ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদকে নিয়ে এখন বাংলাদেশে তুমুল আলোচনা। প্রতিদিনই চলছে তর্ক-বিতর্ক।বিশেষ করে এই দলের উত্তান এবং ৭৫ এ বঙ্গবন্ধুর হত্যায় জাসদের ভূমিকা নিয়ে ব্যপক আলোচনা চলছে।এরইমধ্যে জাসদ নিয়ে মনীষী লেখক আহমদ ছফা’র একটি লেখা পর্যবেক্ষকদের নজরে এসেছে।
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ওই লেখার শিরোনাম ছিল- জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল: একটি সেন্টিমেন্টাল মূল্যায়ন।
এই লেখায় আহমদ ছফা লিখেছেন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের যখন সমালোচনা করি, মনে হয় নিজের শরীরে ছুরি চালাচ্ছি। এক সময়ে আমি ওই দলটির প্রেমে পড়েছিলাম। জীবনের অনেকগুলো বছর আমি ঐ দলের সঙ্গে যুক্ত থেকেছি। এগুলো আমার জীবনের অন্ধতা ও মুগ্ধতার বছর। অন্ধ করতে পারা, মুগ্ধ করতে পারা একটা ক্ষমতা। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের তারুণ্যের সম্মোহনমন্ত্রে মোহিত হয়ে আমার মতো অনেকেই এই দলটির পতাকা তলে সমবেত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের সমাজ শরীর থেকে ফেটে পড়া অফুরুন্ত প্রাণশক্তির এই দুর্বার যৌবনতরঙ্গের কথা যখন চিন্তা করি, একটা অপরূপ বিস্ময়বোধ আমার মনকে ”ঞ্চল এবং উতলা করে তোলে। সেই অপচিত তারুণ্যের কথা যখন স্মরণে উদিত হয় একটা সুগভীর বেদনাবোধ আমার সমগ্র সত্তা আচ্ছন্ন করে ফেলে।
ওই নিবন্ধে আহমদ ছফা আরও লিখেছেন, একটি রাজনৈতিক দল বা শ্রেণীসমূহের আশাআকাক্সক্ষা তুলে ধরে ভুল কিংবা হঠকারী পন্থা গ্রহণ করার কারণে কিংবা সমাজের সঠিক বিশ্লেষণের অভাবে যখন একের পর এক উল্টা সিধা কর্মসূচি গ্রহণ করতে থাকে, সেই ধরনের পরিস্থিতিতে ওই দল বা দলগুলো পরাজিত হয়। তাদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে যে শ্রেণী বা শ্রেণীসমূহ তাদের ওপর আস্থাস্থাপন করে এবং সক্রিয়ভাবে সমর্থন যোগায় তাদের আশাআকাক্সক্ষারও পরাজয় ঘটে। সমাজের সমর্থনকারী অংশের মধ্যে নেমে আসে হতাশা এবং অপরিমিত শূন্যতাবোধ।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল এবং সিরাজ সিকদারের পার্টির ভরাডুবি বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রথম সামরিক শাসনের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের দক্ষিণ দুয়ার খুলে দিয়েছে।
দ্বিতীয়ত মৌলবাদের উত্থানকে সম্ভাবিত করেছে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল এবং সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির তরুণরাই ছিলেন বাংলাদেশের সমাজ পরিবর্তনের সবচাইতে সম্ভাব্য প্রতিশ্রুুতিশীল শক্তি। এই দুটি দলের উদ্ভব স্বাধীনতা পরবর্তীকালে। জাসদের সিংহভাগ নেতা ও কর্মী এসেছে আওয়ামী লীগ থেকে। অন্যদিকে সিরাজ সিকদারের দলটির জন্ম হয়েছিল এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ক্রমপরিবর্তন এবং ক্রমবিভাজনের মধ্যদিয়ে। বাংলাদেশের মুুক্তিযুদ্ধ তৎকালীন বিরাজমান রাজনৈতিক প্রবাহের দুটি ধারা বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল।
জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্ন অংশটির নাম ‘জাসদ’ এবং চীনপন্থী কমিউনিস্ট রাজনীতির ছিটকে বেরিয়ে আসা অংশ ‘সর্বহারা পার্টি’ নাম পরিচিতি লাভ করে। জাসদ দলটি কিভাবে কোন পরিস্থিতিতে জন্ম লাভ করেছিল, সে কথায় আসা যাক।
স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারত সরকার তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠনের উদ্যোগ নিলো। তখন শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগারে। তাজউদ্দীনের সরকারকে ভারত সরকার সাহায্য দিচ্ছিলো বটে। কিন্তু আশ্বস্ত হতে পারছিলো না। শেখ মুজিব পাকিস্তানের জেল থেকে ফেরত আসতে পারবেন কি না এ বিষয়ে ভারত সরকারের দ্বিধা ছিল। মুজিববিহীন বাংলাদেশে তাজউদ্দীন টালমাটাল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবেন সে বিষয়েও ভারত সরকার একরকম নিশ্চিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, সেজন্য সেকেন্ড লাইন অব ডিফেন্স হিসেবে জনাব সিরাজুল আলম খান এবং মরহুম ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে ‘মুজিব বাহিনী’ গঠন করে ট্রেনিং দিতে থাকে। মুজিব বাহিনী গঠন করার ক্ষেত্রে ভারত সরকার তাজউদ্দীন সরকারের সঙ্গে কোন পরামর্শ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি।
এই মুজিব বাহিনীর নেতৃবৃন্দ বহুবার খোলাখুলিভাবে তাজউদ্দীনের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ পর্যন্ত করেছিলেন। মাঈদুল আহসান রচিত ‘মূলধারা ৭১’ বইটি যারা পাঠ করেছেন, তাদের কাছে এ বিষয় অজানা নয়।
স্বাধীনতার পর তাজউদ্দীনের সঙ্গে মুজিব বাহিনীর লোকজন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। সিরাজুল আলম খান ও শেখ ফজলুল হক মণির মধ্যে নানা ব্যাপারে মতান্তর ঘটে যায়। শেখ ফজলুল হক মণি তাজউদ্দীনের সরকারকে ভারতের মাটিতে চ্যালেঞ্জ করেছেন, কিন্তু শেখ মুজিব পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে যখন দেশের সর্বময় কতৃত্ব গ্রহণ করলেন, শেখ মণি মামার সরকারকে সমর্থন করাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করলেন। কথাটা সহজভাবে বললাম, অতো সহজে কিন্তু মণি-সিরাজ দ্বন্দ্বটি প্রশমিত হয়নি। আওয়ামী লীগ মধ্যশ্রেণি নিয়ন্ত্রিত মাল্টিক্লাস রাজনৈতিক সংগঠন। আওয়ামী লীগভুক্ত সমস্ত অংশের রাজনৈতিক আকাক্সক্ষাও এই ভাঙনের প্রতিক্রিয়ায় নিশ্চিত ভূমিকা পালন করেছে।
মূলত আওয়ামী লীগেরই লড়াকু অংশটি স্বাধীনতা- উত্তরকালে জাসদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। আরো একটা সত্যের উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে। জাসদের জন্মের প্রক্রিয়ায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন এই পার্টিটিকে টাকা কড়ি দিয়ে এবং আরো নানা সাহায্য সহযোগিতা করেছিলেন। সেই সময়ে অনেকেই এ ধারণা পোষন করতেন মুজিব-তাজউদ্দীনের মধ্যে ভবিষ্যতে যদি মতান্তর ঘটে সে কথা চিন্তা করে ভবিষ্যতের আশ্রয় হিসেবে তাজউদ্দীন নতুন পার্টিটিকে জন্মাতে সাহায্য করেছেন। পরবর্তীতে তাজউদ্দীন-মুজিবের অবশ্যই মতান্তর ঘটেছিল। কিন্তু জাসদে যোগদান করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। আর জাসদের তরুণ নেতৃবৃন্দ আওয়ামী লীগের কোন নেতার নির্দেশ মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। জাসদ প্রতিষ্ঠিত হলো। বৈজ্ঞাণিক সমাজতন্ত্র কায়েম করার গালভরা ঘোষণা দেওয়া হলো। মার্কসবাদ লেনিনবাদ অনুসরণ করে সমাজ বিপ্লব ঘটিয়ে তোলার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে মাঠে নামলো। লক্ষ লক্ষ তরুণ আগুনে প্রতঙ্গের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো। ঝড়ের মতো তাদের উচ্ছ্বাস আবেগে উচ্চারিত কন্ঠস্বর দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ধবনিত হতে থাকলো।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসবের পরিণতি কি দাড়ালো। জাসদের নেতারা সদর্পে মার্কসবাদ লেনিনবাদ প্রতিষ্ঠা করার কথা বলতে থাকলেন, শ্লোগানে মিছিল রাজপথ মুখরিত হয়ে উঠলো, দেয়াল অজস্র চিকায় ভরে গেলো। কিন্তু তারা স্বভাবে থেকে গেলো আওয়ামী লীগের অপকৃষ্ট অংশ। জাসদ নেতৃবৃন্দ কর্মীদের বিশ্বাস করিয়ে ছেড়েছিলো আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার তাদের সঙ্গত অধিকার আছে।