ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বাংলাদেশের সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক,বিতর্ক এবং আলোচনা-সমালোচনা যার অলংকার বলা যায়। তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল সহ আরও বহু বিতর্কিত রায়ের সাথে তার নাম জড়িত ।সম্প্রতি বিএনপি নেতা সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদন্ডের রায় আপিল বিভাগে বহাল থাকার সংবাদে আমরা শংকিত এবং ব্যথিত।তাহলে কি সরকার বহুল বিতর্কিত “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল” এর মাধ্যমে বিচারের নামে জুডিশিয়াল কিলিং শুরু করেছে। আমরা স্বোচ্চার হয়ে এখনই তা বন্ধ করার চেষ্টা না করলে দেশ এক অনিশ্চিত গন্তব্যে রওনা দেবে সন্দেহ নাই ।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিচারে একটি সত্য প্রতিষ্ঠার প্রধান অন্তরায় ছিলেন স্বয়ং সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক।বাংলাদেশের মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল সর্বোচ্চ আদালত । অথচ এই শেষ আশ্রয়স্থলের লক্ষ্যই ছিল আইনের শাসন কায়েম না হোক, আইনের শাসনকে গলা টিপে হত্যাই যেনো ছিল এর উদ্দেশ্য ।
সদ্য সাবেক হওয়া প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের এই ভুমিকার কারন হতে পারে একটি আন্তর্জাতিক চক্র সহ তাদের দোসরদের ঠান্ডা মাথার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, হাজারো বর্ণচোরা, দালাল আর সুবিধাভোগী নপুংসক নেতাদের ভীড়ে আপাদমস্তক একজন সাচ্চা জাতীয়তাবাদী হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়া।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী হচ্ছেন তার তথাকথিত বোনের মাথার পট্টিতে টান দিয়ে জনগণের সামনে তার ভন্ডামীর মুখোশ উন্মোচন করা সহ একজন সুবক্তা, অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান, দক্ষ সংগঠক, স্পষ্টভাষী ও উচ্চ শিক্ষিত ।
একসঙ্গে এতগুলো গুণের অধিকারী একজন মানুষ আজকের দুনিয়ায় বিরল , কিন্তু তার বিরোধী মতের অনেকের ভাষায় ছিল এই "চাটগাঁইয়া বাঘ" তথা কথিত “বন্ধুরাষ্ট্রের” প্রচণ্ড বিদ্বেষী এক রাজনীতিক ব্যাক্তি । যিনি কখনো ভারত / ইন্ডিয়া না বলে সব সময় হিন্দুস্থান বলতেন । এতে তিনি তাদের আক্ষেপ এবং বিরক্তির কারন হন।
এবার আসি এই বীরের মামলার ব্যাপারে , রাষ্ট্রপক্ষের ৪১জন সাক্ষীর বিপরীতে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে মাত্র ৫ জনের বেশি সাক্ষীকে আদালতে উপস্থাপনের সুযোগ দেয়া হয়নি এবং সবচেয়ে ভাইটাল সাক্ষীর কন্ঠ রোধ করেই ন্যায় বিচারের পথ রুদ্ধ করে ।
আপনি একদিকে বিচার করবেন আরেক দিকে আত্বপক্ষ সমর্থনে সাক্ষীকে গলা ঠিপে ধরবেন !! এটাইকি ন্যায় বিচার ? এইটাই কি বিচারের মানদণ্ড ?? আমি দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে পারি পুরো বিচার পক্রিয়ার সুস্থ ধারাকে স্তব্দ করে দেওয়া হয়েছে সাফাই স্বাক্ষী “বিচারপতি শামীম হাসনাইন” কণ্ঠ রোধ করার মাধ্যমে ।
এ কথা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, ন্যায়বিচার শুধু করলেই হবে না, তা যে বাস্তবে নিশ্চিত হয়েছে তা প্রতীয়মানও হতে হবে।
গত ২২ জুলাই ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক বিচারপতি শামীম হাসনাইন বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য এবং স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে সাফাই স্বাক্ষী দেয়ার আগ্রহ জানিয়ে প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করলে যা অনেক পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ।
বিচারপতি শামীম হাসনাইন ঐ চিঠিতে লেখেন , ‘এটা সত্য যে একাত্তরের মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে আগস্ট পর্যন্ত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছিলেন।’ আরো উল্লেখ করেন, আমার কয়েকজন সহকর্মী বিচারপতি বলেছেন, আমি হাইকোর্ট বিভাগের একজন বর্তমান বিচারপতি ‘একদিকে আমার সরকারি বাধ্যবাধকতা / আচরণ এবং অন্যদিকে আমার বিবেকের তাড়নায় আমি দগ্ধ।..’ এটা দৃশ্যত অনুশোচনীয় যে একজন বিচারকের ‘বিবেকের তাড়নার’ কথা এখনো অপ্রকাশিত।
কিন্তু প্রধান বিচারপতি তার এই চিঠির ওপর ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোন রকম ব্যবস্থা নেননি । ফলে তিনি আর সাক্ষী দিতে পারেননি।
অন্য দিকে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনালে সাফাই সাক্ষী হিসাবে বিচারপতি শামীম হাসনাইনের ওপর সমন জারির আবেদন করা হয়েছিলো। বিচারপতি শামীম যেহেতু উচ্চ আদালতের একজন বিচারক সেই বিবেচনায় ট্রাইব্যুনাল তার ওপর সমন জারি থেকে বিরত থাকে।
তবে একটি সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য ট্রাইব্যুনালের এবং প্রধান বিচারপতির এই পাশ কাটিয়ে যাওয়া বা উপেক্ষা করা পুরপুরি ন্যায় বিচারের পরিপন্থি নয় কি ?? প্রধান বিচারপতি বিষয়টি উপেক্ষা করে বিচারকে প্রভাবিত করেছেন যা ভাবনায় আসতেই পারে ।
এমনকি এই ঘটনায় সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এবং ট্রাইব্যুনাল বিচার ব্যাবস্থা শুধু প্রশ্ন বিদ্ধ করেনাই সাথে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে ন্যায় বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে । বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাসে এটি সম্ভবত একটি নজিরবিহীন ঘটনা।
একজন বিচারক তার বিবেকের তাড়নায় সত্য উন্মোচন করতে চেয়েছেন । কিন্তু সেই সত্যকে গলা টিপে শুধু হত্যাই করা হয়নাই একজন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে দোষী সাব্যস্ত করতে ব্যাস্থ হয়ে উঠে দেশের সর্বোচ্ছ আদালত একই সঙ্গে । তাদের এই হীন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সুপ্রিম কোর্টের একজন বিবেক দংশিত বিচারপতির জবানবন্দি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তাও মনে করা হয়নাই ।
আমি জানিনা একজন বিচারপতি কোন মামলায় সাক্ষী দেওয়ার রেওয়াজ বা নিয়ম আছে কিনা কিন্তু রেওয়াজ না থাকলে ন্যায়বিচার ও স্বচ্ছতার খাতিরে নতুন রেওয়াজ গড়ে নিতে হবে। না হলে নিশ্চিত এই অবিচারের পরেও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে সাজা প্রদান করা হলে তা হবে পুরোপুরি ন্যায় বিচারের পরিপন্থি। জুডিশিয়াল কিলিং ।
২২ জুলাইয়ের চিঠিতে বিচারপতি শামীম হাসনাইনের সম্ভবত সব কথা বলেননি। তার সাক্ষ্য গ্রহণ করলে সম্ভবত তিনি আরও এমন সব কথা বলতেন যা এই মামলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে ডিসাইসিভ ফ্যাক্টর হতে পারতো। শামীম হাসনাইনকে যদি সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য অনুমতি দেওয়া হতো তাহলে এই মামলায় হয়তো নতুন মাত্রা যোগ হতো।
কারণ এটি যদি প্রমাণিত হতো যে, ঐ সময় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বাংলাদেশেই ছিলেন না তাহলে তার বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগ অর্থহীন হয়ে যেতো।
এখনো হয়তো সেই সুযোগ রয়েছে বা ন্যায় বিচারের স্বার্থে সুযোগ তৈরি করা উচিৎ , তা নাহলে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার উপর চিরস্থায়ী যে কলঙ্কের তিলক হয়ে থাকবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরির মামলা এবং এই তিলক লেপন করেছেন কয়েকজন ব্যাক্তি যারা এই অন্যায় বিচার কাজে সম্পৃক্ত। তাই হয়তো একদিন এই প্রহসনের বিচারে যারা সম্পৃক্ত ছিলেন বাংলাদেশের মাটিতে তাদেরই বিচার করতে হবে।