ড.তুহিন মালিকঃ এক : গ্রিক দার্শনিক Diogenes এক সময় হারিকেন লাগিয়ে দিনের বেলায় সৎ মানুষ খুঁজতেন। আমাদেরও বোধহয় এখন দিনের বেলায় হারিকেন দিয়ে সৎ মানুষগুলোকে খুঁজতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আপদমস্তক সৎ, ভদ্র, মার্জিত, সজ্জন হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিতর্কের ঊর্ধ্বের একজন মানুষ। তার চরম শত্র“রাও তাকে মাস্তান বা বোমাবাজ বলে ভাবতে পারবে না।
অথচ যথারীতি সপ্তমবারের মতো তিনি এখন রয়েছেন কারাগারে। তার বিরুদ্ধে মামলার কোনো অভাব নেই। অভিযোগেরও কোনো সীমা নেই। শত শত অজ্ঞাতনামা আসামি দেখিয়ে অসংখ্য এজাহার দায়ের করা আছে অনেক আগেই।
যখন যাকে জেলে ঢোকানো প্রয়োজন, তখন তাকে সেই অজ্ঞাত আসামি বানিয়ে সোজা জেলে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। তাই যথারীতি এবারো পল্টন থানায় কথিত নাশকতার তিন মামলায় তাকে কারাগারে যেতে হলো। এ নিয়ে আওয়ামী সরকারের আমলে ছয় দফায় ৩৩১ দিন কারাভোগ করেন তিনি। সর্বশেষ চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি গ্রেফতার হয়ে ১৮৯ দিন কারাগারে ছিলেন। জটিল রোগের সাথে নিত্যদিন লড়াই করা ৬৮ বছর বয়সের এই সজ্জন, ভদ্র, পরিচ্ছন্ন মানুষটি নাকি বোমা মেরেছেন, গাড়িতে আগুন লাগিয়ে পোড়াতে নির্দেশ দিয়েছেন! মিথ্যারও নিজের একটা চরিত্র আছে। সেটাকেও দেখি এখন হার মানিয়ে দেয়া হলো।
একজন মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে পুরো রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে সরকার তাকে যেভাবে দমন-নিধন করছে তাতে আগামীর বাংলাদেশে সৎ রাজনীতির দুয়ার বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। আসলে সরকার কি চাচ্ছে কারা নির্যাতনের ভয়ে ভদ্র, মার্জিত ও সৎ মানুষেরা রাজনীতি ছেড়ে দিক? নির্যাতন-নিপীড়নের আতঙ্কে সমাজের ভালো মানুষেরা রাজনীতিতে না আসুক?
গুরুতর শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে জেলে জীবন হারানোর ভয়ে পরিবারের চাপে পড়ে এসব ভালো মানুষ রাজনীতিকে বিদায় জানাক? আসলে আওয়ামী লীগ কখনোই চায় না যে, দেশে সুস্থ একটা রাজনীতি ফিরে আসুক আর ভালো মানুষেরা রাজনীতি করুক।
দুই : বিএনপির শাসনামলে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল সরকার পতনের দিনক্ষণ নির্ধারণ করে ট্রাম্পকার্ডের ঘোষণা দিয়ে চরম নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে পুরো দেশকে অস্থিতিশীল করে তুললেও তাকে কিন্তু গ্রেফতার করা হয়নি। কারণ দেশের কোনো প্রধান রাজনৈতিক দলের মহাসচিব বা সাধারণ সম্পাদক পদমর্যাদার কোনো নেতাকে আসামি করে বিরতিহীনভাবে কারাগারে রাখার কোনো নজির কখনো এ দেশের রাজনীতিতে ছিল না।
অথচ মির্জা ফখরুলের বেলায় সরকার সব গণতান্ত্রিক নীতিবোধ উপেক্ষা করে একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসন জিইয়ে রাখার নেশায় এহেন নির্মম নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। হাইকোর্ট যতবার তাকে জামিন দিয়েছেন ততবারই তাকে নতুন মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে একই প্রক্রিয়ায় তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে আটক করে রাখা হচ্ছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের মহাসচিবকে এ ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতনের ঘটনা একেবারেই নজিরবিহীন। এটা সৎ ও ভালো মানুষের রাজনীতির জন্যও অশনি সঙ্কেত বটে।
তিন : মির্জা ফখরুল আমাদের রাজনীতির খুবই অসময়ের একজন নেতা। বর্তমান রাজনীতিতে তিনিই সম্ভবত একমাত্র নেতা যাকে তার শত্র“রাও পর্যন্ত নিন্দা করার কোনো ভাষা খুঁজে পাবে না। বাংলাদেশের মতো একটা নষ্ট রাজনৈতিক আবহাওয়ায় তিনি একজন বিতর্কমুক্ত সজ্জন সৎ মানুষ। এই ভদ্র মানুষটির বড় সম্পদ তার শালীনতাবোধ ও চারিত্রিক মাধুর্যতা। একজন সাধারণ মানুষের প্রতি তার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাবোধ থেকে শুরু করে প্রতিপক্ষ দলের নেতাদের প্রতি তার ভদ্র ও মার্জিত প্রতিবাদ তাকে আর দশজনের চেয়ে আলাদা করে রেখেছে।
যারা বলে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক শিষ্টাচার নেই, তাদের উচিত হবে মির্জা ফখরুলকে অনুসরণ করা। শত নির্যাতন, শত নিপীড়ন, শত হেয়প্রতিপন্নের পরও হাসিমুখে গণতন্ত্রের কথা এভাবে আর কে বলতে পারে? অথচ বিএনপির মতো প্রধান একটি দলের মহাসচিব হওয়ার মতো নেতা ছিলেন না তিনি। বড় মাপের রাজনৈতিক সংগঠক বা দলের গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারক না হয়েও তাকে দলের বিপদের সময় মহাসচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।
এটা দলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক রহমানের অন্যতম বড় একটা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সাফল্য ছিল বলে আজ প্রমাণিত হয়েছে। যে লোকটা বাম রাজনীতি থেকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছিলেন, তিনিই আবার কেমন করে হয়ে গেলেন জাতীয়তাবাদী রাজনীতির একজন বিমূর্ত আইকন?
যে দলে অন্তর্কোন্দল, গ্র“পিং আর দুর্নীতিগ্রস্ত সুবিধাবাদীদের ছড়াছড়ি সেখানে ক্ষমতায় থাকাকালে মন্ত্রিত্বে থাকা এই মানুষটিকে দুর্নীতি বা অনিয়ম কখনো স্পর্শ করার অভিযোগ নেই। তার ভদ্রতা, মেধা, শিষ্টাচার আর মিতভাষী তুখোড় বক্তৃতাই সরকারকে ভাবিয়ে তুলেছে নিত্যদিন। তাই সরকারের নিশানায় তাকেই ঘায়েল হতে হলো সবচেয়ে বেশি। সরকারের অবস্থা এমন যে, তাকেই যেন সবার আগে রুখতে হবে।
চার : আমাদের সুপ্রিম কোর্টের ২০০২ সালের সাইফুজ্জামান বনাম রাষ্ট্র মামলায় রায়ে বলা হয়েছে যে, ইতোমধ্যে আটক থাকা কোনো ব্যক্তিকে নতুন মামলায় গ্রেফতার দেখানোর আবেদন করা হলে সেই আবেদন মঞ্জুরের আগে তদন্তের সব কাগজপত্রসহ অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হবে। কিন্তু মির্জা ফখরুলসহ বিএনপি-জামায়াতের এ রকম শত শত নেতাকর্মীকে আদালতে হাজির না করেই শ্যোন অ্যারেস্ট দেখিয়ে জেলগেট থেকেই গ্রেফতার দেখানো হচ্ছে।
ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তানি শাসনামলে কিংবা এমনকি স্বৈরাচারী এরশাদের সময়ও এভাবে শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাকে নিপীড়ন করা হতো না। অথচ এখন সরকার যেভাবে প্রতিপক্ষ দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের হুকুমের আসামি করে জেলে ঢোকাচ্ছে তাতে আশঙ্কা হয়, আমাদের ভবিষ্যতের নেতারা কোনো না কোনো অপরাধের হুকুমের আসামি হয়ে নিশ্চিতভাবেই চিরজীবন জেলের ভাত খাবেন।
বর্তমানের এসব মিথ্যা মামলা তখন আইনি নজির হয়ে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। ফলে ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়বে। ভবিষ্যতে সভ্য সমাজের ভালো মানুষ রাজনীতিতে আসতেও ভয় পাবে।
পাঁচ : মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি সচিবালয়ে ককটেল বিস্ফোরণের হুকুমদাতা। অথচ সরকার বলছে দু’জন মোটরসাইকেল আরোহী সচিবালয়ে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। উদ্ভট ও যুক্তিহীন এসব মিথ্যা অভিযোগে মির্জা ফখরুলসহ বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের বহু নেতাকে হুকুমের আসামি বানিয়ে গ্রেফতার করে জেলে ঢোকানো হয়। কিন্তু সরকারের কথিত সেই ‘দুইজন মোটরসাইকেল আরোহী’ আজো গ্রেফতার হয়নি। এমনকি তাদেরকে শনাক্ত পর্যন্ত করা হয়নি।
অথচ আশ্চর্যজনকভাবে সরকার তাদের হুকুমদাতাদের কিভাবে শনাক্ত করতে পারল? সচিবালয়ের মতো স্পর্শকাতর গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় মোটরসাইকেল চালিয়ে বোমা ফাটিয়ে বীরদর্পে প্রস্থান করার যোগ্যতা কারা রাখে, তা কিন্তু জনগণ ঠিকই বোঝে।
তা ছাড়া মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে গাড়ি পোড়ানোর যে মামলা দেয়া হয়েছে সেই মামলায় যে ড্রাইভারকে বাদি করে মামলা দেয়া হয়েছিল, সে ড্রাইভার নাকি ঘটনাস্থলে ছিলই না। মির্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ হচ্ছে, তিনি অবরোধ কর্মসূচিতে জনগণের সহযোগিতা চেয়েছিলেন এবং রাস্তায় গাড়ি না চালাতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন।
এখন প্রশ্ন হলো, ১৭৩ দিন হরতাল নৈরাজ্য করার কারণে হুকুমের আসামি করে তো তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বা শীর্ষ নেতাদের জেলে ঢোকানো হয়নি। এসব মিথ্যা অভিযোগে মির্জা ফখরুলরা হুকুমের আসামি হলে মায়ের পেটে শিশুকে গুলিবর্ষণ, বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যা, শিশু সৌরভের পায়ে গুলি, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন, মন্ত্রী মশাইয়ের সচিবালয়ে সচিবের কক্ষ ভাঙচুর কিংবা ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসী হত্যাকাণ্ডের হাজারো অভিযোগে এভাবে হুকুমের আসামি করা হলে পুরো আওয়ামী লীগই তখন খালি হয়ে যাওয়ার কথা নয় কি?
ছয় : শারীরিকভাবে অসুস্থ মির্জা ফখরুলকে বার বার কারাগারে প্রেরণের ফলে অসুস্থ এই মানুষটি ১৬ কেজি ওজন হারিয়ে জীর্ণদেহে কারা প্রকোষ্ঠে শারীরিক ব্যধির সাথেও লড়ে যাচ্ছেন। কিছুদিন আগে হৃদরোগসহ ঘাড়ে ক্যারোটিড আর্টারিতে ব্লক নিয়ে দীর্ঘ কারাভোগের পর উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে প্রথমে সিঙ্গাপুর, পরে আমেরিকায় চিকিৎসা নেন। কিন্তু তার আর্টারির ব্লকটির অবস্থান খুবই জটিল হওয়ায় অপারেশন করা ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানান চিকিৎসকেরা।
এ অবস্থায় কারাগারে সুচিকিৎসার অভাবে তার জীবনহানির উদ্বেগ জানিয়ে স্ত্রী রাহাত আরা আকুতি জানিয়ে বলেন, ‘আমরা কার কাছে বিচার চাইব?’ তার কন্যা মির্জা শামারুহ তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘অবিশ্বাস্য, আব্বুকে দেখলাম। থমথমে চেহারা ভেঙে গেছে। আব্বু নিজেই বলল, মা সব নষ্ট হয়ে গেছে। কিছুই করতে পারলাম না।
আমি শুধু বললাম, তুমি সারা জীবন চেষ্টা করেছ। এবার আমাদের পালা। দেশে ভালো চিকিৎসা নেই। আব্বুর বয়স ৬৮। আর ব্লকটা ডেলিকেট জায়গায় বলে সার্জারি করতে রাজি হলো না ডাক্তার। আব্বুকে আমি মানা করলাম যেতে। নাহ, আমার লজ্জা নেই স্বীকার করতে। আমি তাকে নিষেধ করেছি দেশে যেতে। কারণ আমি দেখেছি কী অমানুষিক যুদ্ধ করেছে আমার আম্মু। আমি জেনেছি, এ দেশে নিরপরাধরা বেশি অত্যাচারিত। আমি দেখেছি এ দেশে শুধু গর্ধব আর দালালেরা নিরাপদ। আব্বু সরাসরি বলল, আমি কোনো অপরাধ করিনি। আমি ফিরব, মাথা উঁচু করে। আব্বু ফিরে গেল। ফিরে গিয়ে আব্বু দেখল তার বন্ধুর একমাত্র ছেলের নিজ অফিসে খুন হয়ে যাওয়া। আব্বু আজ আবার জেলে। কোনো অপরাধ না করে। জেলে যাওয়ার আগে এই কথাটাই বলে গেল আব্বু আজ। আব্বুর জন্য কেনা জিয়া হায়দারের বইগুলো পাঠাব কাল। আমার সাহসী একাকী যুদ্ধ করে যাওয়া আব্বু যেন সুস্থ থাকে, খুশি থাকে। বিচারহীনতার দেশে আমিও বিচার চাই না।’
সাত : গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, ’উৎকৃষ্ট জীবন লাভের জন্য কোনো সমাজের সংগ্রামের নাম হচ্ছে রাজনীতি।’ আপদমস্তক নির্ভীক সৎ মানুষ মির্জা ফখরুল দেশকে উৎকৃষ্ট জীবন দান করতে এভাবে আর কত দিন জেল খাটবেন? আর কতটা অসুস্থ শরীর নিয়ে সংগ্রাম করলে এই সমাজ উৎকৃষ্ট একটা জীবন পাবে? আর কতটা নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করলে দেশ গণতন্ত্র ফিরে পাবে? মির্জা ফখরুল একজন দেশবরেণ্য রাজনীতিবিদ ও সজ্জন ব্যক্তি। তিনি পরমতসহিষ্ণু উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতি চর্চা করে বিএনপিকে সঠিক নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
আর সরকার এটাই চাচ্ছে না। তারা চাচ্ছে নিপীড়ন-নির্যাতন, গুম-খুন করে দেশকে ব্যর্থ, অস্থিতিশীল ও গণতন্ত্রহীন করে তোলা। কারণ স্বৈরশাসকেরা কখনো গণতন্ত্রমনাদের বাঁচিয়ে রাখতে চায় না। কিন্তু এভাবে নিপীড়ন-নির্যাতন, মামলা-গ্রেফতার, খুন-গুম চলতে থাকলে ঠিকই এক সময় এই মির্জা ফখরুলরাই হয়ে উঠবেন বাংলাদেশের জনগণের ক্রান্তিকালের গণমানুষের একেকজন মুক্তিকামী নেতা। স্বৈরাচারের দমন-পীড়ন যতই চলুক মির্জা ফখরুলরা জেগে উঠবেন ঠিকই। মির্জা ফখরুলদের এই বিজয়কে রুধিবে কে?
লেখক : আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ e-mail: [email protected]