ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বাংলাদেশের রফতানি আয়ের সবচেয়ে বড় খাত তৈরি পোশাক শিল্প। এ শিল্পের হাত ধরেই ২০২১ সালের মধ্যে রফতানি আয় ৫০ বিলিয়ন ডলারের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এছাড়া বাংলাদেশের পোশাক খাতকে দমিয়ে রাখতে ১২ দেশের ষড়যন্ত্রমূলক গোপন চুক্তির ফলে একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বাজার হাতছাড়া হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ট্রান্স-প্যাসেফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রসহ সদস্য দেশগুলোর বাজারে পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে কোনো শুল্ক সুবিধা না থাকায় বাংলাদেশের চেয়ে সুবিধা আদায় করে নেবে প্রতিযোগী ভিয়েতনাম। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ সূত্রে এ কথা জানা গেছে।
এতদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপিভুক্ত পণ্য তালিকায় তৈরি পোশাক না থাকার পরও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলত বাংলাদেশ। কিন্তু এখন নিজেদের সবচেয়ে বড় বাজার তছনছ হওয়ার আশঙ্কায় ভুগছে তারা।
বৃহত্তম বাজার যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও জাপান, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার বাজার নিয়েও একই দুশ্চিন্তা বাংলাদেশের। কারণ ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তির আওতায় এসব দেশে অবাধে শুল্কমুক্ত সুবিধায় পোশাক রফতানি করতে পারবে ভিয়েতনাম।
টিপিপি চুক্তির মাধ্যমে ১২টি দেশ নিজেদের মধ্যে শুল্কমুক্ত বাজার ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে এ বছর থেকেই। এর মধ্যে বাংলাদেশ নেই। ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও পোশাক রফতানিকারকরা।
টিপিপিভুক্ত ১২ দেশ হলো- যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান, ব্রুনেই, চিলি, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, পেরু, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম। এ ১২টি দেশ বিশ্বঅর্থনীতির ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভিয়েতনামের পণ্য রফতানিতে গড় শুল্কহার ৮.৩৪ শতাংশ। এ চুক্তি কার্যকর হলে তা আর থাকবে না। দেশটির বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ওপর আরোপিত গড় শুল্কহার ১৫.৬৮ শতাংশ।
ফলে টিপিপি কার্যকর হলে ভিয়েতনামের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠবে না বাংলাদেশ। বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি হয়েছে ৫০০ কোটি ডলারের। ২০১৩ সালে এর পরিমাণ ছিল ৫২৯ কোটি ডলার। অর্থাৎ এই এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি কমেছে ৫.৪৭ শতাংশ। একইভাবে কানাডায় ২০১৩ সালে রফতানি ছিল ১০০ কোটি ডলার। পরের বছর তা ৭ শতাংশ কমে নেমেছে ৯৩ কোটি ডলারে।
তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, ‘এখনই ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি পোশাক রফতানি করছে। টিপিপির ফলে দেশটি বিনা শুল্কে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানি করতে পারবে। তখন সেখানে ভিয়েতনামের পোশাক রফতানি অনেক বাড়বে।’
‘অন্যদিকে বাংলাদেশের এখনকার মতোই ১৫-১৬ শতাংশ শুল্ক কর পরিশোধ করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানির ক্ষেত্রে। এতে ভিয়েতনামের পোশাকের তুলনায় বাংলাদেশের পোশাকের দাম বেড়ে যাবে। তখন বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা হারাবে। এ পরিস্থিতি সামলাতে করণীয় নির্ধারণ করতেই এ বছর বিজিএমইএর কমিটি নির্বাচনের বদলে সমঝোতার ভিত্তিতে করা হচ্ছে, যাতে দরকষাকষিতে দক্ষ নেতৃত্ব পাওয়া যায়।’
গত ১২ মে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী পত্রিকা গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে বলেছে, ‘চীনের প্রভাব কমাতেই যুক্তরাষ্ট্র চীনকে বাদ দিয়ে তার আশপাশের দেশগুলোকে টিপিপির অন্তর্ভুক্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক এবং স্টিল ও ইস্পাত রফতানিতে চীনের ধারেকাছে কেউ নেই। নতুন এই চুক্তির ফলে অন্য দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রে বিনা শুল্কে এসব পণ্য রফতানি করতে পারবে।
এতে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রফতানি কমবে। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দফতর ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর) ও ভিয়েতনামের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে থাকা তথ্য অনুযায়ী এ বছরই চুক্তিটি স্বাক্ষরের পর কার্যকর করা হবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য ১১টি দেশ অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে এ চুক্তির পথে এগোচ্ছে। ২০০৯ সালে টিপিপি গঠনের উদ্যোগ নেওয়ার পর ২০১১ সালে প্রথম ১২ দেশের প্রতিনিধিরা বৈঠক করে এ বিষয়ে একমত হন।
তবে টিপিপিতে কী আছে, কোন কোন শর্ত পূরণ করলে এ চুক্তিতে থাকা যায়, তার কোনো কিছুই এখনও প্রকাশ করেনি যুক্তরাষ্ট্র। ফলে দেশটির ভেতরেও এ চুক্তির পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক রয়েছে। টিপিপি চুক্তির বিষয়ে প্রথম তথ্য ফাঁস করেন উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ।
এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘যদি তুমি পড়ো, লেখো, প্রকাশ করো, চিন্তা করো, শোনো, নাচো, গাও অথবা আবিষ্কার করো; যদি তুমি খামার করো অথবা খাবার কেন; যদি তুমি অসুস্থ হও অথবা একদিন অসুস্থ হবে বলে ভাবো- তাহলে তোমার স্বার্থের কেন্দ্রবিন্দু হবে টিপিপি।’ কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করায় এ চুক্তি নিয়ে নিজ দেশে সমালোচনার মুখে পড়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
কেন গোপনীয়ভাবে টিপিপি করা হচ্ছে- শ্রমিক সংগঠনগুলোর এমন প্রশ্নে গত ৮ মে ওবামা বলেছেন, ‘গোপনে চুক্তিটি করা হচ্ছে এটা সত্য নয়। আমি আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তিতে স্বাক্ষর করার ৬০ দিন আগে অনলাইনে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেব। তারপর এটি কংগ্রেসে যাবে। তখন সবাই জানতে পারবে এ চুক্তির কোথায় কী আছে।’ প্রায় দু’দশক আগে আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে করা এক চুক্তি আগেই প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ক্ষতি হয়েছিল।
এদিকে বিজিএমইএর সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, ‘এ চুক্তির ফলে আমেরিকার বাজার আমাদের একেবারে হাতছাড়া হয়ে যাবে- এমন আশঙ্কা ক্ষীণ। তবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে লড়াই করতে হবে। ভিয়েতনাম এমন সুযোগ পেলে অবশ্যই আমাদের চেয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে।’ যুক্তরাষ্ট্রসহ পোশাক শিল্পের মূল বাজার ধরে রাখতে সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা বা লবিংয়ে কোনো ধরনের সমস্যা ছিল কি-না, এমন প্রশ্নের সরাসরি জবাব দিতে রাজি হননি শহীদুল্লাহ আজিম।
তবে বলেন, ‘পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলেই এমন চুক্তি হয়ে থাকে। আমরা যেমন সাফটা চুক্তি করে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা নিতে পারছি। তবে চুক্তিটির শর্তগুলো এখনও প্রকাশ করা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি জানে না বিজিএমইএ। জানার পরই এ বিষয়ে বিস্তারিত মনোভাব জানানো হবে।’
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (এফটিএ) মনোজ কুমার রায় বলেন, ‘টিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত হতে হলে যেসব শর্ত রয়েছে, চেষ্টা করেও সেগুলো জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছে না। অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে দেশগুলো এ চুক্তি করছে। ফলে বাংলাদেশ আগ্রহী হলেও এতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। তবে টিপিপি কার্যকর হলে তা বাংলাদেশের রফতানিতে কোন ধরনের প্রভাব ফেলবে, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন গবেষণা করছে।
আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস)।’ টিপিপির কারণে ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা ভিয়েতনামে ভিড় করছেন। আগে বাংলাদেশ থেকে পোশাক নিতেন, এমন অনেক ক্রেতাও এখন যাচ্ছেন ভিয়েতনামে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গত বছর থেকে বাংলাদেশের পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধি যেখানে পড়তির দিকে, সেখানে ভিয়েতনামের পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধির হার ১২ শতাংশেরও বেশি। গত বছর জাপানের আমদানি বাণিজ্য আগের বছরের চেয়ে ১ শতাংশ কমেছে; অথচ সেখানেও ভিয়েতনামের গার্মেন্ট রফতানি বেড়েছে ৯ শতাংশ।
আর ২০১৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আমদানি বেড়েছে ৯ শতাংশ, সেখানে ভিয়েতনামের পোশাক রফতানি বেড়েছে ১৭ শতাংশ। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রফতানিতে ১২.২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে রফতানির পরিমাণ এক হাজার ১০০ কোটি ডলারে পৌঁছাবে বলে আশা করছে ভিয়েতনাম। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে দেশটির পোশাক রফতানির পরিমাণ ছিল ৯৮০ কোটি ডলার।