ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ অবশেষে প্রবাসী বংলাদেশীদের দীর্ঘ দিনের দাবী পুরন হতে চলেছে।বিদেশে অবস্থানরত প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশীকে ভোটার করা ও জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার উদ্যোগ হাতে নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বিশ্বের ১৫৭টিরও বেশি দেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশীরা এর আওতায় আসবেন।
জানা গেছে , সরকারের সহযোগিতায় বিদেশে বাংলাদেশী দূতাবাসগুলোতে চলবে নিবন্ধন কার্যক্রম। এজন্য ভোটার নিবন্ধন আইনেও প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার কাজ শুরু করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে হালনাগাদের মতো করে টেকনিক্যাল টিম পাঠিয়ে এ কাজ সম্পন্ন করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে কমিশন।
অবশেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নির্দেশে জরুরি ভিত্তিতে কমিশন সভায় উপস্থাপনের জন্য কার্যপত্র তৈরি করা হচ্ছে বলে ইসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসে অবস্থানকারী বাংলাদেশীদের বিভিন্ন সংগঠনের দাবির পর প্রবাসীদের কথা চিন্তা করে এমন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে ইসি। এছাড়া বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোর অনুরোধে জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এজন্য সিইসির নির্দেশে ৫ অক্টোবর জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালককে বিষয়টি কমিশন বৈঠকে জরুরি ভিত্তিতে উপস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় কার্যপত্র উপস্থাপন ও ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে।
ইসির সিনিয়র সহকারী সচিব মাহফুজা আক্তার স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত একটি চিঠি বিস্তারিত ফাইলসহ জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালককে পাঠানো হয়েছে।
প্রবাসীদের পরিচয়পত্র দেয়া সংক্রান্ত ফাইলের নোটে ইসির অতিরিক্ত সচিব মোঃ মোখলেসুর রহমান লিখেছেন, বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসের মাধ্যমে এনআইডি কার্ড প্রদানের জন্য অনুরোধ পাওয়া যাচ্ছে। বেশ কয়েকটি দূতাবাসের কর্মকর্তারাও এ বিষয়ে অনুরোধ জানিয়েছেন। এজন্য তিনি তার নোটে বিদ্যমান ভোটার নিবন্ধন আইন সংশোধনসহ বেশকিছু প্রস্তাব তুলে ধরেন।
তাতে বলা হয়েছে, বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি কিছুটা শিথিল করে ভোটার নিবন্ধন আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা যেতে পারে। এনআইডি শাখার অনলাইনে শুধু প্রবাসীদের জন্য অনলাইনে বায়োমেট্রিক সংগ্রহের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ছোট ছোট দল পাঠিয়ে বিভিন্ন দেশে হালনাগাদের মতো কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। এছাড়া এ সংক্রান্ত বিস্তারিত কার্যপত্র কমিশন বৈঠকে উপস্থাপনের জন্য এনআইডি শাখাকে দেয়ার কথা বলেছেন।
পরে এই নোটে সম্মতি দিয়ে এনআইডি শাখাকে দ্রুত কার্যপত্র দেয়ার নির্দেশ দেন ইসি সচিব মোঃ সিরাজুল ইসলাম। এ সংক্রান্ত ফাইলে ইসির সংশ্লিষ্ট শাখার উপসচিব মুহাম্মদ আবদুল ওদুদ লিখেছেন, শুধু আইন সংশোধন করেই বিদেশে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের বিষয়টি নিষ্পন্ন করা যাবে না। বিদেশে এনআইডি ইস্যু করতে কী ধরনের সাপোর্ট লাগবে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
এছাড়া তিনি এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ইসির ফাইলটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ফাইলটিতে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে পাসপোর্ট ইস্যু করা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য কমিশন বৈঠকের জন্য উপস্থাপন করা হচ্ছে। পাশাপাশি প্রবাসী বাঙালি কল্যাণ সমিতির প্রবাসে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের এনআইডি প্রদানের বিভিন্ন দাবিও যুক্ত করা হয়েছে।
কমিশন বৈঠকে উপস্থাপনের জন্য ফাইলটিতে বলা হয়েছে, বর্তমানে প্রায় এক কোটি প্রবাসী বাংলাদেশী ভোটার তালিকা ও জাতীয় নির্বাচনের প্রক্রিয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। এজন্য বিষয়টি বিবেচনার জন্য ভোটার তালিকা ও জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন সম্পর্কিত সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিমালা পর্যালোচনা করতে বৈঠকে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
জানা যায়, বর্তমানে বিশ্বের ১৫৭টিরও বেশি দেশে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশী নাগরিক অবস্থান করছেন। দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে পরিচিত প্রবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবি প্রবাসে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান ও জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। সেজন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা নিয়ে নির্বাচন কমিশন প্রবাসী বাংলাদেশীদের ভোটার করার পরিকল্পনা নিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স জাতীয় প্রবৃদ্ধির ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ অবদান রেখে চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ এক হাজার ৫৩১ কোটি মার্কিন ডলার। এটি আমাদের জাতীয় বাজেটের প্রায় অর্ধেকের সমান। নাগরিক হিসেবে প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখলেও জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় তাদের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক অধিকার 'ভোটাধিকার' প্রয়োগ করতে পারছেন না।
পাশাপাশি দেশের নাগরিক সেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। এদিকে, ১৯৯৮ সালে দেশের উচ্চ আদালত প্রবাসী বাংলাদেশীদের ভোটাধিকার সংবিধান স্বীকৃত বলে ঘোষণা দিলেও দীর্ঘ ১৭ বছরে তাদের সে অধিকার বাস্তবায়ন করা হয়নি। ২০১৩ সালের ২৬ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে জানিয়েছিলেন, প্রবাসী বাংলাদেশীরা যাতে বিদেশে বসেই ভোট দিতে পারেন সেজন্য আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগামীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় প্রবাসী ভোটাররা যাতে বিদেশ থেকেই ভোট দিতে পারেন সে লক্ষ্যে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)-১৯৭২ সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হাফিজ বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশীরা এদেশেরই নাগরিক। তারা যে কোনো সময় দেশে এসে এনআইডি কার্ড সংগ্রহ করতে পারেন। সম্প্রতি বিষয়টি আরও সহজ করার চিন্তাভাবনা করছে কমিশন; যাতে সহজে তারা এনআইডি কার্ড পেতে পারেন।
এ কাজের সঙ্গে সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও জড়িত। সেজন্য প্রবাসে ভোটার তালিকায় নাম নিবন্ধন করতে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন বলে জানান তিনি। ইসি কর্মকর্তারা জানান, বিপুলসংখ্যক প্রবাসীকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে ২০০৯ সালে নির্বাচন বিধিমালায় সংশোধনী আনে নির্বাচন কমিশন। সংসদে আইন পাস হয়। ওই বছরের ২০ ডিসেম্বর প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের আইনে সম্মতি দিয়ে স্বাক্ষর করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুুর রহমান।
সে সময় ইসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এখন থেকে সব নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন প্রবাসীরা। কিন্তু এরপর আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে 'অ্যাবসেন্টি ব্যালট সিস্টেম' চালু আছে।
যেমন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকেই ভোট দিতে পারেন। অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকরা যদি ভোট না দেন সেক্ষেত্রে তাদের জরিমানা করার ব্যবস্থা আছে। প্রবাসী জাপানি নাগরিকরাও ভোট দিতে পারেন। কানাডার নাগরিক যারা স্বল্পকালীন অথবা দীর্ঘকালীন সময়ের জন্য কানাডার বাইরে আছেন তাদের জন্য রয়েছে মেইলিং পোলিং সিস্টেম; আর যারা ভোটদানের নির্ধারিত তারিখের আগেই কানাডা ছাড়বেন, তাদের জন্য রয়েছে অ্যাডভান্স পোলিং সিস্টেম।
বিশ্বের অন্যতম রেমিট্যান্স গ্রহণকারী দেশ ফিলিপাইনও তার প্রবাসী নাগরিকদের জন্য ভোটের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। হংকং, থাইল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুরেও আছে অপটিক্যাল স্ক্যানিং ভোটিং সিস্টেম।
এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বর্তমান ডিজিটাল যুগে প্রবাসীদের এই অধিকার পূরণ অনেক বড় কিছু নয়, কেবল প্রয়োজন সদিচ্ছা ও যথাযথ পদক্ষেপ। তিনি বলেন, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আন্তরিক হলে দ্রুতই প্রবাসীদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যাবে।