ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন তারই সরকারের অর্থমন্ত্রী ও বাকশালের কার্যকরী কমিটির ১৫ সদস্যের ৪ নম্বর সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদ।এককথায় বঙ্গবন্ধু এবং চার নেতাকে বাদে এই সরকার ছিলো আওয়ামী লীগ সরকার।জাতীয় সংসদ বহাল থাকে যাতে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্টতা ছিলো আওয়ামী লীগের।এমনকি বঙ্গবন্ধুর অনুগত সেনা,নৌ ,বিমান বাহিনী এবং বিডিআর প্রধান ১৫ই আগস্ট,১৯৭৫ সকালেই খন্দকার মোশতাকের প্রতি পূর্ন আনুগত্য ঘোষনা করেন।
কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার সন্তান মোশতাক আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে বি.এল ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯৪২ সালে রাজনীতিতে যোগ দেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম মহাসচিব এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের দ্বায়িত্ব পালন করেন তিনি।
কতিপয় সেনা সদস্যদের হাতে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মোশতাক আহমেদ নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। আশ্চর্য্যজনক বিষয় হল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্তাক্ত লাশ ৩২ নম্বরের সিঁড়িতে রেখেই তার দীর্ঘকালের সহচররা খন্দকার মোশতাক আহমদের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন।
যারা মন্ত্রী না হয়ে হত্যার প্রতিবাদ করে কারাগারকে বেছে নিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদসহ বেশ কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের মাঝামাঝি সময়ে মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত হয়েছিলেন।
মোশতাকের মন্ত্রিসভা বহাল থাকা অবস্থাই ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। বঙ্গবন্ধু হত্যার ১২ ঘণ্টার ব্যবধানে তারই ঘনিষ্ঠ সহচরদের মন্ত্রী হওয়ার ঘটনা খন্দকার মোশতাক সরকারের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী কারারুদ্ধ আওয়ামী লীগ নেতা আমীর হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদ মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগদানকারী সদস্যদের ফের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য না করলেও দুই নেতাই একবাক্যে বলেছেন, সে দিন যদি জাতীয় চার নেতার মতো অন্য মন্ত্রীরা মোশতাকের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ না করতেন তাহলে রাজনীতির ইতিহাস ভিন্ন হতে পারতো। কলঙ্কের কালিমা জাতিকে এতকাল বহন করতে হতো না। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করতে ৩৮ বছর লাগত না।
খন্দকার মোশতাকের ৮১ দিনের শাসনামলে সঙ্গী ছিলেন বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার ২১ সদস্য। মোশতাকের উপরাষ্ট্রপতি হলেন মোহাম্মদউল্লাহ।
আর মন্ত্রিসভার সদস্যরা হলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর, পরিকল্পনামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী, অর্থমন্ত্রী ড. আজিজুর রহমান মল্লিক, শিক্ষামন্ত্রী ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী আবদুল মান্নান, কৃষি ও খাদ্যমন্ত্রী আবদুল মোমিন, এলজিআরডি মন্ত্রী ফণিভূষণ মজুমদার, নৌপরিবহনমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, গণপূর্ত ও গৃহায়নমন্ত্রী সোহরাব হোসেন। প্রতিমন্ত্রীরা হলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী কে এম ওবায়দুর রহমান, ভূমি ও বিমান প্রতিমন্ত্রী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, রেল ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, শিল্প প্রতিমন্ত্রী নূরুল ইসলাম চৌধুরী, ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রতিমন্ত্রী ডা. ক্ষিতিশ চন্দ্র মণ্ডল, পশু ও মৎস্য প্রতিমন্ত্রী রিয়াজউদ্দিন আহমদ ভোলা মিয়া, যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ আলতাফ হোসেন ও মোমিনউদ্দিন আহমদ (বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় ছিলেন না)। এ ছাড়াও মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী রাষ্ট্রপতি মোশতাকের প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা হয়েছিলেন মন্ত্রীর সমমর্যাদায়।
খন্দকার মোশতাক সরকারের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের পথ উন্মুক্ত করে দেন সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও মহিউদ্দীন আহমদ বিশেষ দূত হয়ে। বঙ্গবন্ধুর বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৫ আগস্ট সংঘটিত হওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ আগে ৮ আগস্ট দেশে ফিরে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।
বঙ্গবন্ধু সরকারের আরেক রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদউল্লাহর স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে প্রবর্তন হয়েছিল বাকশাল ব্যবস্থা। বাকশাল ব্যবস্থার অধীনে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হলে মোহাম্মদউল্লাহ মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শপথ নেন
। ১৫ আগস্টের পর মোশতাকের উপরাষ্ট্রপতি হন মোহাম্মদউল্লাহ।
পরে বিএনপিতে যোগ দেন তিনি। জিয়াউর রহমান হত্যার পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি হলে উপরাষ্ট্রপতি করা হয় মোহাম্মদউল্লাহকে। কিন্তু শপথের দুই দিনের মধ্যে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে বিএনপির শেষ দুর্গের পতন ঘটে।
মোশতাক সামরিক শাসন কায়েম করলেও জাতীয় সংসদ বহাল রেখেছিলেন। স্পিকার ছিলেন আবদুল মালেক উকিল। স্পিকার হওয়ার আগে ছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি স্পিকার হিসেবে বিদেশে স্পিকারদের একটি সম্মেলনেও যোগ দেন।
বঙ্গবন্ধু সরকারের আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর মোশতাকেরও আইনমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। তিনি কুখ্যাত ইনডেমনিটি নামক বিলটির রচয়িতা।
মোশতাকের পতনের পর ফণিভূষণ মজুমদার, আবদুল মান্নান, আবদুল মোমিন, সোহরাব হোসেন, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, আবদুল মালেক উকিল, আসাদুজ্জামান খান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। মালেক উকিল আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন শেখ হাসিনা নেতৃত্বে আসার আগ পর্যন্ত। অধ্যাপক ইউসুফ আলী মোশতাকের পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন। পরে তিনি আওয়ামী লীগের (মিজান) সাধারণ সম্পাদক হন। পরে যোগ দেন জিয়ার মন্ত্রিসভায়।
জিয়ার মৃত্যুর পর এরশাদেরও মন্ত্রী হন তিনি। খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রীদের মধ্যে কেউ বেঁচে না থাকলেও বেঁচে আছেন প্রতিমন্ত্রী অনেকে। মোশতাকের ডেমোক্র্যাটিক লীগ থেকে এরশাদের উপপ্রধানমন্ত্রী হয়ে আসা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন এখন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান। নূরুল ইসলাম মঞ্জুরও বিএনপিতে আছেন।
আবু সাঈদ চৌধুরী আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফিরে না এলেও মহিউদ্দীন আহমদ ফিরে আসেন। ১৯৮৩ সালের ৮ আগস্ট তিনি বহিষ্কার হলে বাকশাল গঠন করে তার চেয়ারম্যান হন। ১৯৯৩ সালে বাকশাল আওয়ামী লীগে অন্তর্ভুক্ত হলে তাকে প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হয়। বেঁচে নেই তিনিও। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়ী হলেও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে পরাজিত হন। আবদুল মান্নান ও আবদুল মোমিনও বেঁচে নেই। ২০০২ সাল পর্যন্ত দুজনই আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। খন্দকার আসাদুজ্জামান আওয়ামী লীগে সক্রিয় ছিলেন। বেঁচে নেই বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীও।
তার পুত্র শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদের মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক হলেও শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে বহিষ্কৃত হন। মোশতাক মন্ত্রিসভার সদস্য দেওয়ান ফরিদ গাজী আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি। দলের উপদেষ্টা পরিষদেরও সদস্য তিনি। ১৯৯৬ সালেও এমপি ছিলেন।
সৈয়দ আলতাফ হোসেন বাকশাল প্রবর্তনের পর (ন্যাপ মোজাফফর) থেকে প্রতিমন্ত্রী হন। পরে মোশতাকের প্রতিমন্ত্রী। মোশতাকের পতনের পর আবার ন্যাপের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। মোমিনউদ্দিন আহমদ বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভায় না থাকলেও মোশতাক তাকে প্রতিমন্ত্রী করেন। পরে তিনি বিএনপি হয়ে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন।
রিয়াজউদ্দিন আহমদ ভোলা মিয়াও বিএনপি হয়ে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে মন্ত্রী হন। ডা. ক্ষিতিশ চন্দ্র মণ্ডলও জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে মন্ত্রী হন। মোশতাকের প্রতিমন্ত্রী নূরুল ইসলাম চৌধুরী ছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী। তিনি সামরিক বাহিনীর সমর্থন আদায়ে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।