ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ আবার বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছে জনগনের ম্যান্টেট বিহীন আওয়ামী লীগ । বিএনপির সম্ভাব্য কাউন্সিলে বাধা দেওয়া নয়তো এটির আকার ছোট করতে বাধ্য করার মতো কূট কৌশল এঁটে দলটিকে চাপে রাখতে নানামুখী কৌশল অবলম্বন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অধীনে থাকা একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দাসংস্থার সূত্রে বিরোধীজোট সম্পর্কে সরকারের এ পরিকল্পনার বিষয়টি জানা গেছে। ওই পরিকল্পনায় আরও রয়েছে, বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার ও মামলা বাড়ানো, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম আরও জোরদার করা এবং স্থানীয় সরকারের নির্বাচন আয়োজন করার মতো বিষয়ও।
এর মধ্য দিয়ে বিএনপির দল গোছানোর কার্যক্রমকে স্থবির করে দেওয়াসহ আগামী দিনে দলটির জোটগত আন্দোলনকেও প্রভাবিত করতে চায় সরকার।
পাশাপাশি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদেরকে মামলার জালে রেখে নির্বাচন থেকে দূরে রাখাও সরকারের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, বিএনপিকে চাপে রাখতে সম্প্রতি দুই বিদেশি খুনের ঘটনাকে কাজে লাগাতে চায় সরকার। এ কারণে বিএনপি-জামায়াতের যেসব নেতার নামে মামলা রয়েছে তাদের প্রত্যেককেই গ্রেফতারের নির্দেশ রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর তরফে।
সূত্রের দাবি, প্রধানমন্ত্রী কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন দুটি বিদেশি হত্যাকান্ডের ঘটনায় যুক্তদের গ্রেফতার করতে। যদিও গোয়েন্দাদের কাছে এসংক্রান্ত কোনও ফুটেজ বা সূত্র নেই তারপরও সরকারের শীর্ষমহলের নির্দেশনা অনুযায়ী আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।
সূত্র জানায়, গোয়েন্দারা ধারণা করছে, দুই বিদেশি নাগরিককে হত্যার মধ্য দিয়ে কোন পক্ষ বেশি লাভবান হয়েছে, সেটি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিদেশি কোনও পক্ষ জড়িত থাকলেও খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে বাংলাদেশি নাগরিকেরাই। ফলে, ধারণার জায়গা থেকে খুনের সঙ্গে জড়িতদের পাকড়াও করতে অনেকটা ব্যাপকহারে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে।
বিএনপি ও জামায়াতের বিগত দুই সপ্তাহে প্রায় দেড় হাজারের বেশি নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে বলে দল দুটির নির্ভরযোগ্য পক্ষ জানায়। সরকারের তরফেও বিদেশি হত্যাকান্ডের জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করা হয়েছে। যদিও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান এর নিন্দা জানিয়েছেন।
তারা বলেছেন, সরকারের উচিৎ তদন্ত করা। প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও।
বিএনপির একান্তজন বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের দায়িত্বশীলেরা যেভাবে বিদেশি খুনের বিষয়ে বিএনপিকে জড়াচ্ছেন, তাতে পরিষ্কার এর উদ্দেশ্য হচ্ছে দলটির নেতা-কর্মীদের আন্দোলন থেকে সরানো, এবং দল গোছানোর কার্যক্রম থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া। কিন্তু, এগুলো একটি সুষ্ঠু সমাজে আকাক্সিক্ষত না। জানা গেছে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে কেন্দ্রীয় কাউন্সিল করার সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে বিএনপির।
এ লক্ষ্যে দলের সারাদেশের সবগুলো কমিটি গঠন, দলের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব নির্বাচন করার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জেলা পর্যায়ে সবগুলো কমিটি করার পূর্বনির্দেশ থাকলেও সেটির সময়সীমা আবার বাড়ানো হয়েছে।
খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে দেশে ফিরলেই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। তবে বিএনপির মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান অভিযোগ করেছেন, সারাদেশের কমিটি গঠনেই সরকার বাধা দিয়েছে। গোয়েন্দাসূত্রের তথ্য, জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েও বিএনপির কমিটি গঠনে বাধা দিতে কৌশল করছে সরকার। এজন্য তৃণমূল আওয়ামী লীগের কৌশলী নেতারা কাজ করছেন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বিএনপির কাউন্সিলে ১৪৪ ধারা জারির ঘটনা ঘটেছে।
এর পেছনে এই নেতাদের ভূমিকা আছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন গোয়েন্দারা। সূত্র জানায়, বিএনপির সংগঠন গোছানো ও আগামী দিনের আন্দোলনকে সামলাতে নিখুঁত প্ল্যান করা হয়েছে। এ প্ল্যানের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রাধিকার পেয়েছে কাউন্সিল সংকোচন করা বা কাউন্সিল ঘিরে দলের বিবদমান দ্বন্দ্বকে চাঙ্গা করা এবং কাউন্সিল বাতিল করা।
খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা শামসুজ্জামান খান দুদু এ বিষয়ে মন্তব্য করেন,’সরকার তো একাই রাজনীতি করতে চায়। প্রধানমন্ত্রী একাই রাজনীতি করতে চান। আমাদের তো রাজনীতি দূরের কথা, কাউন্সিলই করতে দিচ্ছেন না। স্থানীয় পর্যায়েও নানা বিপত্তি তৈরি করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে রাজনীতি দরকার। নির্বাচন দরকার। এর কোনটিই করতে দিচ্ছে না সরকার।
সূত্র আরও জানায়, বিএনপিকে চাপে রাখতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে আরও সক্রিয় করবে সরকার। ইতোমধ্যে দলটির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যু পরোয়ানা কারাগারে পৌঁছেছে। সাকা চৌধুরীর রায় কার্যকরে সরকারের উপরমহল ঐকমত্যেও পৌঁছেছেন।
যতো দ্রুত সম্ভব আইনি প্রক্রিয়া রক্ষা করে ট্রাইব্যুনালের রায় কার্যকর করবে সরকার। গোয়েন্দা সূত্রটির দাবি, বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতাকারীদের মধ্যে অন্যতম সাকা চৌধুরী। তার রায় কার্যকর হলে পাশ্ববর্তী দেশের সহমর্মিতাও জুটবে। এতে করে বিএনপিকে নতুন করে যুদ্ধাপরাধী ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বিষয়ে অনেকটাই কাজে লাগানো যাবে। এর আগের জাতিসংঘের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হচ্ছে। সূত্রটির দাবি, সাকা চৌধুরীর রায় বাধাহীনভাবে কার্যকর করতে তার ছেলেকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশের একটি সংস্থা জানিয়েছে, সাকার ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীর সঙ্গে বিদেশি কয়েকটি রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগের প্রমাণ তারা পেয়েছে। ওই প্রমাণগুলোয় ভিন্ন রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের সরাসরি ইঙ্গিত পেয়েছে তারা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিষয়ে আইনি লড়াই চলছে। এটি আইনের পথেই সমাধান হওয়া ভাল।
এর বেশি মন্তব্য করা সমীচিন নয় বলেও জানান তিনি। জানা যায়, বিএনপির সাংগঠনিক কর্মকা- ও আন্দোলনকে দমাতে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনকেও কাজে লাগাবে সরকার। ইতোমধ্যে পৌরসভা নির্বাচন করার ঘোষণা এসেছে। ইসি জানিয়েছে, এই নির্বাচন দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হবে। পাশাপাশি ইসিতে স্থগিত থাকা নিবন্ধনের জন্য এই নির্বাচন থেকে বাদ পড়বে জামায়াতে ইসলামী। বিএনপি দাবি করেছে, পৌরসভা নির্বাচন সরকারের নীলনকশা।
দলটির মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, সরকার আগামী ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা জাতীয় নির্বাচনের দাবিকে পাশ কাটানোর একটি ‘নীলনকশা’ ও ষড়যন্ত্র। দলীয় পরিচয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার আইন প্রণয়নে সরকারি উদ্যোগের বিরোধিতা করেন তিনি। এর আগে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা ও পরামর্শের দাবিও জানান রিপন। যদিও এ ব্যাপারে জামায়াত এ রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত দলীয় কোনও অবস্থান ব্যক্ত করেনি।
এসব বিষয়ে কথা হয় বিএনপির সিনিয়র নেতা স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের সঙ্গে। তিনি বলেন, একটি রাজনৈতিক দলের কাজ হচ্ছে কর্মসূচি দেওয়া। আন্দোলন করা। বিএনপি আন্দোলনে যাবেই। এক্ষেত্রে সরকারের বাধা আসবে। তবে বাধা দিলেই তো আর সব কিছু থেমে থাকবে না। বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল। তার নীতিতে দলীয় কর্মসূচি আসবে।
সাবেক এই স্পিকার মনে করেন, বিএনপি একটি বড় দল। জনগণের দল। আর সরকার জনগণকে ভয় পায়। এজন্যই নানা চেষ্টা করবে, ষড়যন্ত্র করবে। আমরা গণতান্ত্রিক পথেই সব বাধা পেরোবো। এদিকে মামলা দিয়ে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদেরকে আগামী নির্বাচন থেকে বাইরে রাখার পরিকল্পনা আছে সরকারের। বিএনপির দফতরের সূত্র মতে, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে ১৫৮ জন কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। এই মামলার সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার হাজার। ইতোমধ্যে অনেক মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। বাকিগুলোর কাজেও গতি বাড়ানো হয়েছে।
বিএনপি মনে করে, আগামী নির্বাচনে এসব নেতা যাতে অংশ নিতে না পারে সেজন্য তাদের মামলঅর রায়ের মাধ্যমে অযোগ্য ঘোষণা করা হবে। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন মনে করেন, এসব মামলা পুরো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তবে এসব মামলার রায়কে কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসবে, এটা ভাবলে ভুল হবে।
সরকারের এমন তৎপরতার বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, সরকার কেন বিএনপিকে চাপে রাখবে? পেট্রোল বোমা হামলায় এত মানুষ মারা যাওয়ার পরও তারা বলেছে, চাপে রাখতেই বিচার করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের এই নেতা মনে করেন, দুই বিদেশি নাগরিক হত্যায় কোনও পারিবারিক বা ব্যক্তিগত কারণ পাওয়া যায়নি। হত্যাকান্ড দুটি ছিনতাই সম্পর্কিতও নয়। তার মানে এর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। সারাদেশ যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব মেনে এগিয়ে যাচ্ছে, গোটা বিশ্ব বাংলাদেশের অগ্রগতিকে প্রশংসা করছেন, প্রধানমন্ত্রীকে পুরস্কৃত করছেন–তখনই দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য তারা উঠে পড়ে লেগেছে।
মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন,’খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের মামলা চলছে। তারা যুদ্ধাপরাধের বিচার কাজ বাধাগ্রস্ত করতে চায়। ২০১২ সালেও তারা এমনটি করেছে। ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে তিন মাসব্যাপী পেট্রোল বোমা হামলা চালিয়েছে সরকার উৎখাতের জন্য। তারা সরকারের পতন ঘটাতে চায়। তাদের ওই অপতৎপরতা ব্যর্থ হওয়ায় এখন তারা বিদেশি হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা নিতেই পারে।