ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ফেলানি খাতুন হত্যা মামলার পুনর্বিচারেও বিএসএফ যে অভিযুক্ত জওয়ান অমিয় ঘোষকে সাজা দিতে পারল না, তার প্রধান কারণ, এতে বাহিনীর ভেতর সাঙ্ঘাতিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে বলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা টের পেয়েছিলেন। ফলে বিজিবি তথা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে বিষয়টা ভালো ইঙ্গিত দেবে না জেনেও বিএসএফ ফেলানির হত্যাকারীকে নির্দোষ ঘোষণা করতে এক রকম বাধ্য হয়েছে বলে বিএসএফ সূত্রে জানা যায়।বরাবরের মতো ভারত এবারও তার নিজ স্বার্থকেই প্রধান্য দিলো বলা যায়।
ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর ডিআইজি পদমর্যাদার একজন অফিসার বলেন, ‘দেখুন ফেলানির হত্যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক, কোনও সন্দেহ নেই। বিশেষ করে তার দেহ যেভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাঁটাতারের ওপর ঝুলছিল, তা তো চরম অমানবিক। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, অভিযুক্ত জওয়ান কর্তব্যরত অবস্থায় এমন একজনকে গুলি করেছেন, যিনি অবৈধভাবে সীমান্ত পেরোচ্ছিলেন। জানুয়ারিতে শীতকালের সকালে কুয়াশায় ভালোভাবে সবকিছু দেখাও যাচ্ছিল না। এমত অবস্থায় তাকে হত্যার জন্য দোষী সাব্যস্ত করাটা কিন্তু কঠিন!’
ঠিক এই কারণেই বিএসএফের নিজস্ব ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা বৃহস্পতিবার রাতে বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে আলোচনার পরও অমিয় ঘোষকে দোষী ঘোষণা করতে পারেননি। অভিযুক্ত জওয়ান নিজের সওয়ালে বারবার একটা কথাই বলেছেন, ঘটনার সময় তিনি বিএসএফের উর্দিতে ছিলেন এবং অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপারকারীদের তিনি না কি হুঁশিয়ারিও দিয়েছিলেন।
তার পরও তারা তাতে কর্ণপাত করেনি বলেই তিনি গুলি চালাতে বাধ্য হন, কিন্তু সেটা যে একজন কিশোরীর গায়ে লাগবে, তা তিনি বুঝতে পারেননি। অমিয় ঘোষের এই ডিফেন্স-ই কিন্তু বিএসএফকে বিপাকে ফেলে দিয়েছে। বাহিনীর যে হাজার-হাজার নিচু তলার জওয়ান সারা বছর সীমান্ত পাহারার দায়িত্বে থাকেন, তারা কিন্তু এই প্রশ্নে পুরোপুরি তাদের সহকর্মীর পাশেই দাঁড়িয়েছেন।
তারা তাদের কমান্ডারদের মারফত বিএসএফ কর্তৃপক্ষকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, একদিকে তাদের সীমান্তে অবৈধ পারাপার ও চোরাকারবার রুখতে কঠোর হতে বলা হবে, আবার অন্যদিকে কর্তব্যরত অবস্থায় গুলি চালালেও তার জন্য কোর্ট মার্শালের সম্মুখীন হতে হবে, এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
বাহিনীর ভেতর এই অসন্তোষের আঁচ পৌঁছেছিল দিল্লিতে বিএসএফের সদর দফতরেও। যে কারণে ২০১৩-র সেপ্টেম্বরে এই মামলার পুনর্বিচারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যিনি, বাহিনীর সেই তৎকালীন মহাপরিচালক সুভাষ জোশী তার কার্যকালের দেড় বছরে সেই পুনর্বিচারের প্রক্রিয়া শুরুই করতে পারেননি।
তারপরে যিনি মহাপরিচালকের দায়িত্ব নেন, সেই দেবেন্দ্র কুমার পাঠক গত বছর দিল্লিতে বিজিবি প্রধান মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদকে কথা দেন, পুনর্বিচারের কাজ শিগগিরই শুরু করা হবে। তিনি সেই কথা রাখলেও অভিযুক্ত জওয়ান অমিয় ঘোষের অসুস্থতার জন্য সেই প্রক্রিয়া আবারও পিছিয়ে যায়, শেষ পর্যন্ত ফেলানি হত্যার ঠিক সাড়ে চার বছরের মাথায় এসে এ সপ্তাহে বিএসএফের সেই পুনর্বিচার শেষ হয়।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাতে রায়ের কোনও হেরফের হয়নি। কারণ, পুনর্বিচারেও অভিযুক্ত জওয়ান বেকসুর খালাস পেয়েছেন। এই বিচার ও পুনর্বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে আগাগোড়া ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন, এমন একজন বিএসএফ কর্মকর্তা এদিন দিল্লিতে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা অভিযোগের প্রতিটি ধারা ধরে-ধরে খতিয়ে দেখেছেন, অভিযুক্ত জওয়ানকে হত্যাকারী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করা যায় কি না। কিন্তু মুশকিল হলো, কর্তব্যরত অবস্থায় এবং যে পরিস্থিতিতে তিনি গুলি চালিয়েছেন, সেটাকে কিছুতেই হত্যা বলে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। আর সে কারণেই তাঁকে বেকসুর খালাস ঘোষণা করতে তারা বাধ্য হয়েছেন।’
যে কথাটা তিনি সরাসরি বলেননি, কিন্তু প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়েছেন, তা হলো এই রায়ে বিএসএফের নিচু তলার জওয়ানরা ভীষণ খুশি। আর তাতে বিএসএফ কর্তৃপক্ষও এক রকম হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। রায়ে অমিয় ঘোষ দোষী সাব্যস্ত হলে বাহিনীর মধ্যে যে তোলপাড় পড়ে যেত, সেটা তাদের স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। এমনকী, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সীমান্তে চোরাচালান ও পাচাররোধের কাজেও অবধারিতভাবে ঢিলে পড়ত বলে তাদের আশঙ্কা। কিন্তু এখন বাংলাদেশের কাছে তারা কীভাবে মুখ দেখাবেন? বিজিবি-র কর্মকর্তাদেরই বা কী বলবেন? এর জবাবে বিএসএফের উচ্চপদস্থ সূত্রগুলো বলছে, সীমান্ত রক্ষার কাজে নিয়োজিত একটি আধাসামরিক বাহিনীর যে নিজস্ব কিছু বাধ্যবাধকতা ও শৃঙ্খলা রক্ষার দায় থেকে যায়, এটা বিজিবি কর্মকর্তারা আশা করি বুঝবেন।
তবে হ্যাঁ, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ নিশ্চয় এই রায়ে খুশি হবেন না, কিন্তু সেখানে আর বিএসএফ কীইবা করতে পারে? এই পুনর্বিচারের রায় গ্রহণ করার চূড়ান্ত ভার বিএসএফের ডিজি-র ওপরেই। বাহিনীর মহাপরিচালক ডি কে পাঠক এই রায় খারিজ করে দেবেন সেই সম্ভাবনা অবশ্য নেই বললেই চলে।
তবে তিনি অভিযুক্ত জওয়ানের জন্য কোনও মৃদু তিরস্কার যোগ করলেও করতে পারেন। কিন্তু বিচারপ্রার্থী ফেলানি খাতুনের পরিবারের কী হবে?
আভাস পেয়েছে, বিএসএফ কর্তৃপক্ষ তাদের মোটা অঙ্কের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে প্রস্তুত। অথবা তাদের পরিবারের প্রয়োজন জন্য অন্য কোনওভাবে মেটানোর প্রস্তাব দিতেও তারা রাজি। ফেলানির জীবন তাতে ফিরবে না ঠিকই, কিন্তু দরিদ্র ওই পরিবারটির তাতে রুটিরুজির সংস্থান হবে বলেই বিএসএফের ধারণা। তবে ফেলানির পরিবার তাতে রাজি হবে কি না, সেটা অবশ্যই আলাদা প্রশ্ন!