ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ মুখে মুখে আগাম নির্বাচনের কথা নাকচ করে দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও মন্ত্রীরা মাঠে ময়দানে কড়া বক্তব্য দিলেও ভেতরে ভেতরে অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকার একটি আগাম নির্বাচনের অঙ্ক কষছে বলে জানা গেছে।
সরকারের একাধিক সূত্র জানায়, আগামী বছরের শেষের দিকে অথবা ২০১৭ সালের শুরুতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেওয়ার লক্ষ্য সামনে রেখে এ রাজনৈতিক অঙ্ক কষা হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে ছোট ছোট কিছু রাজনৈতিক দলকে দিয়ে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি তোলানোর চিন্তা রয়েছে। এ লক্ষ্যে ইতিমধ্যে কিছু যোগাযোগও শুরু হয়েছে।
বিএনপির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, তাঁরাও আগামী দেড় বছরের মধ্যে একটা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাবনা দেখছেন। তার আগে বিএনপিতে ভাঙন ধরানোসহ বড় ধরনের ঝড়ের আশঙ্কাও করছেন। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির নেতাদের ফোনালাপ ফাঁস, দল ভাঙার তৎপরতা নতুন করে জোরদার এবং বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বিভিন্ন মামলার দ্রুতগতি সে ঝড়েরই আলামত হিসেবে দেখছেন বিএনপির নেতারা। বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা ও দলটির কয়েকজন চিন্তকের সাম্প্রতিক এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনেও এসব কথা এসেছে।
এ মূল্যায়ন প্রতিবেদনটি ইতিমধ্যে দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে দেওয়া হয়েছে। সরকারের একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, গত বছরের ৫ জানুয়ারির একতরফা ও বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকার দেশে-বিদেশে ব্যপক সমালোচনার মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে ১৫৪ আসনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় এ সরকার নৈতিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল অবস্থার মধ্যে আছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য মধ্যবর্তী নির্বাচনের চিন্তা করা হচ্ছে। এতে বিএনপির একাংশসহ অন্য দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে প্রভাবশালী একটি সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, মধ্যবর্তী নির্বাচনের জন্য আগামী বছরের শেষের দিককে সুবিধাজনক সময় মনে করা হচ্ছে। কারণ, তাঁরা আশা করছেন, চলতি বছরের মধ্যে অন্তত দুটি মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সাজা হয়ে যাবে। তাঁরা নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য হয়ে পড়লে বিএনপি আরও চাপে পড়বে। ওই অবস্থায় বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি হবেন না। তখন দলটির একটি অংশকে নির্বাচনে আনা সহজ হবে। সেই লক্ষ্যে ইতিমধ্যে কিছু তৎপরতা শুরু হয়েছে। তবে এ চিন্তা ও পরিকল্পনার কথা কৌশলগত কারণে এখনই প্রকাশ করতে রাজি নন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা।
যদিও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, মধ্যবর্তী বা আগাম জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে তাঁদের সরকার বা দলের কোনো ভাবনা নেই। এ বিষয়ে দলে ও সরকারের কোনো ফোরামে আলোচনা হয়নি।
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন, তাঁরা মধ্যবর্তী নির্বাচনের সম্ভাবনা দেখছেন। তিনি এ-ও বলেন, ‘এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে সরকার আরও কিছু সময় কাটাতে চাইবে। কিন্তু আমরা মনে করি, সরকার মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে।’
বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, সরকার আগামী বছরের শেষ দিকে বা ২০১৭ সালের শুরুর দিকে নির্বাচন দেওয়ার চিন্তা করছে বলে তাঁরা খবর পাচ্ছেন। তার আগে সরকার বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সাজা দিয়ে তাঁদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা এবং দলকে ভাঙার চেষ্টা করবে। বিএনপির চেয়ারপারসনের কাছে পাঠানো মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এমন আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে।
বিএনপির মূল্যায়নে বলা হয়, আগাম নির্বাচন দেওয়ার আগে সরকার বিএনপিকে চারটি ভাগে বিভক্ত করার চেষ্টা করবে।
এক. যাঁরা মামলার কারণে নির্বাচনে অযোগ্য হবেন, তাঁদের অনেকেই হয়তো চাইবেন না বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিক।
দুই. অন্যরা চাইবেন নির্বাচনে অংশ নিতে।
তিন. আরেকটি উপদল করার চেষ্টা চলবে, যাঁরা চাইবেন জোট থেকে জামায়াতকে বাদ দেওয়া হোক।
চার. বিএনপিতে সংস্কারপন্থী হিসেবে যাঁদের মূলধারা থেকে দূরে রাখা হয়েছে, তাঁদের নিয়ে আরেকটি উপদল করা হতে পারে। এঁদের সঙ্গে আবার এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও নাজমুল হুদার সংযোগ ঘটানোর চেষ্টা হবে।
বিএনপির এই মূল্যায়নের সঙ্গে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল একটি বড় দলের মহাসচিবের বক্তব্যের বেশ মিল পাওয়া যায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মধ্যবর্তী নির্বাচনের সম্ভাবনা সম্পর্কে আলাপকালে জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘বিএনপিকে ভাঙার আগে মধ্যবর্তী নির্বাচনের কোনো সুযোগ দেখি না।’
এ বিষয়ে বিএনপি-সমর্থিত নাগরিক সংগঠন শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বিরোধী দলের প্রধান নেতাদের জেলে পাঠিয়ে, তারপর ফাঁকা মাঠে নির্বাচনের কথা যদি কেউ চিন্তা করে, তবে তা ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের মতোই গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।
তিনি বলেন, অগ্রহণযোগ্য নীতি নিয়ে কেউ টেকেনি। কাউকে ফাঁসিয়ে নির্বাচন করার প্রক্রিয়া শুভ হবে না। বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের আগেও বিএনপিকে ভেঙে দলটির একাংশকে নির্বাচনে আনার নানা চেষ্টা করেছিল সরকার। কিন্তু তাদের সে চেষ্টা সফল হয়নি। তবে এখন সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় তাঁরা আঁচ করতে পারছেন যে দল ভাঙার পুরোনো তৎপরতা আবার শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় দলছুট বা সংস্কারপন্থীদের নিয়ে সরকার যাতে নতুন করে কিছু করতে না পারে, সে জন্য তাঁদের দলে ফেরানোর চিন্তা করছে বিএনপি। এ ক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা রাখছেন—এমন একজন নেতার দাবি, সংস্কারপন্থীরাও দলে ফিরতে আগ্রহী।
এ ব্যাপারে দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার মনোভাবও ইতিবাচক। কারণ, দলে ফিরতে ইতিমধ্যে একাধিক নেতা অতীতে ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে লিখিত আবেদনও করেছেন। কিন্তু সংস্কারপন্থী নেতাদের নির্বাচনী এলাকার স্থানীয় নেতাদের বাধার কারণে তাঁদের দলে ফেরার কার্যক্রম এগোয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহান বলেন, ‘সরকারবিরোধী আন্দোলনে আমরা জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছি। আদর্শিক বিরোধ থাকার পরও অনেকের সঙ্গে জোট করেছি। ভুলভ্রান্তির কারণে যাঁরা দল থেকে বিচ্যুত, এখন তাঁদের ফেরানোর বিষয়টি দলের ভাবা উচিত, যদি তাঁরা ভুলের জন্য অনুতপ্ত হন।’
সংশ্লিষ্ট অপর একটি সূত্র বলছে, সরকারের ছক অনুযায়ী বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ার পর জামায়াতে ইসলামীসহ ২০-দলীয় জোটের অন্য শরিকদেরও পরবর্তী নির্বাচনে নিতে সরকারের চেষ্টা থাকবে। এরই মধ্যে এই জোটের শরিক ছোট ছোট একাধিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে প্রভাবশালী একটি সংস্থার কর্মকর্তারা আলাদাভাবে বৈঠক করেছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া কয়েক মাস আগে বিএনপির সাবেক দুই সাংসদ আবু হেনা ও শহীদুল হক জামালকে দিয়ে বিএনপিকে ভেঙে ‘নতুন বিএনপি’ গড়ার লক্ষ্যে কিছু তৎপরতা শুরু হয়। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে সেটা এখনো অব্যাহত আছে বলে জানা গেছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, চতুরতার মাধ্যমে মধ্যবর্তী একটা নির্বাচন দিলে তাতে বিদ্যমান সমস্যা কাটিয়ে ওঠা যাবে না। দল ভাঙা, দমন-পীড়ন বা কর্তৃত্ববাদিতা কোনো সমাধান নয়। দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে। সবার অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সম্মতি নিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের শান্তিপূর্ণ পথ বের করতে হবে।