ক্যাপ্টেন (অবঃ) মারুফ রাজুঃ বাংলাদেশে এখন সরকারী সনদ প্রাপ্ত ফেরেশতার(?) সংখ্যা মাত্র ২৩ হাজার । এক অর্থে দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিবাজদের সনদ দিয়ে সৎ এবং পরিষ্কার মানুষের লেবাস দিয়েছে দূর্নীতি দমনে গঠিত দূর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ।এর চেয়ে লজ্জাজনক এবং হাস্যকর আর কি হতে পারে ?
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনের লম্বা হাত স্পর্শ করতে পারেনি প্রায় ২৩ হাজার আওয়ামী লীগ সমর্থক চরম দুর্নীতিবাজ প্রভাবশালীকে। গত আট বছরে দূর্নীতির শিরোমনী এসব প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ পড়েলেও শেষ পর্যন্ত তাদের দায়মুক্তি সনদ বা ফেরেসতার সার্টিফিকেট দিয়েছে দুদক।
কিন্তু অনুসন্ধান পর্যায়ে নথিভুক্ত (মামলার জন্য উপযুক্ত নয়) এবং মামলা করার পর চূড়ান্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে তাদের দেয়া হয়েছে অব্যাহতিপত্র।
যা সবার কাছে ‘দায়মুক্তি সনদ’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। এই বিশেষ সনদপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যবসায়ী ও সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
মেয়াদের শেষপর্যায়ে বর্তমান কমিশন সংশ্লিষ্টদের ‘দায়মুক্তি সনদ’ দেয়ায় দুদক নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, একের পর এক দায়মুক্তি দিয়ে প্রমাণ করেছে দুদক নিজেই দুর্নীতিগ্রস্ত।
দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে নয়, রাজনীতি দমনে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। যদিও সংশ্লিষ্টদের অব্যাহতি দেয়ার বিষয়ে দুদক দাবি করেছে সবকিছুই বিধি মোতাবেক হয়েছে।
দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেন, বর্তমান কমিশন কখনও রাঘব বোয়ালদের ছাড়েনি, ছাড়বে না। বড় হোক, ছোট হোক, যার বিষয়েই দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায় তাদেরকেই ধরা হয়। যৌক্তিক কারণ ছাড়া কাউকেই ছাড়া হয়নি। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতার সঙ্গে দুদক কার্যক্রম চালাচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত প্রায় আট বছরে (২০০৭ থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত) দুদকে অভিযোগ জমা পড়ে ৩ লাখের বেশি। এর মধ্যে ২১ হাজার ৮৫৪টি অভিযোগের অনুসন্ধান হয়। বাকি ২ লাখ ৭৪ হাজার ১৪৬টি অভিযোগ তফসিলভুক্ত (দুদক আইন বহির্ভূত) না হওয়ায় ফেলে দেয়া হয়।
অনুসন্ধানে প্রাথমিকভাবে অভিযোগের সত্যতা মেলায় ৩,৯৯৮টি মামলা করা হয়। অন্যদিকে অনুসন্ধানে অভিযোগের ‘সত্যতা’ না পাওয়ায় নথিভুক্ত (মামলার জন্য উপযুক্ত নয়) করা হয় ১৭ হাজার ৮৫৬টি অভিযোগ।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, অনুসন্ধান পর্যায়ে নথিভুক্তের মাধ্যমে ১৮,০৩৯ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি দুদকের অব্যাহতিপত্র পেয়েছেন। এর মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন অন্তত ৩ হাজার ২৮, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও ব্যবসায়ী ৬৯৭ জন এবং বিভিন্নভাবে সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি ১৫,০১১ জন। এছাড়া দায়ের করা ১১৩১টি মামলার চার্জশিট হয়। পাশাপাশি অপরাধ ‘প্রমাণিত’ না হওয়ায় ২,৮৬৭টি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের মাধ্যমে ৩০২২ আসামিকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
এর মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৭৬৮ জন এবং সরকারদলীয় নেতাকর্মী ও ব্যবসায়ী রয়েছেন ৮৬১ জন। এছাড়া বাদী-আসামি-সাক্ষীর মৃত্যু হওয়ায় সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে চূড়ান্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে ১৬২৯ জনকে ‘দায়মুক্তি’ দেয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, বর্তমান কমিশন সাড়ে ৪ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছে। আগামী মার্চে তাদের নিয়োগের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। তাদের কার্যকালে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমে কতটা সফল হয়েছেন- এ হিসাব কষছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে, আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার রফিক উল হক বলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন আইনটি নিজেই দুর্নীতিগ্রস্ত। দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে নয়, রাজনীতি দমনে কাজ করছে দুদক। সরকারদলীয় লোকদের দায়মুক্তি দিচ্ছে দুদক। তাদের উদ্দেশ্যের মধ্যেই দুর্নীতি নিহিত।’
এছাড়া ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এ কমিশনের হাতে অনেক সুযোগ ছিল জনমানুষের প্রত্যাশা পূরণের। দুদক আইনের যতটা সমর্থন পেয়েছে বর্তমান কমিশন সেটিও প্রয়োগ করেনি। সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখেনি। বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যানসহ প্রভাবশালীদের নানা যুক্তিতে সুরক্ষা দিয়েছে। তারা প্রধানমন্ত্রীর ম্যান্ডেটও অনুসরণ করেনি। কখনও বা প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে আপিল না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেরাই বিচারকের দায়িত্বে উঠে গেছে। এসবের কারণে বর্তমান কমিশন দুদককে আরও আস্থার সংকটে ফেলেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী, উপদেষ্টা-এমপিদের দায়মুক্তি :
দুর্র্নীতির অভিযোগ থাকলেও পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলা প্রমাণের মূল নথি- ঘুষ বিতরণের তথ্যসংবলিত রমেশের ডায়েরি দুদকের হস্তগত হয়নি। ফলে আলোচিত এ দুর্নীতির ঘটনায় সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসানের কোনো সম্পৃক্ততা পায়নি দুদক।
গতবছর ১৭ সেপ্টেম্বর এ দু’জনসহ ৬ আসামির পক্ষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে দুদক। তৎকালীন অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের নাম পদ্মা সেতু দুর্নীতির অভিযোগের সঙ্গে আলোচিত হলেও অনুসন্ধান পর্যায়ে তাকে অভিযোগ থেকে মুক্ত করা হয়।
২০১২ সালের ৯ এপ্রিল বিজিবি সদর দফতরের সামনে ৭৮ লাখ টাকার বস্তাসহ আটক হন রেলওয়ে (পূর্বাঞ্চল) জিএম ইউসুফ আলী মৃধা। অভিযোগ ওঠে নিয়োগে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত এ অর্থ তৎকালীন রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বাসায় নেয়া হচ্ছিল। এ ঘটনায় দুদক সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে। কিন্তু ঘুষের তথ্য ফাঁসকারী ইউসুফ আলী মৃধার ড্রাইভার মো. আলী আযম প্রকাশ্যে সাক্ষ্য দিতে না আসায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ নথিভুক্ত (মামলার জন্য উপযুক্ত নয়) করে তাকে দায়মুক্তি দেয়া হয়।
তবে রেলওয়েতে নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে ১৩টি মামলা করে দুদক। এসব মামলার প্রধান আসামি জিএম ইউসুফ আলী মৃধাকে চূড়ান্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে অব্যাহতি দেয়া হয়। নির্বাচনী হলফনামায় উল্লেখ করা সম্পদের হিসেবে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি না থাকার অভিযোগে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রূহুল হক ও তার স্ত্রী ইলা হকের বিরুদ্ধে ৭ কোটি ৫৩ লাখ ১১ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদের মামলা করে দুদক।
তদন্তকালে রূহুল হক দাবি করেন তার ব্যক্তিগত আইনজীবী ভুল করে ওই তথ্য হলফনামায় দিয়েছেন। দুদক ওই তথ্য আমলে নিয়ে রূহুল হক, তার স্ত্রী ও পুত্র জিয়াউল হককে দায়মুক্তি দেয়।
জালিয়াতির মাধ্যমে অভিনব পদ্ধতিতে সোনালী ব্যাংক থেকে ২ হাজার ৬শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় হল মার্ক গ্রুপ। ভুয়া এলসি ডকুমেন্টের মাধ্যমে শুধু শেরাটন শাখা থেকেই হাতিয়ে নেয়া হয় ১১শ’ কোটি টাকা। এ অর্থ হাতিয়ে নেয়ার পেছনে বিগত আ’লীগ সরকারের সাবেক স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ থাকলেও মামলায় তাকে আসামি করেনি দুদক। দায়মুক্তি দেয় অনুসন্ধান পর্যায়েই।
ঢাকা মহানগর আ’লীগ নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ২০০৮ সালে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় ১৩ বছর দণ্ডিত হন। তার আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ওই দণ্ডাদেশ বাতিল করেন। বিগত কমিশনের মেয়াদকালে হাইকোর্টের এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে দুদক। কিন্তু বর্তমান কমিশন ওই আপিল চালাবে না মর্মে আবেদন জানায়। যদিও আপিল বিভাগ আবেদনটি গ্রহণ করেনি।
বিগত আ’লীগ সরকারের ধর্ম প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শাহজাহান মিয়া দায়িত্ব পালনকালে ৪০৩টি হজ এজেন্সিকে লাইসেন্স দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে অর্ধশত কোটি টাকার লেনদেন হওয়ার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় সাবেক এ প্রতিমন্ত্রীর এপিএস সৌমেন্দ্র লাল চন্দ শৈলেনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলার জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার সঙ্গে অ্যাডভোকেট শাহজাহান মিয়ার সংশ্লিষ্টতার কথা জানান শৈলেন।
দায়িত্বকালীন ৫ বছরে নানাভাবে প্রতিমন্ত্রীর পুত্র মনির এবং রনিও বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেন বলে তথ্য আসে। দুদক তাদের বিরুদ্ধে কোনো অনুসন্ধান চালায়নি। তবে দুদকের মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাভোগ করেন এপিএস শৈলেন। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ছিল সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে।
গতবছর ৫ ফেব্র“য়ারি তার অবৈধ সম্পদের বিবরণ সংবলিত একটি অভিযোগ কমিশনে জমা পড়ে। কিন্তু কোনো অনুসন্ধানে না দিয়ে বাছাই পর্যায়েই অভিযোগটি বাদ দিয়ে দেয় দুদক।
ধানমণ্ডির ৫, গ্রিনরোডে সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে ঢাকা-৭ আসনের এমপি হাজী মো. সেলিমের বিরুদ্ধে। ‘ক্রয়সূত্রে’ তিনি এ সম্পত্তির মালিক দাবি করে তিনি ‘মদিনা গ্রুপ’-এর প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেন। ২ বছরের বেশি সময় ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে দুদক আগস্টে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয় হাজী মো. সেলিমকে।
সরকারদলীয় এমপি ঢাকার আসলামুল হক ও তার স্ত্রী মাকসুদা হকের বিরুদ্ধে ১৪১ একর জমির মালিক হওয়ার তথ্য মিলে নির্বাচনী হলফনামায়। অনুসন্ধানে তার অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পাওয়ায় মামলা করে দুদক। কিন্তু মামলার তদন্তে অবৈধ সম্পদের ‘প্রমাণ না পাওয়া’য় আসলামুল হক দম্পতিকে দায়মুক্তি দেয় দুদক।
সরকারদলীয় রাজশাহীর এমপি এনামুল হকের বিরুদ্ধে ২১৩ কোটি টাকার অবৈধ অর্জনের প্রমাণ পান দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা। এ অর্থের বৈধ কোনো উৎস না পাওয়ায় এনামুল হকের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিলের সুপারিশ করেন তিনি। কিন্তু কমিশন বিষয়টি ‘রাজস্ব সংক্রান্ত’ বলে যুক্তি দেখিয়ে চার্জশিট অনুমোদন করেনি। পাঠিয়ে দেয় এনবিআরে। দুদক থেকে দায়মুক্তি পান এনামুল হক।
মহানগর আ’লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক দিলীপ রায়ের বিরুদ্ধে ৩০টি হোমিও কলেজে শিক্ষক নিয়োগ, অবৈধ গাড়ি ক্রয়সহ অবৈধ উপায়ে প্রায় শত কোটি টাকা অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করে দুদক। কয়েক মাস অনুসন্ধান শেষে জুনে অভিযোগ নথিভুক্ত করে তাকে ‘দায়মুক্তি’ দেয়া হয়।
দায়মুক্তি পেয়েছেন আওয়ামী ভাবধারার ব্যবসায়ীরা :
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ঐকমত্যের সরকার আমলে পাঠ্যবই মুদ্রণের কাজ পায় বেক্সিমকো গ্র“পের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান শুকতারা পাবলিকেশন্সসহ তিন প্রতিষ্ঠান। তিনটি পৃথক টেন্ডারে প্রায় ২০ কোটি টাকার বই মুদ্রণ করার কথা ছিল প্রতিষ্ঠানগুলোর। কিন্তু যথাসময়ে জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বই সরবরাহ না করেই বিল উত্তোলন করে। পাঠ্যপুস্তক কেলেংকারির বিষয়টি সে সময়কার একটি আলোচিত ঘটনা। এ ঘটনায় বেক্সিমকোর তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ও শুকতারার নির্বাহী ইকবাল আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা করে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো।
মামলায় তাদের বিরুদ্ধে ২ কোটি টাকা আÍসাতের অভিযোগ আনা হয়। মামলাটি দীর্ঘদিন ধরে দুদকের অনিষ্পন্ন শাখায় পড়েছিল। কিন্তু আওয়ামী ঘরানার এ ব্যবসায়ীকে বর্তমান কমিশন গত বছরের মার্চে দায়মুক্তি দেয় মামলাটি নথিভুক্তকরণের মাধ্যমে।
আন্তর্জাতিক মানের জাহাজ নির্মাণে পথিকৃৎ দাবিদার আনন্দ শিপইয়ার্ডের মালিক আবদুল্লাহিল বারীর প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জালিয়াতির মাধ্যমে ১৩শ’ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ ওঠে। অনুসন্ধান শেষে প্রভাবশালী এ ব্যবসায়ীর অভিযোগ নথিভুক্ত করে তাকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
তৎকালীন ওরিয়েন্টাল ব্যাংক (বর্তমানে আইসিবি ইসলামী ব্যাংক) এবং অরিয়ন গ্রুপের চেয়ারমান ওবায়দুল করিমের বিরুদ্ধে গত ৮ বছরে ৭০টিরও বেশি অভিযোগ জমা পড়ে। এসব অভিযোগের অন্যতম হচ্ছে নিজ ব্যাংকে রক্ষিত আমানতকারীদের অর্থ আত্মসাৎ ও পাচার। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে এমন ঘটনার বহু প্রমাণ থাকলেও দুদকের অনুসন্ধানে ওবায়দুল করিম সবসময় থেকে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। সর্বশেষ ব্যাংকটির বংশাল শাখা থেকে ৪৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত বছর ২৩ অক্টোবর মামলা করে দুদক। মামলাটিতে আসামি করা হয় ব্যাংকটির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্টসহ মধ্যম পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তাকে। কিন্তু মামলার পুনঃতদন্তে দেখা গেছে, আত্মসাৎকৃত ওই অর্থের চূড়ান্ত বেনিফিশিয়ারি ওবায়দুল করিম স্বয়ং। তিনি নিজেই নামে-বেনামে অ্যাকাউন্ট খুলে দূরবর্তী অবস্থানে থেকে ওই অর্থ পাচার এবং আত্মসাৎ করেন। ঘটনাটি ধামাচাপা দিতেই মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বলির পাঁঠা বানানো হয়। অকাট্য প্রমাণ সত্ত্বেও দায়মুক্তি দেয়া হয় ওবায়দুল করিমকে।
পুরাতন গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারবিডার সভাপতি হাবিবুল্লাহ ডনের বিরুদ্ধে উত্তরায় জালিয়াতির মাধ্যমে প্লট দখল, সন্দেহজনক লেনদেন এবং রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগের অনুসন্ধান করে দুদক। সম্প্রতি তার অনুসন্ধান নথিভুক্ত করে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
আওয়ামী সমর্থক রকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী :
পেট্রোবাংলার অধীনস্থ ১৩টি প্রতিষ্ঠানে জনবল নিয়োগ, পদোন্নতি, অবৈধ সংযোগ দেয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ পেট্রোবাংলার সাবেক চেয়ারম্যান ড. হোসেন মনসুরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করে দুদক। অনুসন্ধানে অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী গ্যাসফিল্ড কোম্পানি লিমিটেডের জনবল নিয়োগে হোসেন মনসুরের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। কিন্তু দুদক তাকে তদন্তকালে আসামি করা হবে- এ যুক্তিতে তাকে আসামি না করেই মামলা করে। এতে আসামি করা হয় হোসেন মনসুর ছাড়া ৬ কর্মকর্তাকে।
খাস জমির ওপর নকশা অনুমোদন, নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৫৫ কোটি টাকা আত্মসাৎসহ গুরুতর তিনটি অভিযোগে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আব্দুচ ছালামসহ তিন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। মামলার তদন্ত শেষে চলতি বছর জানুয়ারিতে আব্দুচ ছালামসহ তিন প্রকৌশলীকে দায়মুক্তি দেয় দুদক।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নূরুল হুদার দুর্র্নীতির অভিযোগ দুদকে জমা পড়ে ২০১৩ সালে। বিশেষ করে প্লটের আকৃতি পরিবর্তন, ভুয়া নামজারি, নামে-বেনামে একাধিক প্লট গ্রহণের অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। কিন্তু নূরুল হুদা রাজউকের চেয়ারম্যান থাকাকালে কোনো অনুসন্ধান করেনি দুদক।
সরকারের মদদপুষ্ট পুলিশ ও ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী :
বেসিক ব্যাংকের সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা হরিলুটের অভিযোগ অনুসন্ধান করে দুদক। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে এ ঘটনার জন্য দায়ী করা হলেও দুদকের অনুসন্ধানে বাচ্চু এবং পরিচালনা পর্ষদের কোনো সদস্যের সম্পৃক্ততা আপাতত খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই বাচ্চু ও পর্ষদ সদস্যদের বাদ দিয়ে ৫৬টি মামলা করে দুদক।
হলমার্কের ২৬শ’ কোটি টাকা হরিলুটের ঘটনায় দায়ী করা হয়নি ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদকে।
রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফরিদউদ্দিনের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট জালিয়াতির অভিযোগ অনুসন্ধান করে দুদক। অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া সম্পন্ন না করেই অদৃশ্য কারণে অভিযোগ নথিভুক্ত করে দুদক। গত মে মাসে দায়মুক্তি দেয়া হয় তাকে।
সোনালী ব্যাংকের সিবিএর সাধারণ সম্পাদক হাসান খসরুর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। এর স্বপক্ষে বহু তথ্য-প্রমাণ সত্ত্বেও অদৃশ্য কারণে অনুসন্ধান বারবার নথিভুক্ত করে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
এছাড়া দুর্নীতির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার তালিকায় যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন- বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের সাবেক চেয়ারম্যান ইউনুছুর রহমানসহ ৪ কর্মকর্তা, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য (এস্টেট) মোহাম্মদ আজহারুল হক, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ মুসা, পুলিশের ডিআইজি (এসবি) মো. রফিকুল ইসলাম, এসপি মিজানুর রহমান, এসি মনিরুল ইসলাম, শিবলী নোমান, মতলব থানার ওসি মাহবুবুর রহমান সহ আরও অনেকে।