দৈনিক প্রথম বাংলাদেশ প্রতিবেদনঃ খুলনায় দেবরের গুলিতে সাবেক এমপির পুত্রবধূ নিহতের ঘটনায় রহস্য দানা বাঁধছে। এর নেপথ্যে কারণ কী?
তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। ঘটনার পর থেকে হত্যাকারী হেদায়েত হোসেন পলাতক রয়েছে। বুধবার রাত সাড়ে ৮টায় এ ঘটনা ঘটে।
নিহতের নাম সনিয়া রাব্বি সুলতানা লিপি (৩২)। তার শ্বশুর খুলনা-৪ আসনের সাবেক এমপি মোল্লা জালাল উদ্দিন। গতকাল দুপুরে জালাল উদ্দিন বাদী হয়ে ভাইপো মাওলানা হেদায়েত হোসেনকে আসামি করে খুলনা সদর থানায় মামলা করেছেন।
নিহতের বড় ভাই আসাদুজ্জামান মিলন দাবি করেন, হেদায়েত হোসেন ঠাণ্ডা মাথায় আমার বোনের মাথায় শর্টগান ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে।
ময়নাতদন্ত শেষে লিপির লাশ খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হিমাগারে রাখা হয়েছে। আজ শুক্রবার নিহতের স্বামী কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী হেলাল ও শাশুড়ি ফাতেমা বেগম হজ শেষে খুলনায় আসার পর দিঘলিয়া উপজেলার মোল্লাডাঙ্গায় জানাজা শেষে দাফন করা হবে বলে পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, মুন্সিপাড়া পুলিশ লাইনের পূর্বগলির ১৩ নম্বর বাড়ির পাঁচতলায় খুলনা-৪ (রূপসা-তেরখাদা-দিঘলিয়া) আসনের সাবেক এমপি মোল্লা জালাল উদ্দিনের বড় ছেলে কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী হেলালের স্ত্রী লিপি, তার ছোট বোন আঁখি ও মোল্লা জালালের ভাই লোকাই মোল্লার ছেলে মাওলানা হেদায়েত হোসেন একটি কক্ষে বসে গল্প করছিলেন।
ওই কক্ষে থাকা হেলালের নামে লাইসেন্স করা শর্টগান দিয়ে হেদায়েত গুলি চালালে গুলিটি লিপির মাথায় বিদ্ধ হয় এবং ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ যায়। সেখান থেকে যে শর্টগান দিয়ে গুলি করা হয় সেই শর্টগান এবং তার কাভার ঘরের মেঝে থেকে উদ্ধার করে। এছাড়া খাটের ওপর একটি ভ্যানেটি ব্যাগ ও একটি মোবাইল ফোন পড়েছিল।
ঘটনার পরপরই হেদায়েত দ্রুত বাড়ি থেকে শটকে পড়ে। গুলির শব্দ শুনে প্রতিবেশীরা এগিয়ে আসলে হেদায়েতকে গেট থেকে বের হতে দেখে। এসময় তার কাছে প্রতিবেশী রফিকুল ইসলাম শাহীন কি হয়েছে জানতে চাইলে হেদায়েত বাড়িতে ডাকাত পড়েছে বলে পালিয়ে যায়।
এলাকাবাসী জানায়, হেদায়েত হোসেন ইসলামী ফাউন্ডেশনের মাঠকর্মী হিসেবে বাগেরহাটে কর্মরত থাকলেও বেশির ভাগ সময় থাকত চাচা জালাল উদ্দিন মোল্লার সঙ্গে। কখনো গানম্যান, কখনো ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবেই সবাই তাকে জানতো। এ বাড়িতে তার যাতায়াত ছিল নিয়মিত।
পরিবার সূত্র জানায়, মোল্লা জালাল উদ্দিনের বাড়িতে লিপির মামা ডা. হাসান ভাড়া থাকতেন। সেই সুবাদে মামার বাসায় বেড়াতে আসতেন লিপি। এ থেকে পরিচয় হয় মোল্লা জালাল উদ্দিনের বড় ছেলে কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী হেলালের সঙ্গে। এখানেই উভয়ের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯৯৯ সালে লিপির সঙ্গে হেলালের বিয়ে হয়। এরমধ্যে তাদের ঘরে একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে।
সর্বশেষ হেলাল তার মাকে নিয়ে এ বছর হজ্ব পালনের জন্য সৌদি আরবে আছেন। বুধবার রাতেই সুরতহাল রিপোর্ট তৈরির পর নিহত লিপির লাশ ময়নাতদন্তের জন্য খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়।
গতকাল লাশের ময়নাতদন্ত শেষে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হিমাগারে রাখা হয়েছে। আজ শুক্রবার নিহতের স্বামী কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী হেলাল ও শাশুড়ি ফাতেমা বেগম হজ্ব পালন শেষে খুলনায় আসার পর দিঘলিয়া উপজেলার মোল্লাডাঙ্গায় জানাজা শেষে দাফন করা হবে বলে পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে।
নিহতের বাড়িতে গেলে ঘটনার সময় উপস্থিত লিপির ছোট বোন আঁখি সাংবাদিকদের বলেন, হেদায়েত প্রথমে তার মুন্না ভাবির দিকে শর্টগান তাক করে বলে গুলি করবো। তখন ভাবি বলে, ‘এটা সরাও আমার ভয় লাগে।’ এরপর আমার দিকে তাক করলে আমি বলি, ‘মারো আমি মরলে কাঁদার কেউ নেই।’ এরপরই আপার (লিপি) দিকে তাক করে ট্রিগার চাপ দেয়। মুহূর্তের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়।
নিহতের শশুর খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি ও সাবেক এমপি মোল্লা জালাল উদ্দিন বেলা সাড়ে ১২টায় খুলনা সদর থানার মামলা করেন। এতে তিনি দুর্ঘটনাবশত ভাইপো হেদায়েত হোসেন শর্টগানটি নিয়ে নাড়াচাড়া করার সময় গুলি বের হয়ে যায় বলে উল্লেখ করেন।
গুলিটি পুত্রবধূ লিপির মাথায় বিদ্ধ হলে সে ঘটনাস্থলেই মারা যাওয়ার ঘটনা উল্লেখ করলেও এর আগে সাংবাদিকদের কাছে তিনি বলেন, শর্টগানটি তার পুত্রবধূ লিপি নিজ হাতে পরিষ্কার করছিল। এসময় গুলি বের হয়ে তার মাথায় বিদ্ধ হলে সে মারা যায়।
তিনি বলেন, ঘটনার সময় একই বাড়ির তিনতলায় তিনি উপস্থিত ছিলেন। গুলির শব্দ পেয়ে তিনি পাঁচতলায় গিয়ে লিপিকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পান। ঘটনার সময় লিপির একমাত্র ছেলে রাফসান পাশের রুমে স্যারের কা
ছে পড়ছিল। তিনি বলেন, আমার বাড়িতে হেদায়েত হোসেনের যাতায়াত ছিল স্বাভাবিক। আমার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তার ছিল সুসম্পর্ক। এদিকে সাংবাদিকদের কাছে নিহতের বড় ভাই আসাদুজ্জামান মিলন কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, একটি হত্যাকাণ্ডকে ধাপাচাপা দেয়ার জন্য দুর্ঘটনা বলে প্রচার করা হচ্ছে।
দুর্ঘটনাই যদি হয়, তবে হেদায়েত হোসেন পালিয়ে যাবার সময় বিদ্যুতের মেইন সুইচ কেন অফ করলো এবং কলাপসিবল গেট বন্ধ করে গেল। নিহত লিপির চাচা বোরহান উদ্দিন বলেন, ঘটনার সঠিক তদন্ত হলে হত্যাকাণ্ডের রহস্য বেরিয়ে আসবে।
খুলনা সদর থানার ওসি সুকুমার বিশ্বাস বলেন, এ ঘটনায় নিহতের শ্বশুর মোল্লা জালাল উদ্দিন বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেছেন। মামলা নং-১৫ তারিখ ৮-১০-১৫। এ মামলায় এসআই জহিরুল ইসলামকে তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ঘাতক হেদায়েতকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) মোল্লা জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, প্রাথমিকভাবে জানা গেছে সাবেক এমপি মোল্লা জালাল উদ্দিনের ভাইপো নিহত লিপির দেবর মাওলানা হেদায়েত হোসেন রসিকতা করতে গিয়ে গুলি করেন। ওই গুলিতে লিপি মারা যান।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার নিবাস চন্দ্র মাঝি জানান, যে শর্টগান থেকে এমপির পুত্রবধূকে গুলি করা হয়েছে সেটি জব্দ করা হয়েছে। এ অস্ত্রটির লাইসেন্স এমপিপুত্র কামালউদ্দিন হেলালের নামে। এদিকে ঘটনার পর সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে গেলে সাবেক এমপি মোল্লা জালালউদ্দিন ও তার ছোট ছেলে নূর আলম সিদ্দিকী মুন্না বিরক্তি প্রকাশ করেন। সাংবাদিকরা নিহতের ছবি ও ব্যবহৃত মোবাইল ফোন দেখতে চাইলে মোল্লা জালাল উদ্দিন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।
একপর্যায়ে তারা বলেন, আর কত ছবি তুলবেন আর কত প্রশ্ন করবেন? এ ঘটনায় মোল্লা জালালউদ্দিনের পরিবারের রহস্যজনক ভূমিকা নিয়ে নগরীতে নানা গুঞ্জন সৃষ্টি হয়েছে।