বদরুদ্দীন উমরঃ বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির সব থেকে সংকটজনক দিক হলো-সব রকম অপরাধ, দুর্নীতি, দস্যুবৃত্তি, জালিয়াতি, মিথ্যা ও শোষণ-নির্যাতনের প্রতি জনগণের সহনশীলতা, যে সহনশীলতার মধ্যে নিষ্ক্রিয়তার জন্ম। আগেকার দিনে মানুষ এসব দেখলে অস্থির হতো। শুধু অস্থির হতো তাই নয়, এসবের বিরুদ্ধে সরব হতো ও প্রকাশ্যে বিরোধিতা করত। আন্দোলনে নামতো। এখন মানুষ অনেক সময়েই ঘরে বসে অথবা বন্ধু মহলে এ ধরনের অপরাধ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সমালোচনা করে; কিন্তু এ পর্যন্তই। এই ঘরোয়া প্রতিক্রিয়া ছাড়া তাদের আর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই! দেখে মনে হয়, কারও কোনো সামাজিক দায়বদ্ধতা নেই!
বাংলাদেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় ৫-৭ জন থেকে ৪০-৫০ জনের মৃত্যু হচ্ছে। পত্রপত্রিকায় এর রিপোর্ট ছাপা হচ্ছে। কোনো কোনো সময় পরিবহনমন্ত্রী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করছেন। কিন্তু দুর্ঘটনা পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে হাজার হাজার নিরীহ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। দুর্ঘটনার কারণগুলো সরকারিভাবে চিহ্নিত করে সেগুলো দূর করার পরিবর্তে পরিবহনমন্ত্রী কর্তৃক লোক দেখানোর জন্য দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন যে দুর্ঘটনা বন্ধ করতে বা কমিয়ে আনতে পারে না, এটা ঘন ঘন, প্রায় প্রতিদিনের সড়ক দুর্ঘটনার থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়। এর জন্য মাথা ঘামানোর প্রয়োজন হয় না।
সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে দুর্নীতি যে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত এ নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। শুধু তাই নয়, দুর্নীতি যতই বিস্তৃত ও বেপরোয়া হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব দুর্ঘটনায় ততই আরও বেশি বেশি লোকের মৃত্যু হচ্ছে। বাস মালিকদের সঙ্গে সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং সরকারি লোকেরাই অথবা বেসরকারি প্রভাবশালী লোকেরা বাস কোম্পানিগুলোর মালিক হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনো প্রশ্ন নেই।
দুর্ঘটনার জন্য বাস মালিকদের জেল তো দূরের কথা, জরিমানা অথবা সামান্য কোনো শাস্তির ব্যবস্থা পর্যন্ত নেই। এই অপরাধীদের প্রতি সরকারের একশ’ভাগ ‘টলারেন্সে’র কারণেই এই ভয়াবহ পরিস্থিতি পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু শুধু সরকারের টলারেন্সই নয় এই অবস্থার প্রতি জনগণের টলারেন্সও এর উল্লেখযোগ্য কারণ।
সরকার বাস মালিকদের অপরাধের থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখার কারণে তাদের কোনো জবাবদিহির ব্যাপার নেই। সরকারের এই অবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জনগণের মধ্যে সক্রিয় বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া এবং প্রতিরোধের অভাব। বস্তুতপক্ষে জনগণের এই প্রতিক্রিয়াহীনতাই এ ক্ষেত্রে সরকারের নিরাপদ নিষ্ক্রিয়তার কারণ।
জনগণ যদি দুর্নীতিবাজদের এই বেপরোয়া হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে এগিয়ে আসত, তাহলে দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেই পরিবহনমন্ত্রী তার দায়দায়িত্ব শেষ করতেন না। প্রধানমন্ত্রীও এ ক্ষেত্রে নিজের দায়িত্ব-কর্তব্যের বিষয়ে উদাসীন থেকে অবলোকনকারীর ভূমিকা পালন করতেন না। শুধু বাস দুর্ঘটনা নয়, লঞ্চ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও একই কথা। নৌ পরিবহনমন্ত্রী লঞ্চ দুর্ঘটনায় শত শত যাত্রীর মৃত্যুর বিষয়টিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিরাপদে গদির আনন্দ উপভোগ করতেন না।
বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশে এখন দুর্নীতি ও লুটপাট কত ব্যাপক ও বিচিত্রভাবে হচ্ছে, এটা আপাতদৃষ্টিতে এক বিস্ময়কর ব্যাপার। সরকারি ব্যাংকের টাকা যেভাবে লুট হচ্ছে সেটা ডাকাতদের অপরাধ থেকে শতগুণ বেশি। কারণ, সরকারি ব্যাংকের যে কর্মকর্তারা এই লুটপাটের কাজ করছে তাদের দায়িত্ব হচ্ছে ব্যাংকের আমানতের হেফাজত করা। সরকারি ব্যাংকগুলোর এই অবস্থা হলেও সরকারকে এই অপরাধ পরিস্থিতি মোকাবেলার ক্ষেত্রে উপযুক্ত কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। এ
কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে যে, স্বয়ং অর্থমন্ত্রী সোনালী ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা কর্মচারীদের দ্বারা লুটের উল্লেখ করে বলেন, সে পরিমাণ টাকা কিছুই নয়! সামান্য! সেই ব্যাংক লুট যারা করেছিল তাদের কোনো শাস্তি এখনও হয়নি। তারা যে শেষ পর্যন্ত লুটপাটের দায়মুক্ত হবে, এতে সন্দেহের কারণ নেই।
সম্প্রতি ব্রাজিল থেকে আনা গম খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক মহাদুর্নীতি ও কেলেঙ্কারির ব্যাপার। এর সঙ্গে খাদ্যমন্ত্রীর জড়িত থাকার বিষয়টি নিয়ে সংবাদপত্রেও অনেক লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপের লক্ষণই আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি। হাইকোর্ট থেকে এ ব্যাপারে সরকারকে নির্দেশ দেওয়ার পরও কিছু হয়নি। সরকার যে এ ধরনের কোনো নির্দেশের তোয়াক্কা করে না, এটা দেখাই গেছে।
সাধারণ লোক আদালতের নির্দেশ অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সরকার আদালতের নির্দেশ অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে আদালতের করার কিছুই নেই! এখন সর্বোচ্চ আদালত বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে ব্রাজিল থেকে আমদানি করা গম বিতরণ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু আমদানির এতদিন পর এই নির্দেশের কোনো কার্যকারিতাই নেই। কারণ ইতিমধ্যে সরকারের খাদ্য মন্ত্রণালয় প্রায় সব গমই বিতরণ করে দিয়েছে! এর মধ্যে সরকারি লোক, মন্ত্রী-আমলাদের যে দুর্নীতি এবং অপরাধের পরিচয় আছে, এটা অস্বীকার করবে কে?
এই দুর্নীতি যে সরকারের মন্ত্রণালয় থেকে করা হচ্ছে এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, মন্ত্রী-আমলাসহ সরকারি লোকজন জনস্বাস্থ্যের কোনো পরোয়া করে না। সরকার মাঝে মধ্যে ভেজাল ইত্যাদির বিরুদ্ধে লোকদেখানো কিছু তৎপরতা দেখালেও তারা নিজেরাই দেশের লোককে পচা গম খাওয়াচ্ছে! তাদের লোকেরা খাদ্য নিয়ে আরও অনেক ধরনের দুর্নীতি করছে। এর বিরুদ্ধে জনগণের কোনো প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধের দেখা নেই।
এই পরিস্থিতি যে সরকারি লোকজনকে তাদের ঘুষ-দুর্নীতি সত্ত্বেও নিরাপত্তা দেবে, তাদেরকে বেপরোয়া করবে, এটাই স্বাভাবিক। আগামী ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর ৪০ বছর উপলক্ষে আওয়ামী লীগ ৪০ দিনের শোক পালন এবং অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এসব অনুষ্ঠানের খরচ জোগানোর জন্য ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন মায়া কয়েকদিন আগে তাদের ধানমণ্ডি অফিসে এক দলীয় বৈঠকে বলেন চাঁদাবাজির প্রয়োজনের কথা। তার বক্তব্য অনুযায়ী এসব অনুষ্ঠানের বিপুল ব্যয় নির্বাহের জন্য প্রত্যেক বছরের মতো এ বছরও চাঁদাবাজি করতে হবে! বৈঠকে তাদের কয়েকজন দলীয় নেতা মায়ার এই দাবির সমালোচনা করে বলেন, ১৫ আগস্টের অনুষ্ঠান উপলক্ষে কোনো চাঁদাবাজি হতে দেওয়া যাবে না। পরে সরকারি উচ্চতর পর্যায় থেকেও বলা হয়েছে, এ ধরনের দুর্নীতি তারা সহ্য করবেন না। এ ক্ষেত্রে তাদের নীতি হচ্ছে ‘জিরো টলারেন্স’!
কিন্তু যেভাবে দেশে লুটপাট ও চাঁদাবাজি সরকারি লোকদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে, তাতে মায়ার মতো দুর্নীতিবাজদের চাঁদাবাজি তৎপরতা এখন বন্ধ হবে, এটা মনে করা মূঢ়তা ছাড়া আর কী? এ কথা যারা মায়ার বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছেন, তারাও জানেন। তাছাড়া তাদের মধ্যে অধিকাংশও হলেন চরম দুর্নীতিবাজ।
বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা এখন বন্যাকবলিত। হাজার হাজার লোক পানিবন্দি অবস্থায় অথবা অন্য জায়গায় সরে যেতে অশেষ দুর্দশার সম্মুখীন হয়েছেন। তাদের খাদ্য নেই, খাওয়ার পানি নেই, থাকার জায়গা নেই, অসুস্থ হওয়া লোকদের জন্য চিকিৎসা এবং ওষুধপত্রের ব্যবস্থা নেই। আজকের (২৭.৭.২০১৫) সংবাদপত্রেই (ডেইলি স্টার) রিপোর্ট করা হয়েছে- বান্দরবান, কক্সবাজার, ফেনী অঞ্চলে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে ৪০ হাজার লোক পানিবন্দি হয়েছেন। উত্তর বাংলার বিভিন্ন এলাকাতেও বন্যা পরিস্থিতি সংকটজনক। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকারের কোনো ত্রাণ তৎপরতা এসব অঞ্চলে নেই। তার কোনো কথাবার্তাও নেই।
স্বয়ং ত্রাণমন্ত্রীর এদিকে খেয়াল করা অথবা নিজের কর্তব্য পালনের কোনো সময় ও বাধ্যতা নেই! তিনি আগামী ১৫ আগস্টের অনুষ্ঠান কর্মসূচি নিয়েই ব্যস্ত! জনগণের প্রতি এই উদাসীনতা এবং তাদের বিপদ সত্ত্বেও সরকার কর্তৃক তাদেরকে বিপদে সাহায্য করতে এগিয়ে না আসার মধ্যে সরকারের জনবিচ্ছিন্নতাই যে প্রমাণ হয়, এ নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই।
কিন্তু এসবই বাংলাদেশের জনগণ এখনও পর্যন্ত সহ্য করে আসছে। এর বিরুদ্ধে তাদের কোনো সক্রিয় প্রতিক্রিয়া নেই। কোনো আন্দোলন নেই। এই পরিস্থিতির থেকে সুখের অবস্থা কোনো সরকারের পক্ষে আর কী হতে পারে? জনগণের এই অবস্থাই এখন সরকারের টিকে থাকার প্রধান কারণ।