে ভয়ংকর আন্দোলন করে। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয় তারা। তখন থেকেই তারা দিকশূন্য। হাসিনার কঠোর হাতের চাল এতে ভূমিকা রেখেছে। বিএনপির বেশির ভাগ নেতা হয়তো নির্বাসনে না হয় জেলে। খালেদার মতো যারা জেলে বা নির্বাসনে নেই তাদের বিরুদ্ধে আদালতে রয়েছে নানা অভিযোগ। এ দলটির প্রধান নির্বাচনী মিত্র জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বেশির ভাগই যাবজ্জীবন কারাদ- অথবা ফাঁসিতে মৃত্যুদন্ডের অপেক্ষায়।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে অপরাধের কারণে তাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা। এখনও জামায়াত নরেন্দ্র মোদির সফরকে স্বাগত জানায় নি। ২০০৬ সালে ক্ষমতা হারানোর পর বিএনপিতে কোন আইডিয়া নেই। নেতাকর্মীরা সক্রিয় নন। বিএনপিকে কখনো দুর্বল দেখা যায় নি। নরেন্দ্র মোদির সফর এটা জোরালো করেছে যে, তার রাষ্ট্র প্রধানোচিত নেতৃত্ব প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আর কোন আমলার হাতে বা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর হাতে থাকবে না। বাংলাদেশকে তারা যেভাবে দেখেছেন তা হলো ভারতের নিরাপত্তার ঝুঁকির বেশি কিছু নয়।
বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে যখন স্বাধীনতা অর্জন করে তখন থেকেই সদিচ্ছা বিনিময়ের চেয়ে ভূখন্ড ও সন্ত্রাসের বিষয়ে লড়াই করে আসছে। মেগা প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কে প্রাধান্য পেয়েছে এটাই। মোদির সফরে অনেক দলিল স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। তিনি বাংলাদেশকে বিপুল অংকের ঋণ অনুমোদন করেছেন।
এ জন্য মোদি তার প্রতিনিধি দলে এনেছিলেন মোদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আছে যে রিলায়েন্স ও আদানি গ্রুপ তাদের দুজনকে। তারা বাংলাদেশের বিদ্যুত খাতে ৫৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করার কথা বলেছেন। তিস্তার পানি বন্টন হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
কিন্তু এই মিশনে এ সমস্যার সমাধান কন্টকিত প্রমাণিত হয়েছে। দু’পক্ষের রাজনীতি ও মিডিয়া এসব উদ্যোগকে নতুন যুগের সূচনা বলে আখ্যায়িত করেছেন। প্রশ্ন হলো বাস্তব সত্য কি এক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করবে কিনা। বাংলাদেশে এখনও ভারত বিরোধিতা প্রবল। এ অঞ্চলে ভারতীয় শক্তির আধিপত্যের যে অভিলাষ তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ রয়েছে। একদা স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্মের সময় সহায়তা করেছিল ভারত। তারপর থেকেই ভারতকে দেখা হয়েছে সৎমায়ের মতো।
বাংলাদেশে চীনের যে ক্রমবর্ধমান প্রভাব তাতে বাংলাদেশ বিষয়ে মন আকৃষ্ট হয়েছে ভারতের। ফলে তারা ভাল কিছু করার প্রতিযোগিতা করেছে। আমদানি, অস্ত্র ও বিনিয়োগের দিক থেকে এরই মধ্যে চীন হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উৎস। ইত্যবসরে দৃশ্যত আমেরিকা বাংলাদেশী নীতি পৌঁছে দিয়েছে ভারতের কাছে। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৫ সালের প্রথম ৫ মাসে ভারতের সীমান্ত রক্ষীদের হাতে নিহত হয়েছেন ২০ বাংলাদেশী। যদি নরেন্দ্র মোদি এ ধারা খতম করার কথা বলতেন তাহলে তা হতো মহৎ কাজ।