ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্রমবর্ধমান স্বৈরতান্ত্রিক আচরণে ম্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছে বলে যে প্রবল অভিযোগ রয়েছে শেখ হাসিনা স্বয়ং তা নাকচ করে দিয়েছেন।
রাষ্ট্রীয় পুলিশ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগও অস্বীকার করেছেন তিনি।
প্রভাবশালী এবং বহুল প্রচারিত ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানকে দেয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের বেপরোয়া, দীর্ঘকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ তার সরকারের বিরুদ্ধে উত্থাপিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বিপুল সংখ্যায় তথাকথিত গুম, বিরোধী নেতাকর্মী ও ইসলামপন্থীদের গণগ্রেপ্তার এবং গণমাধ্যম ও ইন্টারনেট স্বাধীনতার ওপর নতুন কড়াকড়ি আরোপের মাধ্যমে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশটিকে কার্যত একটি নিপীড়ক, একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার অভিযোগ অস্বীকার করেন।
‘আমার কাজ হচ্ছে সাধারণ মানুষকে সহায়তা করা,’ বলছিলেন শেখ হাসিনা। ‘আমি জনগণের জন্য রাজনীতি করি, আমার জন্য করি না… জনগণ এখন গণতন্ত্র উপভোগ করছে। লোকজন চায় তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ। কাজেই আমি জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি- যার অর্থ হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও কাজের সুযোগ এবং উন্নত জীবন।’ ‘২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে মধ্যম আয়ের দেশ আর ২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে উন্নত দেশ… সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর রয়েছে এবং জনগণ সন্তুষ্ট এবং জনগণ এটা উপভোগ করছে। কাজেই আপনারা যেভাবে বলছেন যে আমি প্রভুত্ব করছি, আমি প্রভুত্ব করছি না। আমি জনগণের সেবক।’
২০০৯ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন। তিনি জাতিসংঘের দারিদ্র দূরীকরণ এবং উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়তা করেন। তিনি দেশের ভেতরে বেশ সমর্থন পান বলে মনে করা হয়।
নিরাপত্তা বাহিনীর বিশেষ করে ভীতিকর আধা সামরিক বাহিনী র্যাবের বিরুদ্ধে সংবিধান ও সংসদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে বিপুল সংখ্যায় তথাকথিত ক্রসফায়ারে হত্যার অভিযোগ সরাসরি নাকচ করে দেন তিনি।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নব্বইয়ের দশক থেকে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল, সংবাদপত্র এবং অনলাইন গণমাধ্যমের অভূতপূর্ব বিকাশের অনুমতি দিয়েছে। ‘কে এই পরিবর্তন এনেছে? এটা আমিই করেছি। আমি এটা উন্মুক্ত করে দিয়েছি,’ বলেন তিনি।
‘এখন আমাদের ৪৪টি টেলিভিশন চ্যানেল এবং সারাদেশে প্রায় ৭০০ সংবাদপত্র রয়েছে। কাজেই তারা লিখছে এবং তারা স্বাধীন। বেসরকারি সংস্থাগুলোও আইন অনুসারে কাজ করছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, দেশের বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপি গত সংসদ নির্বাচন বর্জন করে নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছে। এতে অবধারিতভাবেই জিতে গেছে আওয়ামী লীগ ও তার ক্ষুদ্র মিত্ররা।
এরপর বিএনপি এবং তার মিত্র জামায়াতে ইসলামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচনের দাবিতে সারাদেশে ধর্মঘটের ডাক দেয়, যা মাঝে মাঝে সহিংস বিক্ষোভে রূপ নেয়, তবে তা কাজে আসেনি।
গার্ডিয়ানের সাথে সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাথে তার বৈরিতা নিরসনের কোনো কথা বলেননি।
তিনি বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করে অন্তর্বর্তী সরকারের মন্ত্রিত্ব দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি যাতে যৌথ প্রশাসনের অধীনে নির্বাচন হয় এবং ভোট কারচুপির যে সন্দেহ বিএনপি করেছিল তা দূর হয়।
শেখ হাসিনার দাবি, খালেদা ক্রুদ্ধস্বরে তা নাকচ করে দেন।
‘নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে (খালেদা) রাজনৈতিক ভুল করেছিলেন,’ দাবি শেখ হাসিনার।
শেখ হাসিনা তার বিরোধীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন এবং সারা বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার অভিযোগ আনেন। রাজনীতিতে প্রবেশের পর শেখ হাসিনা একাধিক হত্যা প্রচেষ্টা থেকে বেঁচে গিয়েছেন।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জনগণের ভয়কে কাজে লাগিয়ে তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নির্মম পদক্ষেপকে জায়েজ করার চেষ্টা করছেন। সমালোচকরা বলছেন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তার কড়া অবস্থান সত্ত্বেও তিনি পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের আদলে দেশব্যাপী ইসলামী পুনর্জাগরণ নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং জঙ্গি ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছেন। শান্তিশৃঙ্খলার কথা বলে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে।
গত সপ্তাহে ঢাকার ফ্ল্যাটে বোমা তৈরির সরঞ্জাম রাখার অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর দুজন সাবেক এমপিসহ ১৩ জনকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।
বিএনপি এবং জামায়াত বলছে, এসব মামলা ভিত্তিহীন এবং হয়রানির জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা। বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করছে যে, সরকার দেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করছে।
দলনিরপেক্ষ সংগঠন বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সমিতির সভাপতি আতাউর রহমান বলেন, সরকারের দুর্বিনীত আচরণে গণতন্ত্রের ওপর আস্থা নষ্ট হচ্ছে এবং গণপ্রতিরোধের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
‘এক ব্যক্তির ক্রমবর্ধমান স্বৈরশাসনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এর ফলে আমরা গণতন্ত্র হারানোর কিনারায় দাঁড়িয়েছি। পুলিশ ও বিচার বিভাগের মত বেশিরভাগ সরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের স্বায়ত্তশাসন হারাচ্ছে। বেসামরিক আমলাতন্ত্র তাদের স্বাধীনতা হারাচ্ছে,’ বলছিলেন আতাউর। ‘বিশ্ববিদ্যালয়, গণমাধ্যম এবং সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহারকারী সুশীল সমাজের কুশীলবরাও চাপের মধ্যে। সেল্ফ সেন্সরশিপের (স্ব আরোপিত নিষেধাজ্ঞা) প্রবণতাও ক্রমবর্ধমান। আপনি কথা বলতে পারবেন। তবে তাতে বিপদ আছে। বেসরকারি সংস্থাগুলোও এখন ভীষণভাবে নিয়ন্ত্রিত।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেনাবাহিনর সাবেক একজন জেনারেল বলেন, ‘লোকজন মধ্যরাতে নিখোঁজ হয়ে যায়।’ তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমিও তাদের ভাগ্য বরণ করতে চাই না।’
‘২০১৪ সালের নির্বাচন (বিরোধীরা) বয়কট করার কারণে শেখ হাসিনার শাসন করার বৈধতা (ম্যান্ডেট) নেই। এ কারণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রযন্ত্র যেমন র্যাব, পুলিশ, সীমান্তরক্ষী (বিজিবি) বেসামরিক প্রশাসন এবং সর্বোপরি সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছেন।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। যখন এটির বিস্ফোরণ হবে, কেউ জানে না তা কখন হবে, তবে হবে এবং এটা হবে চরম বিশৃঙ্খল। এটা বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। আন্তর্জাতিক কিংবা যুক্তরাজ্যের জন্যও মঙ্গলজনক হবে না।’
দেশের সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যম এখন নজিরবিহীন অবস্থার সম্মুখীন। সরকার একে দমন করছে। এক্ষেত্রে তিনি ইন্টারনেট ও সম্প্রচার মাধ্যমের কথা উল্লেখ করেন যেখানে রাষ্ট্রের প্রতি অশ্রদ্ধা পোষণ করে মত প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তিনি সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার, সরকার বিরোধী টিভি স্টেশনকে লক্ষ্যবস্তু বানানো এবং সরাসরি প্রচারিত টিভি শোর কথা বলেন। তার মতে, গণমাধ্যম এখন ক্রমবর্ধান ‘চরম নিয়ন্ত্রণমূলক’ পরিবেশের মধ্যে কাজ করছে যার ফলে প্রায়শই সেলফ সেন্সরশিপের ঘটনা ঘটছে। ‘সরকার তার সব রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করেছে। এখন তারা গণমাধ্যমের সমালোচনার দিকে মনযোগ দিয়েছে। কারণ আমরা স্বাধীন। আমরা দুর্নীতি এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ব্যাপারে অত্যন্ত শক্তিশালী। কিন্তু তারা তো কোনো ভিন্নমত গ্রহণ করতে চায় নাি।’
তবে শেখ হাসিনার এতোসব সমালোচনা সত্ত্বেও মাহফুজ আনাম এবং অন্য সমালোচকরা তার প্রংশসা করছেন এই কারণে যে তিনি দীর্ঘ ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে ক্ষমতার চূড়ায় আরোহন করেছেন।
দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ৬ শতাংশ হারে। বেশিরভাগ লোকের জীবনমান উন্নত হচ্ছে। দেশ এখন আগের চেয়ে অনেক স্থিতিশীল। সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুসারে দেশের ৬৭% লোক তাকে সমর্থন করছে।
মাহফুজ আনাম বলেন, ‘তিনি তার বাবার খুনীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। তিনি বিরোধীদের দমন করেছেন। তিনি দেশে জনপ্রিয়। সেনাবাহিনী তার নিয়ন্ত্রণে। উন্নয়ন একটি সফল কাহিনী এবং সংবিধান তাকে সীমাহীন ক্ষমতা দিয়েছে।’ ‘তোমাদের দেশ যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে একটি প্রবাদ আছে না যে তিনি সমানদের মধ্যে প্রথম। এখানে এটা ভিন্ন। হাসিনাই প্রথম, সমান নয়।’
তবে ঢাকায় কর্মরত জাতিসংঘ কর্মকর্তা রবার্ট ওয়াটকিনস বাংলাদেশে ভবিষ্যতে কোনো বিপদের কারণ দেখছেন না। ‘আমি মনে করি না কোনো বিস্ফোরণ হবে। যতদিন অর্থনীতি উন্নতি করবে, যতদিন লোকজন ঢাকায় এসে চাকুরি পাবে, লোকজনকে যতদিন সরকার ব্যস্ত রাখতে এবং খাওয়াতে পারবে ততদিন তারা গণতন্ত্র নিয়ে কমই মাথা ঘামাবে।’ ‘এটা (গণতন্ত্র) বেশিরভাগ লোকের প্রথম অগ্রাধিকার নয়। এটা ঠিক তারা (২০১৪ সালের) নির্বাচনের ফল নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। কিন্তু জীবন চালিয়ে যাওয়াই তো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
আন্তর্জাতিকভাবে শেখ হাসিনা এখন যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কৌশলগত সমর্থন পাচ্ছেন। তারা ২০১৪ সালের নির্বাচনের নিন্দা করলেও এখন জনসমক্ষে এ নিয়ে কিছু বলছে না।
একজন পশ্চিমা কর্মকর্তা বলেন, তারা ২০১৯ সালে একটি ভালো নির্বাচনের আশায় খুশি হয়ে আছেন বলে মনে হচ্ছে। ভারত ও চীন সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে এবং এদেশে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে।
তবে নির্মম বাস্তবতা হলো যে হাসিনার বাংলাদেশে কেউই ক্ষমতা আকড়ে থাকতে পারে না- এবং এ ব্যাপারে তেমন কেউ দ্বিমতও পোষণ করছে না। হাসিনার চিরচেনা কথা দিয়েই শেষ করা যাক: ‘আমাদের দেশে আমরা তোমাদের ওয়েস্টমিনস্টার ধাঁচের গণতন্ত্র চর্চা করি। কাজেই জনগণ যতদিন চাইবে আমি ততদিন আছি। তারা যদি না চায় তো বেশ। ক্ষমতায় থাকি আর না থাকি আমি জনগণের জন্য কাজ করে যাব এবং আমি তাই করছি।