ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বাবা-মায়ের সঙ্গে ইউরোপ পাড়ি দিতে গিয়ে প্রাণ হারালো তিন বছরের ছোট্ট আয়ালান। দালালদের সঙ্গে তার বাবা আব্দুল্লাহি কুর্দির চুক্তি হয়েছিল একটি মোটরচালিত নৌকায় করে তারা তুরস্ক থেকে গ্রিসে যাবেন। এরপর সেখান থেকে যাবেন কানাডায়। সেখানে শুরু হবে তাদের নতুন জীবন।
কিন্তু নতুন জীবনের পরিবর্তে সাগর কেড়ে নিল তার স্ত্রী ও দুই সন্তানের জীবন। এখন এই দুঃসহ স্মৃতিকে আকড়ে ধরে আছেন কুর্দি। বেঁচে আছেন তিনি। তবে সব কিছু হারিয়ে। বৃহস্পতিবার তুরস্কের বোদরামের নিকটবর্তী মুগলা শহরের একটি মর্গ থেকে বেরিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন কুর্দি।
সাগরে নৌকাডুবির পর সৈকতে ভেসে এসেছিল তার তিন বছরের সন্তান আয়লানের মৃতদেহ। পরে এক পুলিশ শিশুটির মৃতদেহ কোলে তুলে নেন। মর্গ থেকে বেড়িয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, ‘এখন আমি আর কিছুই চাই না। এখন যদি আপনারা আমাকে বিশ্বের সবগুলো দেশ দিয়ে দেন তবুও আমার আর কিছুই চাই না। আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসগুলোই আমি হারিয়ে ফেলেছি।’ তবে কুর্দির এখন একটাই চাওয়া। স্ত্রী-সন্তানের মৃতদেহ তিনি সিরিয়ার কোবানিতে নিয়ে যেতে চান।
তিনি জানিয়েছেন, তার আর ইউরোপে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন “আমি শুধু শেষবারের মতো আমার সন্তানদের দেখতে চাই এবং চিরদিন তাদের সঙ্গে থাকতে চাই।’ অনেকটা আক্ষেপ নিয়ে তিনি সংবাদ কর্মীদের জানান, ‘নিজের দেশের যুদ্ধ থেকে বাঁচতে আমরা যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম সেখানে আমাদের সঙ্গে যা ঘটল তা সারা বিশ্ব দেখুক। এটাই আমাদের একমাত্র চাওয়া। আমার সঙ্গে যা ঘটেছে এমনটা যেন আর কারো ক্ষেত্রে না ঘটে। এটা ঠেকানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এটাই যেন শেষ হয়।”
স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পরিবারসহ গ্রিসে যাওয়ার জন্য দুইবার তিনি দালালদেরকে টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে একটি নৌকায় যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি এবং আরো কয়েকটি পরিবার। যাত্রা শুরুর পরপর নৌকায় পানি উঠতে শুরু করলে লোকজন আতঙ্কে উঠে দাঁড়ানোর পর সেটি ডুবে যায়।
সেই দুঃসহ স্মৃতি বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘আমি আমার স্ত্রীর এবং সন্তানদের হাত ধরে ছিলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আমার ছেলেরা হাত ফস্কে যায়। আমরা কোনোভাবে নৌকাটি ধরে রাখতে চেয়েছিলাম। গভীর অন্ধকারে সবাই খুব ভয় পেয়েছিলাম।’ কানাডা প্রবাসী বোনের স্পন্সরে অভিবাসনের জন্য আবেদন করেছিলেন কুর্দি। তবে গত জুনে সেই আবেদন নাকচ করে দেয় কানাডা কর্তৃপক্ষ। আব্দুল্লাহর বোন তিমা কুর্দিকে উদ্ধৃত করে কানাডার ন্যাশনাল পোস্ট পত্রিকা জানিয়েছে, ‘আমি তাদের স্পন্সরের চেষ্টা করেছিলাম। আমার বন্ধু ও প্রতিবেশীরা ব্যাংক ডিপোজিট দিয়ে আমাকে সহায়তা করেছিল। কিন্তু আমরা তাদের আনতে পারিনি এবং সে কারণে তারা ওই নৌকায় গিয়েছিল। তুরস্কে তাদের থাকার জন্যও আমি টাকা পাঠাচ্ছিলাম। কিন্তু সেখানে তারা সিরীয়দের সঙ্গে যে আচরণ করে তা ভয়াবহ।’
মুগলার নিরাপত্তা কর্মীরা জানিয়েছেন, আব্দুল্লাহর দুই শিশু সন্তান ও তার স্ত্রীর মরদেহ বিমানে করে ইস্তানবুল হয়ে দক্ষিণপূর্বাঞ্চলীয় শহর সানলিউরফায় পাঠানো হবে, সেখান থেকে সড়ক পথে সীমান্তবর্তী সিরীয় শহর কোবানিতে নেওয়া হবে।
আব্দুল্লাহ ও তার পরিবারের সঙ্গে নৌকাডুবির ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ওমের মহসিন নামের আরেক সিরীয় বলেন, রাত ২টায় যাত্রা করার কিছুক্ষণ পর নৌকাটি ডুবে গেলে সাঁতরে তীরে আসেন তিনি। কিন্তু তার ভাই এখনও নিখোঁজ ভাইকে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। তিনি জানিয়েছেন, ‘নৌকায় বড় জোর ১০ জনকে উঠানো যেত। কিন্তু তারা ১৭ জনকে উঠিয়েছিল। আমি ও আমার ভাই প্রত্যেকে দুই হাজার ৫০ ইউরো করে দিয়েছিলাম।’
একটি ভিডিওচিত্রে সৈকতে বালুতে আরেকটি শিশুর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। ওই মৃতদেহটি আয়লানের ভাইয়ের হতে পারে ধারণা করা হচ্ছে। সৈকতে আয়লানের মৃতদেহের ছবি তুলেছেন দোয়ান বার্তা সংস্থার আলোচিত্রী নিলুফার দেমির।
তিনি সিএনএনকে জানিয়েছেন, ‘যখন দেখলাম শিশুটিকে বাঁচানোর আর কোনো উপায় নেই তখন ভাবলাম তার ছবি তোলা উচিৎ, যাতে মর্মান্তিক এই ঘটনা দেখানো যায়। এখন এই ছবিটি যে প্রভাব ফেলেছে তা অভিবাসী সমস্যা নিরসনে সহায়তা করবে বলে আমি আশা করছি।’ আব্দুল্লাহ কুর্দি পুলিশকে জানিয়েছেন, তার হাত থেকে শিশুরা ফস্কে যাওয়ার পর তিনি তন্ন তন্ন করে তাদের খুঁজেছেন। তারা প্রায় তিন ঘন্টা পানির মধ্যে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করেছেন।
এরপর হয়ত ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। তাই আর কথা বলতে পারছেন না বলে ক্ষমা চাইলেন। তবে কথা শেষ করার আগে কিছু বার্তা দিলেন তিনি, ‘আমি সত্যিই চাই পাচার বন্ধ হোক। যারা শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছেন তাদের জন্য একটি সমাধানের পথ খোলা হোক।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি গতকাল পাচারকারীদের একটি পয়েন্টে গিয়েছিলাম। সেখানে অন্যদেরকে সর্তক করেছি যেন তারা পাচারকারীদের পাল্লায় পড়ে শিশুদেরকে নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নৌকায় না ওঠে। আমি তাদেরকে আমার ঘটনা বর্ণনা করায় অনেকেই নিজেদের সিদ্ধান্ত বদলেছে।’ আয়লানের মৃত্যুর পর অভিবাসী সমস্যার সমাধানে ইউরোপীয় দেশগুলো সমাধানে আশার চেষ্টা করবেন বলেই আশা করছে বিশ্ববাসী।