ক্যাপ্টেন(অবঃ)মারুফ রাজুঃ গুলশানে মদ্যপ অবস্থায় বেপরোয়া কার রেসিং -এর দূর্ঘটনায় শিশু মৃত্যুর ঘটনায় গাড়িচালক সাবেক আওয়ামী এমপি এইচবিএম ইকবালের ভাতিজা ফারিজ আহমেদকে (১৬) বাঁচাতে এক হয়েছে বিআরটিএ ও পুলিশ। প্রিমিয়ার ব্যাংক সহ বিশাল বানিজ্য নেটওয়ার্কের অধিপতি এই ইকবাল পরিবারের হাত যে কত বড় তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।
দূর্ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ নিজে এই ফারিজকে উদ্ধার করে মোটরসাইকেলে করে নিয়ে গেলেও এখন তা তারা সম্পূর্ন অস্বিকার করছে।এই সংক্রান্ত ছবিও আমাদের কাছে রয়েছে ।
এই ঘটনার দুইদিন পরও মামলা তো হয়ইনি বরং এ বিষয়ে কেউ মুখ খুলতেও রাজি না। মঙ্গলবার গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম বলেন, এ দুর্ঘটনায় এক শিশু নিহত হয়েছে এবং আমরা গাড়িটিকে আটক করেছি। মালিককে খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। গাড়িটি এমপি ইকবালের ভাতিজা নিজেই চালাচ্ছিলো বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
যদিও বুধবার থানায় গিয়ে দেখা যায় ঘটনা উল্টে গেছে। সবাই এমন আচরণ করছেন যেন এই ঘটনা জানেন না, এমনকি আটক করা গাড়িটি থানার বাইরে সযত্নে ঢেকে রাখা হয়েছে। কিন্তু ওই দিনের কাছাকাছি সময়ে এক মিনিবাসের ধাক্কায় এক শিশু নিহত হওয়ার ঘটনায় মামলা হয়েছে (মামলা নম্বর ১০), যার ঘটনার বিবরণীতে রয়েছে নানা অসঙ্গতি।
এদিকে বুধবার সকালে বিআরটিএ অফিসে গিয়ে দেখা যায়, ইতোমধ্যে গাড়ির মালিকের নাম মুছে ফেলা হয়েছে। কম্পিউটারে গাড়ির নম্বর (ঢাকা মেট্রো ঘ ১১৮৯৭৬) সার্চ দিলে মালিকের নাম আসে না, আসে শুধু চেসিস নম্বর। কীভাবে গাড়ির নম্বর উল্লেখ থাকার পরও বিআরটিএ-এর ডাটায় (সংরক্ষিত তথ্য) গাড়ির মালিকের নাম নেই জানতে চাইলে বিআরটিএ’র একাধিক কর্মকর্তা বলেন- এটা কোনওভাবেই সম্ভব না। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (এনর্ফোসমেন্ট) বলেন, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন থাকলে অবশ্যই সিস্টেমে মালিকের নাম থাকবে।
তবে তিনি ইঞ্জিনিয়ার সেকশনে কথা বলার পরামর্শ দিলে উপ- পরিচালক (প্রকৌশল) নুরুল ইসলাম বিস্তারিত জেনে বলেন, গাড়িটির মালিক এইচবিএম জাহিদুর রহমান মৃত জিল্লুর রহমানের ছেলে। কিন্তু সিস্টেমে কেন দেখাচ্ছে না সেটা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
তবে পুলিশ সূত্রেও জানা গেছে, গাড়িটির মালিক এইচবিএম জাহিদুর রহমান। চালকের সিটে থাকা ফারিজ এইচবিএম জাহিদুর রহমানের ছেলে। জাহিদুর রহমানের ভাই এইচবিএম ইকবাল ১৯৯৬ সালে ঢাকার রমনা-তেজগাঁও আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন।
প্রভাবশালী এই নেতার ভাজিতা হওয়ায় ফারিজের বিরুদ্ধে এখনও কোনও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে সূত্র জানিয়েছে। তবে এমপি ইকবালকে একাধিকবার মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি। ঘটনা স্পষ্ট, কমবেশি থানার সবাই বিষয়টি ‘অফ দ্য রেকর্ডে’ বলতে চাইলেও বুধবার সকাল দশটায় গুলশান থানায় গিয়ে ১২ অক্টোবরের ৭৪ নম্বর রোডের দুর্ঘটনার কথা জানতে চাইলে সবাই এমন আচরণ করেন যেন এই ঘটনা তারা প্রথম শুনলেন।
প্রতিবেদককে এ টেবিল থেকে সে টেবিলে পাঠানোর পর ডিউটি অফিসার আফরোজা বলেন, আমরা এমন কোনও দুর্ঘটনার বিষয়ে জানি না। গাড়িটি আটকের বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছিলেন বলা হলেও আর কেউই কোনও কথা বলতে চান না। ৭৪ নম্বর সড়কে দুর্ঘটনার দিনই আরেকটি সড়ক দুর্ঘটনায় একটি দেড় বছরের শিশু নিহত হয়েছে।
মামলার কাগজে (মামলা নং-১০) ঘটনার বিবরণীতে বলা আছে- বিকেল পৌনে ৬টার সময় শাহজাহানপুরে একটি মিনিবাস (ঢাকা মেট্রো ঝ ১১-০৬৪৭) এর ধাক্কায় নিহত হয়েছে এক শিশু। তবে সাত্তার নামের যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তার ফোন নম্বরের জায়গায় দশ ডিজিটের একটি নম্বর লেখা আছে (০১৯৪৮৩৩৬১৬), ফলে তার সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে, গত সোমবার বিকেল পৌনে চারটার দিকে ঢাকার গুলশানের ৭৪নং সড়কে দুই বন্ধুর কার রেসিং-এর সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে রিকশায় মায়ের কোলে থাকা আনুমানিক তিন- চার বছরের এক শিশু নিহত হয়।
ঘটনা গত সোমবার পৌনে চারটায় হলেও ঘটনাটি জনসম্মুখে একেবারেই সামনে আসেনি। পরে সামনে এলেও পুলিশ এখন বলছে ৭৪ নম্বর সড়কের ঘটনায় কোনও শিশু মারা যায়নি, প্রায় একই সময়ে ঘটা এটা অন্য আরেকটা দুর্ঘটনা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, থানার গেট সংলগ্ন রাস্তায় ইকবালের ভাতিজাচালিত গাড়িটি যত্নে ঢেকে রাখা আছে। এমনিতে দেখলে বুঝা যাবে না এটি কোনও দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ি। পরে গাড়িটির কাভার তুলে দেখা গেছে দুর্ঘটনার পর তোলা ছবির গাড়ি আর এই গাড়ি একই।
কর্তব্যরত কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা শুধু জানেন- দুর্ঘটনা হয়েছে তবে কোথায় কি হয়েছে সে বিষয়ে বলতে পারবেন না বলে জানান। বিআরটিএ-তে একটি গাড়ির নম্বর থাকলেও তার মালিকের নাম না থাকাটা একেবারেই সরল বিষয় না বলে উল্লেখ করেছেন গুলশান এলাকার এক সার্জেন্ট। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, সাধারণত কোনও অপরাধ ঘটলে এরকম মালিকের নাম মুছে ফেলার রেওয়াজ আছে। এই নম্বরের গাড়িটি থানায় আটক আছে জানানো হলে সেই সার্জেন্ট বলেন, সেক্ষেত্রে মালিক গাড়ি ফেলে চলে গেছে এমনতো না। থানার বিষয়টি জানা থাকারই কথা। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই সোমবার বিকালে রাজধানীর অভিজাত এলাকার ব্যস্ত সড়কে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলেন ওই কিশোর। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী লাইসেন্স পেতে ১৮ বছর বয়স হতে হয়।
গুলশান থানার একজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ওই ছেলে মদ্যপ অবস্থায় ছিল। গুলশানের ৭৪ নম্বর সড়ক দিয়ে বেপরোয়া চালানোর সময় দুটি রিকশাকে ধাক্কা দেয়। রিকশা দুইটা একেবারে উল্টে ভেঙে গেছে। তবে নিহতের বিষয়ে কিছু জানি না। যদিও গতরাতে (মঙ্গলবার) ফারিজ তার স্ন্যাপচ্যাটে লিখেছেন, ‘গোইং টু দ্যা পুলিশ স্টেশন উইথ ড্যাড।’
তারপরও থানার কেউ এ বিষয়ে কোনও কথা বলতে রাজি হননি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন পোস্টে ফারিজ রহমান-এর বন্ধুদের বরাত দিয়ে বলা হয়, সোমবার গাড়ি চালাতে চালাতে মোবাইলে তাদের রেসিং-এর ভিডিও করছিলো ফারিজ এবং দুর্ঘটনার একটু আগে তার সেলফি তুলে ফটোমেসেজিং স্ন্যাপচ্যাটে দিতে দেখা গেছে।
ফারিজের ফেসবুক পেজে তার পরিচয় হিসেবে বিএমডব্লিউ-এর এমডি এবং মেম্বার অব পার্লামেন্ট লেখাও দেখা গেছে। ঘটনার ৩০ মিনিট আগে সে গাড়ি চালানো অবস্থায় সেলফি দিয়েছে বলে বন্ধুসূত্রে জানা গেছে।
গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম বলেন, সোমবার বিকাল পৌনে চারটার দিকে এই দুর্ঘটনা ঘটে। আমরা এই গাড়ি আটক করেছি। গাড়ির মালিককে আটকের চেষ্টা চলছে।